বিদায় '৭১-এর বন্ধু প্রণব মুখার্জি
সময়টা উত্তাল,১৯৭১। পাকিস্তানী সামরিক জান্তার নিপীড়ন থেকে মুক্তির সংগ্রামে লিপ্ত বাংলাদেশ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন রাজবন্দী পাকিস্তানের কারাগারে। আর প্রবাসে বাংলাদেশের পক্ষে গঠিত হয়েছে স্বাধীন বাংলা সরকার।
জওহরলাল নেহেরুর সমসাময়িক রাজনৈতিক- প্রণব মুখার্জি তখনো ইন্দিরা গান্ধীর দলে যোগ দেননি। বাংলা কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন।
প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বাংলাদেশের এই বন্ধুত্বের সূচনা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে। তাঁর আত্মজীবনীমূলক সিরিজের প্রথমটি দ্য ড্রামাটিক ডিকেড: দ্য ইন্দিরা গান্ধী ইয়ারস–এ তিনি একটি পুরো অধ্যায়ই লিখেছেন 'মুক্তিযুদ্ধ: দ্য মেকিং অব বাংলাদেশ' নামে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রণব লিখেছেন, ''১৫ জুন বাজেট অধিবেশন চলাকালে আমি রাজ্যসভায় বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নিই। আমি বলেছিলাম, ভারতের উচিত বাংলাদেশের প্রবাসী মুজিবনগর সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়া। একজন সদস্য জানতে চান, কীভাবে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। উত্তরে আমি জানাই, গণতান্ত্রিক ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমেই এর রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব। রাজনৈতিক সমাধান মানে গণতান্ত্রিক ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে বস্তুগত সহায়তা করা। আমি সংসদকে এটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম যে, বিশ্ব ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনায় হস্তক্ষেপ করার বহু নজির আছে।''
৭১'এর সেই উত্তাল সময়ে ভারতের রাজ্যসভায় তিনিই প্রথম প্রবাসী বাংলাদেশি সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিলেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংসদের ভেতরে ও বাইরে প্রণব কী ভূমিকা রেখেছেন, তা–ও তিনি স্পস্ট করতে এই বইয়ে লিখেন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক সম্পর্কও গড়ে ওঠে এই মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে।
তিনি লিখেছেন, ''সে সময় থেকেই ইন্দিরা গান্ধি আমাকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। ১৯৭১-এর সেপ্টেম্বরে আমাকে প্রথম আন্তঃসংসদীয় ইউনিয়নের বৈঠকে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য মনোনীত করেন। সেই বৈঠকে আমাদের কাজ ছিল প্রতিটি দেশের প্রতিনিধিদের কাছে বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং ভারতের অবস্থান বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা, যাতে তারা যে যার দেশে ফিরে গিয়ে নিজেদের সরকারকে বিষয়টি অবহিত করতে পারেন। হতে পারে এই বৈঠকে আমার ভূমিকার কথা প্রধানমন্ত্রীর কানে পৌঁছেছিল এবং তিনি খুশি হয়েছিলেন। কেননা, এরপর একই দায়িত্ব দিয়ে তিনি আমাকে ইংল্যান্ড ও জার্মানি পাঠান।''
স্বাধীনতা পরবর্তীকালেও বাংলাদেশের সহায়তায় হাত বাড়ান ভারতীয় এ রাজনৈতিক।
২০০৭ সালে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল। এতে অনেক ঘরবাড়ি ও ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায়। সেই ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে প্রণব মুখার্জি লিখেছেন, দুর্যোগের খবর পেয়েই ভারত ওষুধ, তৈরি খাবার, কম্বল, তাঁবু ও বহনযোগ্য বিশুদ্ধ পানিসহ ত্রাণসামগ্রী বাংলাদেশে পাঠায়। বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে ভারত চাল রপ্তানির ওপরও নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।
প্রণব মুখার্জির উদ্যোগেই বাগেরহাটের দুটি উপজেলায় ভারতের পক্ষ থেকে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের জন্য ২ হাজার ৮০০ ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল।
স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের স্বপক্ষে তার একনিষ্ঠ সমর্থনের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৩ সালের ৪ মার্চ তাকে 'বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননায়' ভূষিত করে বাংলাদেশ সরকার। প্রণব তখন ভারতের রাষ্ট্রপতি। বাংলাদেশের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান পদক তুলে দেন প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাতে।
পদক পেয়ে প্রণব বলেন, আজ ১৯৭১ সালের সব স্মৃতি আমার স্মরণে আসছে। বাংলাদেশ যখন তার মুক্তির সংগ্রামে লিপ্ত, আমি তখন ৩৬ বছরের একজন নবীন এমপি ছিলাম মাত্র।
এসময় রাষ্ট্রপতি জিল্লুর বলেন, ''১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বপক্ষে অবস্থান ছিল মানবতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য। আপনার সমর্থন বাঙালি জাতিকে উদ্দীপ্ত করেছে, সাহস যুগিয়েছে।''
রাষ্ট্রপতি আরো বলেন, আপনার সাহায্য আমাদের জাতীয় মুক্তির ইতিহাসে সোনালী অক্ষরে লেখা থাকবে। আর এ দেশের সকল মানুষ আপনার অবদান গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণে রাখবে।
ঐতিহাসিক এ মুহূর্ত উপলক্ষ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক বলয়ে বাঙ্গালির মুক্তির বার্তা পৌঁছে দেওয়ায়- প্রণব মুখার্জির ভূয়সী প্রশংসা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে, আপনাকে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননায় ভূষিত করার সুযোগ পেয়ে আমরা গর্ব অনুভব করছি।
এদিকে আজ সোমবার (৩১ আগস্ট) এক টুইটবার্তায় প্রণব মুখার্জির পুত্র অভিজিৎ মুখার্জি বলেন, 'দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, সামরিক হাসপাতালের চিকিৎসকদের প্রাণপণ প্রচেষ্টা, সারা ভারতের মানুষের প্রার্থনা, দোয়া সত্ত্বেও এইমাত্র আমার বাবা শ্রী প্রণব মুখার্জি মারা গিয়েছেন। আমি আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।'
গত ১০ আগস্ট দিল্লির সেনা হাসপাতালে প্রণব মুখার্জিকে ভর্তি করা হয়েছিল। পরীক্ষার সময় দেখা গিয়েছিল, তার মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। জরুরি ভিত্তিতে অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। তার করোনা রিপোর্টও পজিটিভ এসেছিল।
অস্ত্রোপচারের পর থেকেই ভেন্টিলেশনে ছিলেন তিনি। কখনো কখনো শারীরিক অবস্থার উন্নতির খবর মিললেও কখনো কখনো তার শারীরিক অবস্থা আরও জটিল হয়েছে। মূত্রাশয় সংক্রান্ত সমস্যা এবং ফুসফুসে সংক্রমণও ধরা পড়েছিল তার। কিন্তু যাবতীয় লড়াই শেষে হাসপাতালে ভর্তির ২২ দিনের মাথায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি, উপমহাদেশের বরেণ্য রাজনীতিক, বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এক শোকবার্তায় শেখ হাসিনা বলেন, 'বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন রাজনীতিবিদ ও আমাদের পরম সুহৃদ হিসেবে প্রণব মুখার্জির অনন্য অবদান কখনো বিস্মৃত হবার নয়। আমি সবসময় মুক্তিযুদ্ধে তার অসামান্য অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।'