এন্টোনভ এন-২২৫: যেভাবে স্নায়ুযুদ্ধের কারণে তৈরি হল বিশ্বের বৃহত্তম বিমান
১৯০৩ সালে নর্থ ক্যারোলিনার কিটি হকে রাইট ব্রাদার্স এর তৈরি প্রথম নিয়ন্ত্রিত ও শক্তিসম্পন্ন উড়োজাহাজ ১২০ ফুট পথ পাড়ি দেয়। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমান এন্টোনভ এন-২২৫। এই বিমান এতোটাই বড় যে এর কার্গোর মধ্যেই বেশ ভালোভাবে ঢুকিয়ে রাখা যাবে রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের ওই বিমান।
৬টি টার্বোফ্যান ইঞ্জিন সমৃদ্ধ, ফুটবল মাঠের দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট উইংস্প্যানের এই বিমানটি বিশ্বের যেকোনো বিমানের চেয়ে বেশি ওজন বহন করতে পারে, এই মডেলের বিমান আছেও একটি। বিমানবন্দরে এন-২২৫ ওঠানামার সময় প্রায়ই দর্শনার্থীদের ভীড় লেগে যায়।
বিমান বিশেষজ্ঞ ও বাফালো স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ইলিয়া গ্রিনবার্গ বলেন, "বিমানটির উড্ডয়ন ও অবতরণের দৃশ্য দেখার মতো। এর বিশাল আয়তনের জন্যই মনে হয় ধীরে ধীরে আকাশে ভেসে ওঠে। প্রকৌশল বিদ্যার বিস্ময়কর সৃষ্টি এটি।"
সাম্প্রতিককালে বিমানটি কোভিড-১৯ রিলিফ বহনের কাজও করছে। তবে এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল একেবারেই আলাদা। স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত স্পেস প্রোগ্রামের অধীনে বিমানটি নির্মাণ করা হয়।
১৯৮১ সালে মহাকাশ গবেষণায় নতুন যুগের সূচনা হয়। নাসা প্রথম পুনঃব্যবহারযোগ্য মনুষ্যবাহী মহাকাশযান তৈরি করে। মিলিটারি স্যাটেলাইট স্থাপন করা হয়। তখনই সোভিয়েত ইউনিয়ন একই ক্ষমতাসম্পন্ন মহাকাশযান তৈরির পরিকল্পনা করে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই তৈরি হয় মহাকাশযান 'বুরান'। তবে সমস্যা বাঁধে মহাকাশযানটি বহনের ক্ষেত্রে। তখন অ্যান্টোনভ ডিজাইন ব্যুরোকে বলা হয় বুরান মহাকাশযানটি পরিবহনে সক্ষম একটি বিমান বানাতে। এন ১২৪ নামের আরেকটি বড় বিমানের গঠনের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয় এন- ২২৫।
দ্য সোভিয়েত সুপার প্লেন
কার্গোর ক্ষমতা দ্বিগুণ বৃদ্ধি করা হয়, ইঞ্জিনের সংখ্যা ২টি বাড়িয়ে মোট ৬টি করা হয়। বিশালাকৃতির এই বিমানের নাম দেয়া হয় এন-২২৫ ম্রিয়া।
গ্রিনবার্গ বলেন, "ম্রিয়া একটি ইউক্রেনিয়ান শব্দ যার অর্থ স্বপ্ন। এটিই প্রথম সোভিয়েত বিমান যার নামকরণ হয়েছে ইউক্রেনিয়ান শব্দে।"
১৯৮৯ সালে প্যারিস এয়ার শো তে নজড় কাড়ে এন-২২৫। বার্লিন প্রাচীরের পতনের ১ বছর আগে ১৯৮৮ সালে প্রথম যাত্রা শুরু করে এন-২২৫ ও বুরান। এর ১ বছর পরেই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন শুরু হওয়ায় বুরানের প্রজেক্ট বন্ধ হয়ে যায়। এন-২২৫ এর কয়েকবার পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চলে। পরবর্তীতে
বিমানটিকে স্যুট, সুইমিংপুলসহ বিলাসবহুল উড়ন্ত হোটেল বানানোর প্রস্তাবনা কখনো বাস্তবের মুখ দেখেনি।
২০০১ সালে বিভিন্ন সংস্কার ও নতুন সরঞ্জামাদি সংযোজনের পর বিমানটিকে আবার চালু করা হয়। এবছরই বিমানটি ১২৪টি বিশ্বরেকর্ড স্থাপন করে। সেসময় নাইন ইলেভেনের কারণে এ ঘটনা খুব একটা মানুষের নজর কাড়েনি।
অ্যান্টোনভ এয়ারলাইনস এন-১২৪ এর ধারণ ক্ষমতার অধিক মালামাল বহনের অর্ডার আসায় অবশেষে এন-২২৫ চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এন-২২৫ এর কার্গো বগির ধারণক্ষমতা ৯৫০ কিউবিক মিটার। এত সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা ২৫০ টন।
সবচেয়ে ভারী, দীর্ঘতম বস্তু পরিবহনের রেকর্ড কুড়িয়েছে বিমানটি। মাটি থেকে ৩৩,০০০ ফুট উপরে ইউক্রেনের ১২০ জন শিল্পীর ৫০০টি চিত্রকর্মের প্রদর্শনীর মাধ্যমে গিনিজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড স্থাপন করে।
এবছর এপ্রিলে বিমানটি আরেকটি রেকর্ড স্থাপন করে। চীন থেকে পোল্যান্ডে ১০০ টন কোভিড-১৯ সুরক্ষা সরঞ্জামাদি পরিবহন করে। চীন থেকে বিভিন্ন জায়গায় এসব সরঞ্জামাদি পরিবহনের জন্য আড়াই মাসে দশবার বিমানটি ব্যবহার করা হয়েছে।
এন-২২৫ বিমানটি খুবই সীমিত আকারে ব্যবহৃত হয়। প্রতিঘন্টায় এর জ্বালানি খরচ ৬,৭০০ মার্কিন ডলার। অ্যান্টোনভের কাছে দ্বিতীয় আরেকটি বিমান বানানোর সরঞ্জামাদি থাকলেও তাদের আপাতত এই পরিকল্পনা নেই। বর্তমান চাহিদাও মেটানো সম্ভব হচ্ছে একটি এন-২২৫ দিয়েই। চীন একবার কিনে নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলেও পরিবহনের সীমাবদ্ধতার জন্য তা সম্ভব হয়নি।
অ্যান্টোনভ এয়ারলাইনস এর সিনিয়র উপ পরিচালক ভিটালি শোস্ত বলেন, "বিমানটি আমাদের গর্বের বিষয়, ইউক্রেন ও অ্যান্টোনভ কোম্পানি উভয়ের জন্য । আমি স্কুলে পড়াকালীন বিমানটি দেখে অবাক হয়েছিলাম, এটি উড়তে পারতো বিশ্বাস করতে পারিনি। এখন আমিই বিমানটির উড়তে পারা নিশ্চিত করি।"
আন্তর্জাতিক বিমান নীতিমালা অনুসরণ করে অ্যান্টোনভ প্রতিনিয়তই বিমানটির নিত্যনতুন পরিবর্তন করছে। কোম্পানিটি জানিয়েছে বিমানটি আরও অন্তত ২৫ বছর উড়তে পারবে।