তিনি 'চিরতরে দূরে চলে' গেছেন, কিন্তু তাঁকে আমরা ভুলি নি...
আমি চিরতরে দূরে চলে যাব,
তবু আমারে দেব না ভুলিতে…
বিশ্ববাসী তাঁকে ভুলে যায় নি। ‘বিদ্রোহী’ নজরুল আমাদের স্বত্তার অংশ হয়ে আছেন চিরকাল।
আজ কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৩ তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট, বাংলা ১৩৮৩ সনের ১২ ভাদ্র তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তবু আজ তাঁকে শুধু দুঃখ নিয়ে নয়, স্মরণ করতে চাই একটু অন্যরকম করে। তাঁকে শুধু বিদ্রোহী, যোদ্ধার রূপে নয়, দেখতে চাই অন্য রূপে।
তিনি বিদ্রোহী, তিনি ভয়ানক। কিন্তু তাই বলে তাঁর রসবোধে কিন্তু কোন ঘাটতি নেই। সেই হাস্যরসের পাত্র যেমন উজাড় করে দিয়েছেন সাহিত্য সৃষ্টিতে, তেমনি নিজের দৈনন্দিনের আটপৌরে জীবনেও।
শিশুদের জন্য ‘খাঁদুদাদু’ যেমন তিনি লিখেছেন, তেমনি কারাগারে থাকতে মজা করে লিখেছেন প্যারোডিও।
'খাদু-দাদু' কবিতায় বিকৃত অঙ্গ এবং আজগুবি সব কার্য কারণের অসঙ্গতিতে অপূর্ব সব হাস্য রস পাই আমরা।
'অমা। তোমার বাবার নাকে কে মেরেছে ল্যাং।
খাঁদা নাকে নাচছে ন্যাদা-নাক, ডেঙাডেং ড্যাং।
ওর নাকটাকে কে করলো খাঁদা রাঁদা বুলিয়ে।
চামচিকে ছা বসে যেন নেজুড় ঝুলিয়ে।
বুড়ো গরুর পিঠে যেন শুয়ে কোলা ব্যাং।
অ-মা আমি হেসে মরি, নাক ডেঙাডেং ড্যাং।...
আবার প্যারোডি করেছেন রবীন্দ্রনাথের কবিতার। কি অবাক হয়ে যাচ্ছেন! সত্যিই কিন্তু এমনটা হয়েছে।।।
গল্পটা বলি তাহলে শুনুন। নজরুল তাঁর ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটির জন্য কারাগারে গেছিলেন। ১৯২২ সালের সেপ্টেম্বরে কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় দুর্গাপূজা উপলক্ষে কবিতাটি প্রকাশিত হয় (পরবর্তীকালে কবিতাটি ‘আগমনী’ নামে অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে)। বাইরে বাইরে কবিতাটি দেখতে দূর্গা পূজা আর দেবী দূর্গার আগমনী কবিতা মনে হলেও এর মধ্যে যে বিদ্রোহবাণী প্রচ্ছন্ন ছিল তা ব্রিটিশ সরকারের নজর এড়ায় নি।
এই কবিতা প্রকাশের জন্য কবির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়, ধূমকেতুর অফিস তল্লাশি করা হয়। কবি পালিয়ে যান। পরে নভেম্বরে কুমিল্লায় পুলিশ কবিকে গ্রেপ্তার করে।
১৯২৩ সালে প্রথমে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে এবং পরে হুগলি জেলে পাঠানো হয় তাঁকে।
হুগলি জেলে কবিকে রাজবন্দীর পরিবর্তে সাধারণ বন্দী হিসেবে রাখা হয়। হুগলি জেল সুপার আর্সটন বন্দীদের সাথে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করতেন। তাঁদের চিঠি লেখার কাগজ কলমও জমা নিয়ে নিতেন তিনি। কর্কশকণ্ঠ এই জেল সুপারকে নজরুল নাম দিয়েছিলেন হর্সটোন (Horsetone)।
একসময় তার অত্যাচারের প্রতিবাদে নজরুল জেলে অনশন শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসময় নজরুলকে অনশন ভঙ্গের অনুরোধ করে তারবার্তা পাঠান, তবে সেই বার্তা নজরুলকে দেয়া হয় নি।
হুগলি জেলে থাকার সময় কবি কাজী নজরুল ইসলাম জেল সুপারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের ‘তোমারি গেহে পালিছ স্নেহে’ গানের ব্যঙ্গ-গান রচনা করেন। জেল সুপার এলেই কবি এই গান গেয়ে তাকে অভিনন্দন জানাতেন।
মূল গান:
তোমারি গেহে পালিছ স্নেহে, তুমি ধন্য ধন্য হে।
আমার প্রাণ তোমারি দান, তুমি ধন্য ধন্য হে ॥
পিতার বক্ষে রেখেছ মোরে, জনম দিয়েছ জননীক্রোড়ে,
বেধেছ সখার প্রণয়ডোরে, তুমি ধন্য ধন্য হে ॥
তোমার বিশাল বিপুল ভুবন করেছ আমার নয়নলোভন–
নদী গিরি বন সরসশোভন, তুমি ধন্য ধন্য হে ॥
হৃদয়ে-বাহিরে স্বদেশে-বিদেশে যুগে-যুগান্তে নিমেষে-নিমেষে
জনমে-মরণে শোকে-আনন্দে তুমি ধন্য ধন্য হে ॥
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নজরুল এই গানটির প্যারোডি করলেন -
ব্যঙ্গ গান:
তোমারি জেলে পালিছ ঠেলে, তুমি ধন্য ধন্য হে।
আমারি গান তোমারি ধ্যান, তুমি ধন্য ধন্য হে ॥
রেখেছ সান্ত্রী পাহারা দোরে, আঁধার কক্ষে জামাই আদরে
বেঁধেছ শিকল প্রণয়ডোরে, তুমি ধন্য ধন্য হে ॥
আকাড়া চালের অন্ন লবণ করেছ আমার রসনালোভন–
গুড়ো ডাঁটা ঘাঁটা লপসী শোভন, তুমি ধন্য ধন্য হে ॥
ধর ধর খুড়ো চপেটামুষ্টি খেয়ে গয়া পাবে সোজা সগুষ্টি
ওল ছোলা দেহ ধবল কুষ্টি তুমি ধন্য ধন্য হে ॥
-কাজী নজরুল ইসলাম
হুগলি জেলে কয়েদীদের দিয়ে এক তরকারির বাগান করা হয়েছিল। সেই বাগানের ভালো তরকারিগুলো সব যেত জেল কর্তৃপক্ষের ঘরে। আর শুকনো বুড়ো আর হলুদ রং ধরা সবজিগুলো কয়েদীদের জন্য দেয়া হত। তরকারির খোসা, খুদ আর ধানের কুন মিশিয়ে সিদ্ধ করে কয়েদীদের খাওয়ানো হত। জেলজীবনের এই অপূর্ব ব্যঞ্জনকে ব্যঙ্গ করে কবি ডাকতেন বুড়ো ডাঁটা ঘাঁটা বলে।
এমনকি দৈনন্দিনের ছোটখাটো ঘটনায়ও হাস্য রস মিশিয়ে দিতে রীতিমতো সিদ্ধহস্ত ছিলেন নজরুল।
একদিনের ঘটনা বলি। কাজী নজরুল তখন গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত। একদিন তিনি ওখানে দোতলায় বসে আছেন। এমন সময় এক কমর্চারী এসে বললেন, ‘কাজীদা, ইন্দুদি (সংগীতশিল্পী ইন্দুবালা) আপনাকে নিচে ডাকছেন।’
এ কথা শুনে কবি সকৌতুকে বললেন, ‘আর কত নিচে নামব, ভাই?’
আরেক দিনের কথা। সাহিত্যরসিক গজেন ঘোষের বাড়িতে তখন প্রায়ই তুমুল আড্ডা হতো। সে আড্ডায় কাজী নজরুল ইসলামও শরিক হতেন। একদিন হঠাৎ করে বলা-কওয়া নেই, কবি টেবিলের ওপর থেকে বই, অপ্রয়োজনীয় পুরোনো ময়লা কাগজপত্র সরাতে লাগলেন। তাতে ধুলো উড়তে লাগল। কবির কাণ্ড দেখে ঘোষমশাই বিচলিত হলেন, ‘আরে, করছ কী?’
নজরুল গম্ভীরভাবে বললেন, ‘অহল্যা উদ্ধার করছি।’
‘অহল্যা উদ্ধার?’
‘হ্যাঁ, এর কোমল হৃদয় পাষাণ হয়ে গেছে,’ নজরুল বললেন, ‘এর রিডগুলো পর্যন্ত টিপলে নামে না। এই পাষাণীর মধ্যে প্রাণের সঞ্চার করতেই হবে।’
আসলে টেবিলটি ছিল একটি পিয়ানো।
ভেবে দেখুন, একজন যোদ্ধা (আক্ষরিক অর্থেই - প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লড়েছেন, জীবনভর হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বে পড়ে লড়লেন, জীবন সংগ্রামে তো ছোটবেলা থেকেই লড়ছেন, পুত্র শোক সহ্য করলেন, বাকশক্তি হারিয়ে তবুও লড়েই গেলেন।) অথচ বুকভর্তি তার রসের ফল্গুধারা কেমন বয়ে গেছে চিরকাল।
সেই ফল্গুধারার উৎস সন্ধান করতে ইচ্ছা হয় কখনো কখনো। কিন্তু মনের গভীরতা ছাড়া কি তা পাওয়া যায়? শেষে তাই আবার সেই নজরুলেই ফিরে যেতে হয় আমাদের। নজরুল নিজেই তো নিজেকে খুঁজে গেছেন নিজের ভেতরে।
আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন
খুঁজি তারে আমি আপনায়...