ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট মোকাবিলায় টিকাকরণ এখন আরও গুরুত্বপূর্ণ: রোগ প্রতিরোধ বিশেষজ্ঞ
যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যারোলিনা ইউনিভার্সিটির রোগ-প্রতিরোধ বিদ্যার অধ্যাপক জেনিফার টি. গ্রিলার। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের শক্তিশালী ও অধিক প্রাণঘাতী ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিস্তার রোধে টিকাদানের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন নিজ কর্মক্ষেত্রে সমাদৃত এ বিজ্ঞানী:
আমি একজন রোগ প্রতিরোধ বিশেষজ্ঞ, তাই শ্বাসযন্ত্রে সংক্রমণের প্রভাবকেও নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করে থাকি। সার্স কোভ-২ ভাইরাসের নতুন ও বিপজ্জনক ধরনের আবির্ভাব সহকর্মীদের মতো আমাকেও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
বিজ্ঞানী হিসেবেও নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলোর ক্ষমতা আতঙ্কিত করেছে আমাদের। বিশেষ করে, খুব অল্প সময়ের মধ্যে মারাত্মক সংক্রামক ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ৭০টির বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়ার ঘটনাকে তুচ্ছ করে দেখার সুযোগ নেই।
বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্যখাতে ডেল্টার কারণে বিপর্যয় দেখা দেওয়ায় আমাদের মনে প্রশ্ন জাগছে; এর আগে যারা সার্স কোভ-২ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সেরে উঠেছেন; তাদের মধ্যে কী রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠছে বা টিকাপ্রাপ্তরা কী এর থেকে সুরক্ষিত থাকতে পারছেন? তবে মনে রাখতে হবে, পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুসারে সবার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাও সমানভাবে কাজ করে না।
আলোচিত দুই প্রতিরোধ ব্যবস্থার একটি হচ্ছে প্রাকৃতিক ও দ্বিতীয়টি টিকার মাধ্যমে গড়ে ওঠা সুরক্ষা। এ দুটি ব্যবস্থা কতোটা স্থায়ী হবে বা কতোটা শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়বে সেক্ষেত্রে তারতম্য রয়েছে।
রোগ থেকে সেরে ওঠা সকল বয়সী ও স্বাস্থ্যগত অবস্থার ব্যক্তিদের মধ্যে সমান সুরক্ষা গড়ে ওঠে না, তবে সে তুলনায় টিকাদানের মাধ্যমে প্রায় সকলের মধ্যেই ন্যূনতম একটি প্রতিরোধ তৈরি হয়।
ভাইরাসের নতুন ধরন মোকাবিলার ক্ষেত্রে টিকাদান ও সংক্রমণের মাধ্যমে অর্জিত প্রাকৃতিক সুরক্ষার প্রভেদ আরও বেশি।
চলতি জুলাইয়ের শুরুর দিকে প্রকাশিত দুটি গবেষণা নিবন্ধ সূত্রে জানা যায়, পুরোনো ধরনের তুলনায় কোভিড-১৯ টিকা ভাইরাসের নতুন ধরনগুলোর বিরুদ্ধে অপেক্ষাকৃত কম কার্যকর হলেও- ভালো মানের সুরক্ষা দিতে পারে।
প্রতিষেধকের কল্যাণে শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, সেগুলো কীভাবে ভাইরাসের সঙ্গে লড়াইয়ে যুক্ত হয় তা নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকরা। এরপর উপসংহার টেনেছেন যে, ইতঃপূর্বে আক্রান্ত হয়ে সেরে ওঠারা (টিকা না নেওয়া ও প্রাকৃতিক সুরক্ষা অর্জনকারী জনসংখ্যা) সহজেই নতুন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হচ্ছেন। সে তুলনায় টিকা নেওয়াদের নিরাপদ থাকার হার বেশি।
বিজ্ঞানীরা আরও একবার প্রমাণ করেছেন, কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনগুলোই আমাদের ভাইরাসের নতুন ও পুরনো সব রকমের বংশজের বিরুদ্ধে রক্ষা করতে পারে। ডেল্টার মতো মারাত্মক ধরনের বিরুদ্ধেও কার্যকর অধিকাংশ টিকা।
প্রাকৃতিক সুরক্ষা কেন অর্নিরভরযোগ্য:
জৈবিক স্মৃতির মাধ্যমে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাসের সংক্রমণকে কতটুকু স্মরণ রাখতে পারে- তার ওপর নির্ভর করে প্রাকৃতিক সুরক্ষা। এই স্মৃতি কার্যকর থাকলে শরীর পূর্বে আক্রমণকারী সংক্রমণকে ফের শনাক্ত করা এবং তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সঠিক কৌশল গ্রহণ করতে পারে।
এসব ক্ষেত্রে ভাইরাসের গায়ে যুক্ত হওয়া বাইন্ডিং অ্যান্টিবডি জাতীয় প্রোটিন সংক্রমণ থেকে সুস্থ কোষকে রক্ষা করে। টি সেল নামক স্থায়ী স্মৃতিধারক এভাবে আক্রান্ত কোষকে মেরে অপসারণসহ বাইন্ডিং অ্যান্টিবডিকে পরিচালিত করে। অনাক্রম্যতা অর্জনের এ দুটো ব্যবস্থাই হলো রোগ প্রতিরোধের মূল চাবিকাঠি।
সার্স কোভ-২ ভাইরাস সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে সেরে ওঠা কোনো ব্যক্তির দেহে টি সেল ও অ্যান্টিবডি পুনঃসংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে পারে। যেমন; করোনাভাইরাসের মূল ধরনের বিরুদ্ধে পূর্ব আক্রান্ত ৮৪-৯১ শতাংশের মধ্যে ছয় মাস পর্যন্ত রোগ সুরক্ষা কাজ করতে দেখা গেছে।
তবে প্রধান সমস্যা হলো প্রাকৃতিক সুরক্ষা লাভকারী ৯ শতাংশ জনসংখ্যার মধ্যে পুনঃসংক্রমিত হওয়ার ৩০ দিন পরও পর্যাপ্ত সংখ্যায় টি সেল ও অন্যান্য অ্যান্টিবডির উপস্থিতি মেলেনি।
এভাবে যারা সুরক্ষা পান তাদের সবার বয়স ও শারীরিক সামর্থ্য অনুসারে, রোগ প্রতিরোধের মাত্রা ভিন্ন ভিন্ন হয়। অন্তত পাঁচ শতাংশ মানুষের মধ্যে এটি মাত্র কয়েক মাস স্থায়ী হয়।
অর্থাৎ, শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ না থাকা মানুষের মধ্যে পুনঃসংক্রমণের ঝুঁকি অনেকগুণ বেশি। অনেকে প্রথম সংক্রমণের মাত্র একমাস পরই দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হন, যাদের অনেকেকেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে, আবার অনেকে মারাও গেছেন।
এছাড়া, মূল সমস্যা হলো; মহামারির শুরুর দিকে ছড়ানো ভাইরাসের স্ট্রেইনগুলোর তুলনায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের আক্রমণে পুনঃসংক্রমণের ঝুঁকিও বেশি।
এধরন নিয়ে এক গবেষণায় দেখা গেছে, মূল করোনাভাইরাসে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়া ৮৮ শতাংশের মধ্যে এটিকে প্রতিরোধে অ্যান্টিবডি কাজ করলেও, মাত্র ৫০ শতাংশকে প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া অ্যান্টিবডি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে পারে।
তাছাড়া, ডেল্টায় আক্রান্তদের অনেকে নিজেরা গুরুতর অসুস্থ না হলেও, তাদের মাধ্যমে সংক্রমণ দ্রুত বিস্তার লাভ করে। নতুন ধরনগুলোর এই দিকটিই সবচেয়ে বিপজ্জনক।
#টিকাদানই নির্ভরযোগ্য সুরক্ষার উৎস:
অধিকাংশ কোভিড-১৯ টিকা অ্যান্টিবডি ও টি সেলের প্রতিক্রিয়াকে শক্তিশালী করে তুলতে সক্ষম। প্রতিষেধকের এ প্রতিক্রিয়া প্রাকৃতিক সুরক্ষার চাইতে যেমন শক্তিশালী তেমনই সামঞ্জস্যপূর্ণ।
যেমন; একটি গবেষণায় দেখা গেছে মডার্নার টিকা গ্রহণকারীদের মধ্যে টিকা নেওয়ার ছয় মাস পরও সার্স কোভ-২ প্রতিরোধের অ্যান্টিবডি শতভাগ অটুট থাকছে। এপর্যন্ত অ্যান্টিবডি স্থায়িত্বের যত প্রমাণ পাওয়া গেছে তারমধ্যে এটাই সবচেয়ে বেশি।
আরেকটি গবেষণায় মডার্না ও ফাইজার টিকা গ্রহণকারীদের মধ্যে প্রাকৃতিক সুরক্ষা লাভকারীদের তুলনায় অনেক উচ্চ মাত্রায় অ্যান্টিবডির প্রমাণ মিলেছে।
ইসরায়েলে করা এক গবেষণায় দেখা যায়, জনসংখ্যার মধ্যে নতুন ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি সত্ত্বেও ফাইজার টিকার দুই ডোজ গ্রহণের পর ৯০ শতাংশ সংক্রমণ প্রতিরোধ হয়। আর সংক্রমণ হার কমে যাওয়ার অর্থ কম অসুস্থতা ও ভাইরাস বিস্তারের গতি হ্রাস।
তাই সকলের জন্যেই টিকাগ্রহণ আবশ্যক। মানবজাতির এ সংকটকালে বৈজ্ঞানিক প্রমাণকে দূরে সরিয়ে রাখাও গ্রহণযোগ্য নয়। কোভিড-১৯ রোগ বিস্তার ঠেকাতে বৈশ্বিকভাবে টিকার সুষম ও দ্রুত বণ্টন পারে পৃথিবীকে মহামারি থেকে রক্ষা করতে।
- সূত্র: সায়েন্স অ্যালার্ট