গবেষণার অচলাবস্থা থেকে মহামারির ভ্যাকসিন তৈরির প্রাণবিন্দু হয়ে ওঠা এমআরএনএ প্রযুক্তি
১৯৯৫ সালে ক্যাটালিন কারিকোর এমআরএনএ সংক্রান্ত গবেষণা প্রায় বন্ধ হতে বসে।
সেসময় ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভেনিয়ায় কর্মরত এ প্রাণরসায়বিদ এর আগের প্রায় দুই দশক এ গবেষণার পেছনেই ব্যয় করেন।
গবেষণা সংক্রান্ত আবেদন ও গবেষণার কাজে অর্থ সাহায্যের সব আবেদন নিষ্ফল হওয়ার পর তার এমআরএনএ গবেষণায় অচলাবস্থার তৈরি হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েও পরে আর যোগাযোগ করতো না তার সাথে।
১৯৯০ এর দশকের মধ্যভাগে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারাও তার গবেষণার ব্যাপারে আশা হারিয়ে ফেলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দেয়া, বা পদবনতি- এ দুটির একটি বেছে নিতে বলা হয় তাকে। এমআরএনএ গবেষণার মাধ্যমে গুরুতর রোগের ভ্যাকসিন ও ওষুধ তৈরির স্বপ্ন দেখা কারিকোর যাত্রা এখানেই শেষ হতে যাচ্ছে এমনটাই ধরে নিয়েছিলেন তিনি।
এসব ঘটনার প্রায় ৩৪ বছর আগে ১৯৬১ সালে এমআরএনএ'র অস্তিত্ব আবিষ্কার বিজ্ঞানী মহলে সাড়া ফেলে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে কোষের প্রোটিন তৈরিতে ডিএনএ'র ভূমিকা বোঝার চেষ্টা করছিলেন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিজ্ঞানীরা। এমআরএনএ-ই এ বহুল আকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের উত্তর দেয়। বলা যায়, এমআরএনএ অনেকটা ডিজিটাল টেপ রেকর্ডারের মতো কাজ করে। কোষের নিউক্লিয়াসে অবস্থিত ডিএনএ-র তথ্য সংশ্লেষণ করে, কোষের প্রোটিন উৎপাদনকারী কণা রাইবোজোম প্রোটিন সংশ্লেষণের সময় তা কাজে লাগায়। এমআরএনএ'র এ ভূমিকা ছাড়া ডিএনএ কার্যত অচল। একারণে অনেক বিজ্ঞানীই একে 'জীবনের সফটওয়্যার' অভিহিত করেছেন।
এমআরএনএ আবিষ্কারের পেছনে থাকা নয়জন বিজ্ঞানী স্রেফ বৈজ্ঞানিক রহস্য উন্মোচনের আকাঙ্ক্ষা থেকেই গবেষণার কাজ করেন। তবে ৬০'র দশক পরবর্তী সময়ে এমআরএনএ-কে চিকিৎসাক্ষেত্রে কাজে লাগানোর ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা উৎসাহী হয়ে ওঠেন।
গবেষণাগারের পেট্রি ডিশে তৈরি কৃত্রিম এমআরএনএ ন্যানো পার্টিকেলের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করালে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উজ্জীবিত হয়। ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে এমআরএনএ-র মাধ্যমে ভ্যাকসিন তৈরি করে দেহে অ্যান্টিবডি তৈরির গবেষণা শুরু করেন গবেষকরা। এমআরএন'র সহায়তায় দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ ধ্বংসের গবেষণাও শুরু হয়।
১৯৭৬ সালে ক্যাটালিন কারিকো তার নিজ দেশ হাঙ্গেরির ইউনিভার্সিটি অব এসজেগেদের শিক্ষার্থী থাকাকালীন এ ধারণার সাথে পরিচিত হন। এরপরই তিনি ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে এমআরএনএ নিয়ে পিএইচডি গবেষণা শুরু করেন। একই সময়েই বিজ্ঞানী মহলে জিন থেরাপির ধারণা জনপ্রিয়তা পাওয়া শুরু হয়, তবে এমআরএন'র মাধ্যমেই বেশি মানুষকে সাহায্য করা সম্ভব এমনটাই বিশ্বাস করতেন কারিকো।
বেশিরভাগ রোগীর জন্যই নতুন জিনের বদলে রোগ সারিয়ে তুলতে ক্ষণস্থায়ী ওষুধই যথেষ্ট এমনটাই মনে করতেন তিনি, একারণেই এমআরএনএ ভিত্তিক গবেষণায় তার ঝোঁক প্রবল হয়।
তবে সেসময় এধরণের উন্নত প্রযুক্তি ছিলনা। বিজ্ঞানীরা কোষ থেকে এমআরএনএ পৃথক করতে পারলেও কৃত্রিমভাবে তা তৈরি তখনও সম্ভব ছিলনা।
১৯৮৪ সালে মার্কিন প্রাণ রসায়নবিদ ক্যারি মুলিস পলিমারেজ চেন রিএকশন (পিসিআর) আবিষ্কার করেন, এ পদ্ধতিতে ডিএনএর'র অতি ক্ষুদ্রাংশ নিয়েই বিস্তারিত বিশ্লেষণ সম্ভব।
১৯৮৯ সালের মধ্যেই অন্যান্য গবেষকরা পিসিআরের মাধ্যমে ডিএনএ তন্তু থেকে আরএনএ পলিমারেজ নামের এনজাইমের সাহায্যে এমআরএনএ তৈরি করতে সক্ষম হন।
এরপরই হাঙ্গেরি ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন কারিকো। ১৯৮৫ সালে টেম্পল ইউনিভার্সিটিতে চাকরি নিয়ে স্বামী - সন্তান সহ ফিলাডেলফিয়ায় পাড়ি জমান তিনি। তবে আমেরিকান স্বপ্ন ভঙ্গ হতেও খুব বেশি সময় লাগেনি। মাত্র চার বছর পরই টেম্পল ইউনিভার্সিটির চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন তিনি।
তারপরই তিনি ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভেনিয়ায় চাকরি নিয়ে এমআরএনর থেরাপির ওপর কাজ করা শুরু করেন। রক্তনালি প্রতিস্থাপনে এমআরএনএ'র ব্যবহার নিয়ে কাজ করেন।
১৯৯০'র দশকের শুরুতে এমআরএনএ নিয়ে বিজ্ঞানীদের আগ্রহ কমে যেতে থাকে। বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম এমআরএনএ তৈরিতে সক্ষম হলেও, নতুন আরেকটি সমস্যা দেখা দেয়। বিজ্ঞানীরা প্রাণীদেহে এমআরএনএ প্রয়োগ করার পরই রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রদাহজনক প্রতিক্রিয়ায় প্রাণীরা মৃত্যুবরণ করে। একারণেই মানবদেহে পরীক্ষার কথা চিন্তাই করা যায়নি সেসময়।
এটি গুরুতর সমস্যা হলেও এ সমস্যা সমাধানে বদ্ধপরিকর ছিলেন কারিকো। বড়দিন ও নতুন বছরের উৎসবও তিনি গবেষণা করে, বিভিন্ন জায়গায় আবেদন পাঠানোর কাজ করেই কাটাতেন। অনেক বিজ্ঞানীই গবেষণার এ ক্ষেত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভেনিয়ার কর্মকর্তারা তাকে জানান, এমআরএনএ ভিত্তিক অবাস্তব গবেষণা করে তিনি সময় নষ্ট করছেন। এনিয়েই কাজ চালিয়ে যেতে চাইলে তার পদবনতি ও বেতন কমিয়ে দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়।
ঐ একই সময়েই কারিকো ক্যান্সার আক্রান্ত হন, গ্রিন কার্ডের কাজে ও ভিসা জটিলতায় তার স্বামীও ছয় মাসের জন্য হাঙ্গেরিতে আটকা পড়েন। এমন প্রতিকূল অবস্থাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সিদ্ধান্তের কথা জানতে পারেন তিনি।
ক্যান্সারের চিকিৎসা নেয়ার সময়েই তিনি কী করবেন চিন্তা করতে থাকেন। পরবর্তীতে পদবনতি মেনে নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাওয়া সিদ্ধান্ত নেন। এ সিদ্ধান্তই তার নিজের ক্যারিয়ার ও বিজ্ঞানের গতিপথ বদলে দেয় অনেকটাই।
১৯৯৭ সালে বিশিষ্ট ইমিউনোলজিস্ট ড্রিউ ওয়েইজম্যান ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভেনিয়ায় যোগ দেন। সেসময়ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনলাইনে পাওয়া যেত না, জার্নাল থেকে ফটোকপি করে নেয়াই একমাত্র উপায় ছিল।
ড্রিউ ওয়েজম্যান কারিকোর গবেষণায় অর্থায়নের ব্যবস্থা করে দেন ও তারা একত্রে কাজ শুরু করেন। ওয়েজম্যানের সমর্থন ও সহায়তাই সেসময় অনুপ্রেরণা যোগায় কারিকোকে। তার ভাষ্যে, "আমার বেতন তখন একজন টেকনিশিয়ানের চেয়ে কম হওয়া সত্ত্বেও, প্রতিবন্ধকতার চেয়ে আমার সহকর্মীর সমর্থনের দিকেই বেশি মনোযোগ দেই।"
কারিকো ও ওয়েইজম্যান এক পর্যায়ে আবিষ্কার করেন, যে নির্দিষ্ট নিউক্লিওসাইড রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে তা প্রতিস্থাপন করলেই নিরাপদভাবে কাজ করতে সক্ষম এমন এমআরএনএ তৈরি করা সম্ভব। ২০০০ সালের পরই কারিকো দেখতে পান, ইউরিডাইন নামের নিউক্লিওসাইডই এর জন্য দায়ী। দীর্ঘদিন ধরে তিনি এ তথ্যের পেছনেই ছুটছিলেন।
২০০৫ সালে কারিকো ও ওয়েইজম্যান এব্যাপারে তাদের গবেষণা প্রকাশ করেন। তাদের গবেষণায় তারা দেখান বিশেষভাবে তৈরি এমআরএনএ-তে ইউরিডাইনের মতো তৈরি কিন্তু ইউরিডাইনের মতো প্রভাব ফেলবে না এমন কণার ব্যবহারেই সমস্যাটির সমাধান সম্ভব। তারা বিশেষভাবে তৈরি এই এমআরএনএ ইঁদুরের ওপর প্রয়োগ করে দেখতে পান, ইঁদুরগুলো আর মারা যাচ্ছেনা। তারা সে মুহূর্তেই বুঝতে পারেন ভ্যাকসিন গবেষণার ক্ষেত্রে এটি যুগান্তকারী আবিষ্কার।
তারা তখন বিস্তারিত গবেষণাপত্র প্রকাশ করে পেটেন্টের আবেদন করেন ও নিজস্ব কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। দুঃখজনকভাবে তাদের আবিষ্কার সাড়া ফেলেনি।
তবে তাদের অজান্তেই অনেক বিজ্ঞানী তাদের এ গবেষণা দেখে অনুপ্রাণিত হন। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষক ডেরিক রোজি তাদের গবেষণা দেখার পরই অনুপ্রাণিত হন। ২০১০ সালে তিনি এমআইটি ও হার্ভার্ডের একদল গবেষকদের সাথে নিয়ে বায়োটেক কোম্পানি মডার্না প্রতিষ্ঠা করেন। ভ্যাকসিন গবেষণা ও চিকিৎসাক্ষেত্রে এমআরএনএ'র ব্যবহারের ওপর কেন্দ্র করেই মডার্না প্রতিষ্ঠিত হয়।
এর এক দশক পরেই কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন তৈরির দৌড়ে এগিয়ে আছে মডার্না, প্রতিষ্ঠানটির তৈরি ভ্যাকসিনের তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে ভ্যাকসিনের ৯৪ শতাংশ কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে।
তবে শুধু কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের জন্যই এমআরএনএ গবেষণার দিকে ঝুঁকেনি পুরো বিশ্ব। রোজির মডার্না প্রতিষ্ঠার সময়েই কারিকো ও ওয়েইজম্যান তাদের আবিষ্কারে অর্থায়ন পাওয়া শুরু করেন। সেসময়ের ছোট একটি জার্মান প্রতিষ্ঠান বায়োএনটেক তাদের প্রযুক্তির লাইসেন্স দেয়।
তুরস্ক বাংশোদ্ভূত উগুর শাহিনের প্রতিষ্ঠিত বায়োএনটেক এবং মডার্না, দুটি প্রতিষ্ঠানই ক্যান্সারে ইম্যিউনোথেরাপি, বিভিন্ন কার্ডিওভাসকুলার ও বিপাকীয় রোগ নিয়ে গবেষণা শুরু করে। ১৯৭০'র দশকে চিকিৎসা ক্ষেত্রে এমআরএনএ'র ব্যবহারের যে সীমাবদ্ধতা ছিল, কারিকো ও ওয়েজম্যানের আবিষ্কারের পর এক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা দ্বার উন্মোচিত হয়।
বায়োএনটেকের কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন তৈরির কর্ণধার ছিলেন কারিকো। ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভেনিয়া কারিকোকে তার পদে পুনর্বহাল করবে না এমন সিদ্ধান্ত জানানোর পর ২০১৩ সালে বায়োএনটেকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগ দেন তিনি। তিনি যখন তার বায়োএনটেকে যোগদানের খবর জানিয়েছিলেন তাকে বিদ্রুপাত্মক ভাবে বলা হয়েছিল এ প্রতিষ্ঠানের তো নিজস্ব ওয়েবসাইট-ই নেই।
ফাইজার-বায়োএনটেকের তৈরি এমআরএনএ ভ্যাকসিন কিছুদিন আগেই ৯৫ শতাংশ কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে, বিশ্বব্যাপী পরিচিত নাম এখন বায়োএনটেক। ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি ডোজ সরবরাহ করবে প্রতিষ্ঠানটি।
এতো বছরের প্রতিকূলতা ও সংগ্রামের পর অবশেষে তার গবেষণা আলোর মুখ দেখেছে। তার গবেষণার সূত্র ধরেই তৈরি হয়েছে প্রাণঘাতী রোগের ভ্যাকসিন। এমআরএনএ প্রযুক্তিতে তার যুগান্তকারী আবিষ্কার এতো বড় ভূমিকা রেখেছে এব্যাপারটি এখনো বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না তিনি। তার ভাষ্যে,
"আমি সবসময়ই মানুষকে সাহায্য করতে চেয়েছি। এই ইচ্ছাই আমাকে সবসময় আশাবাদী করে তুলেছে, কাজ করে যাওয়া অনুপ্রেরণা দিয়েছে। তবে আমি এতো মানুষকে সাহায্য করতে পারবো তা ভাবিনি। এই সফলতার গল্পের আমিও একটি অংশ এটিই আমার জন্য আনন্দের বিষয়।"
- ওয়্যার্ড থেকে অনুবাদ: রাফিয়া তামান্না