আর্যদের সন্ধানে হিমালয়ে অভিযান চালিয়েছিল নাৎসিরা
১৯৩৮ সালে জার্মানির নাৎসি বাহিনীর অন্যতম প্রধান সদস্য হেনরিখ হিমলার আর্য জাতির উৎস অনুসন্ধানের জন্য তিব্বতে পাঁচ সদস্যের একটি দল পাঠান। হিটলারের অন্যতম শীর্ষ লেফটেন্যান্ট এবং সরকারি সংস্থা সুজস্টাফেল (এসএস) এর প্রধান হিমলার ছিলেন হলোকাস্টেরও একজন প্রধান পরিকল্পনাকারী।
জার্মানদের এই অভিযানের কাহিনী বর্ণনা করেছেন লেখক বৈভব পুরান্দার।
নাৎসি বাহিনীর প্রধান অ্যাডলফ হিটলার বিশ্বাস করতেন, উত্তর ইউরোপ (নর্ডিক) থেকে আসা "আর্য" জাতির লোকেরা প্রায় ১৫০০ বছর আগে ভারতে প্রবেশ করেছিল। তিনি আরও বিশ্বাস করতেন, আর্যরা স্থানীয় "অনার্য" জাতির মানুষের সাথে মিশে যাওয়ার "অপরাধ" করেছিল। ভিন্ন জাতির সাথে মিশে যাওয়ায় পৃথিবীর অন্য সব মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ যে সকল বৈশিষ্ট্য ছিল তাদের, সেসব হারিয়েছিল আর্যরা।
প্রসঙ্গত, যারা শ্বেতাঙ্গ নর্ডিকদের উচ্চতর জাতি হিসেবে বিবেচনা করতো, তারা কল্পনাপ্রসূত হারিয়ে যাওয়া শহর আটলান্টিসের গল্পেও বিশ্বাসী ছিল। তাদের মতে, এ শহরটিতে বাস করতো "বিশুদ্ধ রক্তের" লোকেরা। ধারণা করা হয়, এ শহরটি আটলান্টিক মহাসাগরে ইংল্যান্ড এবং পর্তুগালের মাঝে কোথাও অবস্থিত ছিল। পৌরাণিক এ দ্বীপটি ঐশ্বরিক এক বজ্রপাতের আঘাতে সমুদ্রে ডুবে যায় বলে ধারণা করা হয়।
এ ঘটনার পর যেসকল আর্য জীবিত ছিল, তারা নিরাপদ স্থানগুলোতে চলে যায়। হিমালয় অঞ্চলকেও তাদের একটি আশ্রয়স্থল বলে মনে করা হত। বিশেষ করে "পৃথিবীর ছাদ" হিসেবে বিখ্যাত তিব্বতে তারা আশ্রয় নিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
বিংশ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশে চলছিল নানা রকমের যুদ্ধ-বিগ্রহ। হিটলার সেসময় নিয়মিতভাবে ভারতীয় জনগণ এবং তাদের স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রতি গভীর বিরক্তি প্রকাশ করতেন। তার বক্তৃতা, লেখা এবং বিতর্কে এ ধরণের অনুভূতির প্রকাশ পেত।
তবে, হিমলারের মতে, ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল খুঁটিয়ে দেখার যোগ্য একটি জায়গা।
১৯৩৫ সালে এসএস অন্তর্ভুক্ত 'ব্যুরো অব অ্যানসেস্ট্রাল হেরিটেজ' নামক একটি ইউনিট স্থাপন করেন হিমলার। আটলান্টিস ডুবে যাওয়ার পর সেখানকার লোকেরা কোথায় গিয়েছিল, এবং কোথাও এ মহান জাতিটির চিহ্ন এখনও রয়ে গেছে কিনা তা আবিষ্কার করা ছিল এই ইউনিটের কাজ।
তিন বছর পর, অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর এক বছর আগে, ৫ সদস্যের দলটি "আর্য জাতির উৎস" আবিষ্কারের মিশনে তিব্বত অভিযানে বের হয়।
এ দলটির সদস্য, আর্নস্ট শ্যাফার ছিলেন একজন প্রাণীবিজ্ঞানী। সেসময় ২৮ বছর বয়সী এ বিজ্ঞানী এর আগে দু'বার ভারত-চীন-তিব্বত সীমান্ত সফরে গিয়েছিলেন। ১৯৩৩ সালে নাৎসিদের বিজয়ের পরপরই তিনি এসএস-এ যোগদান করেন।
শিকারে পারদর্শী শ্যাফার তার বার্লিনের বাড়িতে ট্রফি সংগ্রহ করতে পছন্দ করতেন। একটি শিকার অভিযানে, একটি হাঁসকে গুলি করার চেষ্টা করার সময় লক্ষ্যচ্যুত হয়ে ঘটনাক্রমে তার স্ত্রীর মাথায় গুলি চালান শ্যাফার। সে ঘটনায় নিহত হন তার স্ত্রী।
দলটির আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন ব্রুনো বেগার। তরুণ এই নৃবিজ্ঞানী ১৯৩৫ সালে এসএস -এ যোগ দিয়েছিলেন। তিব্বতিদের মাথার খুলি এবং মুখের বিবরণের পরিমাপ জেনে সে অনুযায়ী মুখোশ তৈরি করতেন বেগার। তার ভাষ্যমতে, "এ অঞ্চলে নর্ডিক জাতির তাৎপর্য এবং বিকাশ বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যে তাদের উৎপত্তি সম্পর্কে উপাদান সংগ্রহ করতে" এ কাজ করতেন তিনি।
তাদের জাহাজটি ১৯৩৮ সালের মে মাসের প্রথম দিকে শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে পৌঁছায়। সেখান থেকে তারা আরেকটি জাহাজে করে মাদ্রাজে (বর্তমানে চেন্নাই) এবং তৃতীয় একটি জাহাজে করে কলকাতায় পৌঁছান।
তবে, ভারতে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ভ্রমণকারী এসকল জার্মানদের বিষয়ে ছিল সতর্ক। তাদেরকে গুপ্তচর বলে মনে করেছিল ব্রিটিশরা। এমনকি তাদেরকে ভারতের মধ্য দিয়ে যেতে দিতেও অনিচ্ছুক ছিল কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া, তাদেরকে নিয়ে তৎকালীন ব্রিটিশ-পরিচালিত টাইমস অব ইন্ডিয়া "আ গেস্টাপো এজেন্ট ইন ইন্ডিয়া" শিরোনামে একটি লেখাও প্রকাশ করে। উল্লেখ্য, জার্মানিদের গুপ্ত পুলিশ বাহিনীকে গেস্টাপো বলা হয়।
কেবল মধ্য ভারত নয়, উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্য সিকিমের গ্যাংটকে দায়িত্বরত ব্রিটিশ রাজনৈতিক কর্মকর্তাও সে অঞ্চল দিয়ে জার্মানদের তিব্বতে প্রবেশের ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন না। সিকিম সে সময় একটি স্বাধীন পর্বতরাজ্য ছিল।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত, তারা তিব্বতে পৌঁছাতে সক্ষম হন। ঐ বছরের শেষ দিকে সে পাঁচজন জার্মান তাদের লাগেজের সাথে বাঁধা স্বস্তিকা পতাকা নিয়ে তিব্বতে প্রবেশ করেন।
স্থানীয়ভাবে "ইউংড্রুং" নামে পরিচিত স্বস্তিকা পতাকা হলো সৌভাগ্যের প্রতীক। তিব্বতে ব্যাপকভাবে পরিচিত এ পতাকাটি ভারতের হিন্দুদের মধ্যেও ছিল প্রচলিত। এমনকি আজও বাড়ির বাইরে, মন্দিরের ভেতরে, রাস্তার কোণে, টেম্পো এবং ট্রাকের পেছনে দেখা যায় এ ধরণের পতাকা।
জার্মান দলটি যখন তিব্বতে পৌঁছায়, তখন সে দেশটি নানা ধরণের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল।
১৯৩৩ সালে তিব্বতের ১৩তম দালাই লামা মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৩৮ সালে জার্মানরা যখন তিব্বতে যান, তখন সেখানকার দায়িত্বে থাকা দালাই লামার (১৪ তম) বয়স ছিল মাত্র তিন বছর। সেসময় এক বৌদ্ধ প্রতিনিধি (রিজেন্ট) তিব্বত নিয়ন্ত্রণ করতেন।
রিজেন্টের পাশাপাশি সাধারণ তিব্বতীরাও জার্মানদেরকে সাদরে গ্রহণ করেন। এমনকি কিছু সময়ের জন্য স্থানীয়দের স্ট্যান্ড-ইন ডাক্তার হিসাবেও কাজ করেছিলেন দলটির সদস্য বেগার।
তবে, তিব্বতীয় বৌদ্ধরা এটি জানত না যে, নাৎসিদের বিকৃত কল্পনায় হিন্দুধর্মের মতোই ছিল বৌদ্ধধর্মও। তারা বৌদ্ধধর্মকে এমন একটি ধর্ম মনে করতো যা তিব্বতে আসা আর্যদের আত্মাকে দুর্বল করে দিয়েছিল।
কিন্তু ১৯৩৯ সালের আগস্ট মাসে বিশ্বযুদ্ধের অনিবার্যতার কারণে শ্যাফার এবং তাদের দলের অভিযানটি শেষ করতে হয়।
এদিকে, বেগার ততদিনে ৩৭৬ জন তিব্বতির মাথার খুলি এবং তাদের বৈশিষ্ট্য নথিভুক্ত করেন। তিব্বতিদের মোট ২ হাজার ছবি তুলেছিলেন তিনি। এছাড়া, ১৭ জনের মাথা, চেহারা, হাত এবং কানের আকৃতির ছাঁচ তৈরি করেছিলেন বেগার। ২ হাজার "নৃতাত্ত্বিক নিদর্শন" সংগ্রহের পাশাপাশি মোট ৩৫০ জন তিব্বতির হাত এবং আঙ্গুলের ছাপ নিতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি।
বেগার ছাড়াও দলের অন্য একজন সদস্য মোট ৪০ হাজার (১৮ হাজার মিটার দৈর্ঘের ফিল্ম) ছবি তুলেছিলেন তাদের অভিযান চলাকালীন সময়ে।
তাদের ভ্রমণ সংক্ষেপিত হওয়ায় শেষ মুহূর্তে দলটিকে কলকাতা থেকে বিমানযোগে জার্মানিতে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছিলেন হিমলার। মিউনিখে বিমানবন্দরে তাদেরকে স্বাগত জানাতে তিনি নিজে উপস্থিত ছিলেন।
কিন্তু, তাদের এ অভিযানে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তের শেষ রক্ষা হয়নি।
শ্যাফার তার তিব্বতী "মূল্যবান সম্পদের" বেশিরভাগ সল্জবার্গের একটি দুর্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এখানেই ছিলেন তিনি। কিন্তু ১৯৪৫ সালে মিত্রবাহিনী আসার পর দুর্গটিতে অভিযান চালানো হলে তিব্বতীয় ছবি এবং অন্যান্য সামগ্রীর অধিকাংশই নষ্ট হয়ে যায়।
অভিযানের অন্যান্য তথাকথিত 'বৈজ্ঞানিক ফলাফল'গুলোর ভাগ্যেও একই পরিণতি লেখা ছিল। যুদ্ধের সময় সেসকল নথিও হারিয়ে যায়, কিংবা ধ্বংস হয়ে যায়।
- সূত্র- বিবিসি