‘অল কোয়াইট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’: নাৎসি ফিল্ম সেন্সরের সঙ্গে একটি চলচ্চিত্রের লড়াই
১৯২৯ সালের ২৯ জানুয়ারি এরিখ মারিয়া রেমার্কের যুদ্ধবিরোধী উপন্যাস 'অল কোয়াইট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট' প্রকাশ পাওয়ার পরপরই জার্মান সাহিত্যের ইতিহাসে তুমুল সাফল্য অর্জন করে। সহসাই ২৬টি ভাষায় অনুবাদ হয় বইটির। শুধু জার্মানিতেই কয়েক মাসের মধ্যে বিক্রি হয় প্রায় ৫ লাখ কপি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা ফুটিয়ে তোলা এক উপন্যাসের এমন সাফল্য ভালোভাবে নেয়নি দেশটির ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট পার্টি। এ দল তখন ক্ষমতা দখলের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তারা গুজব ছড়িয়ে দেয়, রেমার্ক আসলে 'ক্রেমার' নামে একজনের ছদ্মনাম। আরও দাবি তোলে, ওই লোক একজন ফরাসি ইহুদি এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি সৈনিক হিসেবে আদৌ যুদ্ধ করেননি।
উপন্যাস থেকে চলচ্চিত্র
এক বছর পর একটি আমেরিকান প্রোডাকশন কোম্পানি এই উপন্যাসকে চলচ্চিত্রে রূপ দেয়। পরিচালনা করেন লুইস মাইলস্টোন। শুরুতে, ১৯৩০ সালের ২১ নভেম্বর বার্লিনের সুপ্রিম সেন্সরশিপ বোর্ড জার্মান দর্শকদের জন্য চলচ্চিত্রটির অনুমোদন দেয়।
এই চলচ্চিত্রের প্রিমিয়ার হয় বার্লিনের বিশাল আর্ট নভো-স্টাইলের থিয়েটার ও কনসার্ট হল মোজার্টসালে, ডিসেম্বরের শুরুতে। বুদ্ধিজীবী, তারকা ও অন্যান্য বিশিষ্ট লোকের সমাগম ঘটে সেখানে। উদারপন্থী পত্রিকা ফসিসখে জিতুংয়ে লেখা হয়, 'দর্শকের মনে এমন গভীর প্রভাব ফেলা' কোনো চলচ্চিত্র এর আগে দেখা যায়নি। চলচ্চিত্রটি শেষ হওয়া পর্যন্ত পুরো হলে বিরাজ করে 'পিন পতন নীরবতা'।
প্রদর্শনীতে ইঁদুর ও দুর্গন্ধের হানা
বার্লিনের নলেনডর্ফপ্লাৎসে আয়োজিত চলচ্চিত্রটির আরেকটি জেনারেল পাবলিক স্ক্রিনিংয়ে বিস্ময়কর ও ভয়ানক ঘটনা ঘটে। একদল নাৎসি সেখানে ঢুকে পড়ে গোলমাল পাকায় এবং প্রদর্শনী বন্ধের হুমকি দেয়। এ সময়ে নাৎসি পার্টির রাইখস্ট্যাগ সদস্যরা সিনেমা-হলটিতে ইঁদুর ও আবর্জনা ছুড়ে দিয়ে দর্শকদের বেরিয়ে আসতে বাধ্য করে।
বার্লিনের নাৎসি পার্টির তৎকালীন ডিস্ট্রিক্ট লিডার ও পরবর্তীকালে নাৎসির প্রোপাগান্ডা মিনিস্টার ইয়োসেফ গোয়েবলসের মাথা থেকে এসেছিল এ কুবুদ্ধি। তিনি ধরে নিয়েছিলেন, এই চলচ্চিত্রে যুদ্ধকে যেভাবে দেখানো হয়েছে, সেটি নাৎসি আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বার্লিনে তিনি এই চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে বক্তব্যও রাখেন। এ কারণে ব্যাপক পুলিশি নিরাপত্তার অধীনেই শুধু চলচ্চিত্রটির প্রদর্শন হয়।
১৯৩০ সালের ডিসেম্বরে 'নিরাপত্তাজনিত কারণ' দেখিয়ে সুপ্রিম সেন্সরশিপ বোর্ড এই চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী লাইসেন্স বাতিল করে দেয়। ঘটনাক্রমে মোজার্টসালের ইহুদি ম্যানেজার হান্স ব্রডনিৎসের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট; পরবর্তীকালে, ১৯৪৪ সালে অসভিৎস বন্দিশিবিরে এক গ্যাস চেম্বারে তাকে হত্যা করা হয়।
১৯৩৩ সালের জানুয়ারিতে হিটলারের সাম্রাজ্যে 'অল কোয়াইট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট' পুরোদস্তুর নিষিদ্ধ করা হয়।
যুদ্ধের বিভীষিকাময় চিত্রায়ন
এত কিছুর পরও সাধারণ দর্শক ও সমালোকদের কাছে চলচ্চিত্রটির জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি। যুদ্ধক্ষেত্রের অবাধ চিত্রায়নে দ্রুতই অর্জিত হয় এই জনপ্রিয়তা।
যুদ্ধে বাধ্যতামূলক যোগ দেওয়ার আগে একজন উচ্চ বিদ্যালয় শিক্ষার্থী থাকা পল বাউমার নামে এক তরুণের গল্প বলে এই চলচ্চিত্র। তখনো জার্মানিতে ফুরফুরে মেজাজ ছিল। সেই সময়ে ক্লাসে পলের দেশপ্রেমিক শিক্ষকটি নিজের ছাত্রদের 'পিতৃভূমির জন্য জীবন দিতে' উৎসাহিত করে।
এই উৎসাহে পল ও তার সহপাঠীরা আর্মিতে নিবন্ধন করে নিজেদের নাম। অবশ্য যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তবতার বীভৎস রূপ সহসাই তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। এক আক্রমণে একজন ফরাসি সৈনিককে জখম করে পল। এরপর ওই সৈনিকের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা ও তার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে সে।
পরবর্তীকালে পল নিজেও জখম হয় এবং তাকে একটি ক্যাথলিক হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ছুটিতে বাড়ি ফিরে সে নিজের পুরনো বন্ধু ও শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা করতে যায়। তারা 'জার্মান নায়কোচিত ভূমিকা'র জন্য প্রশংসা করে তার। পল অবশ্য বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা শুনিয়ে দাবি করে, যুদ্ধে যাওয়া ছিল তার ভুল সিদ্ধান্ত। তখন শিক্ষক ও ছাত্ররা তাকে একজন ভীতু হিসেবে উপহাস করে।
মৃত্যু কোনো মধুর ব্যাপার নয়
এমন প্রতিক্রিয়ায় হতাশ হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে আসে পল, যেখানে তার বেশকিছু সহযোদ্ধা ইতোমধ্যেই মারা গেছে। চলচ্চিত্রটির শেষ দৃশ্যে দেখা মেলে ১৯১৮ সালের শরৎকালের। সেখানে দেখা যায়, একটি প্রজাপতি দেখে সেটি ধরতে পরিখা থেকে এগিয়ে যায় এবং এক ফরাসি সৈনিকের গুলিতে বিদ্ধ হয় পল। পলের স্বগতোক্তির ভেতর দিয়ে শেষ হয় এই চলচ্চিত্র: 'মৃত্যু কোনো মধুর ব্যাপার নয়'।
চলচ্চিত্র সমালোচক সিগফ্রিড ক্রকারের মতে, চলচ্চিত্রটিতে যুদ্ধের যে সত্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তা 'সুখকর' নয়। চলচ্চিত্রের ইতিহাসের তৎকালীন প্রাথমিক যুগে এর আগে কখনো এমন ভয়ানক দৃশ্যের দেখা মেলেনি। একটি 'লস্ট জেনারেশনে'র এই আত্মবিসর্জনের যাত্রা চলচ্চিত্রের পর্দায় বাস্তবধর্মী ও নিরলসভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
অস্কার জয়
রাশিয়ান-আমেরিকার চলচ্চিত্রকার লুইস মাইলস্টোন এ চলচ্চিত্রের জন্য বাজেট পেয়েছিলেন ১.২ মিলিয়ন ডলার (বর্তমান বিবেচনায়, ১.০১ মিলিয়ন ইউরো); সে সময়ের হিসেবে বেশ ভালো অংকের বাজেট। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভালো, ইহুদি পরিবারের সন্তান মাইলস্টোনের জন্ম ১৮৯৫ সালে, তৎকালীন রাশিয়ান সাম্রাজ্যে। তখন তার নাম ছিল লেইব মিলস্তেইন। ১৯১৩ সালের শেষ দিকে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর মাত্র কয়েক মাস আগে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান।
এই চলচ্চিত্রে ট্র্যাকিং শট, ক্রসকাট ও সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণের সাহায্যে দর্শকের মনে ঘটনার সরাসরি রেখাপাত ঘটাতে সক্ষম হন মাইলস্টোন। যুদ্ধ ও যুদ্ধের কিলিং মেশিন নিয়ে এর আগে এমন বাস্তবধর্মী কোনো চলচ্চিত্রের দেখা মেলেনি। ১৯৩০ সালে 'সেরা চলচ্চিত্র' ও 'সেরা পরিচালক' ক্যাটাগরিতে দুটি অস্কার জয় করেন এই নির্মাতা।
ন্যাশনাল সোশ্যালিস্টদের নিষ্ঠুর সাংস্কৃতিক নীতি সম্পর্কেও ধারণা দেওয়া এই চলচ্চিত্র আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে। ১৯৩১ সালে জার্মান চলচ্চিত্রে এটির একটি কঠোরভাবে সংক্ষিপ্ত ও সেন্সর ভার্সন ফিরে আসে ঠিকই, তবে চলচ্চিত্রটি 'একদল সুনির্দিষ্ট লোকের সামনে এবং বদ্ধ পরিস্থিতি'তেই শুধু দেখানো হয়। ১৯৩৩ সালে হিটলার ক্ষমতা দখলের পর এই চলচ্চিত্রকে আবারও পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়।
ইতিহাসের সেরা ১০০ চলচ্চিত্রে স্থান
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও চলচ্চিত্রটির সম্পাদিত ও সংক্ষিপ্ত সংস্করণগুলোই শুধু দেখানো হতো। ১৯৫২ সালে 'অল কোয়াইট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট' আবারও সিনেমা-হলে ফিরে আসে, তবে এটির প্রধান দৃশ্যগুলো ইচ্ছেকৃতভাবে কেটে ফেলা হয়। অবশেষে ১৯৮৩-৮৪ সালে জার্মান দর্শকরা এটির নতুন ডাবিংকৃত ও পূর্ণাঙ্গ রূপের দেখা পায় এবং মূল আমেরিকান ভার্সনটি সম্প্রসারিত হয় টেলিভিশনে।
মাইলস্টোনের এই চলচ্চিত্র শুধু জার্মানিতেই নয়, আরও কিছু দেশেও হরদম নিষেধাজ্ঞার রোষানলে পড়ে। অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, এবং এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও শুধুই সংক্ষিপ্ত সংস্করণগুলো দেখানো হয়।
এতসব অবজ্ঞা ও সেন্সরশিপের বাড়াবাড়ি অবশ্য চলচ্চিত্রটির সাফল্যকে দমাতে পারেনি। লুইস মাইলস্টোন পরিচালিত 'অল কোয়াইট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট'কে এখনো আমেরিকান চলচ্চিত্র ইতিহাসের সেরা ১০০ চলচ্চিত্রের একটি হিসেবে গণ্য করা হয়।
- সূত্র: ডয়চে ভেলে