বুস্টার ডোজ ও ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন
গত শীতে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের তিনটি কোভিড-১৯ টিকার অনুমোদন দেয়, তিনটি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানই প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ফলাফল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
মার্কিন খাদ্য এবং ঔষধ প্রশাসন (এফডিএ) ৫০ শতাংশের বেশি কার্যকারিতা থাকলেই যেকোনো টিকাকে অনুমোদন দিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। কিন্তু মডার্না এবং ফাইজারের টিকাগুলোর ক্লিনিকাল ট্রায়ালে দেখা যায় তারা সংক্রমণের বিরুদ্ধে ৯৫ শতাংশ কার্যকর, এবং গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যুর বিরুদ্ধে প্রায় ১০০ শতাংশ কার্যকর। জনসন এবং জনসনের একক ডোজের কার্যকারিতা ৬৭ শতাংশ হলেও গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যুর বিরুদ্ধে এরাও ১০০ শতাংশ কার্যকর।
কিন্তু এরপরও বিজ্ঞানীরা ভয় পাচ্ছেন, ভাইরাসের নতুন নতুন প্রকরণের সামনে এসব টিকার কার্যকারিতা কমে যাচ্ছে। এছাড়া এসব টিকা কতদিন পর্যন্ত কার্যকর থাকবে, সে ব্যাপারেও সন্দিহান বিজ্ঞানীরা। ইনফ্লুয়েঞ্জাসহ কিছু টিকা যেমন প্রতি বছর নিতে হয়, করোনার টিকাও এই পথে আগাতে পারে বলে ভয় পাচ্ছেন অনেকে। এই আলোচনার মাঝেই ফাইজার ও বায়োএনটেক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ও নতুন ধরনগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করতে তৃতীয় ডোজ নেয়ার প্রস্তাব রেখেছে।
বায়োএনটেকের প্রতিষ্ঠাতা উগার সাহিন এবং ফাইজারের প্রধান নির্বাহী অ্যালবার্ট বোরলা তৃতীয় ডোজের ব্যাপারে তাদের সম্মতি জানানোর পর থেকে গত কয়েক মাসে 'বুস্টার ডোজ' হিসেবে খ্যাত এই বাড়তি ডোজটি নেয়ার জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে আসছে এই দুই প্রতিষ্ঠান। তাদের দাবি, বুস্টার ডোজ ডেল্টা ধরনের বিরুদ্ধে ভালো কাজ করে।
ইসরায়েল এবং হাঙ্গেরির মতো দেশগুলো ইতিমধ্যে উচ্চ-ঝুঁকিতে থাকা রোগীদের বুস্টার ডোজ দেয়া শুরু করে দিয়েছে। জার্মানি, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যও এই পথে হাঁটার কথাই ভাবছে।
তবে সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান বিজ্ঞানী সৌম্য স্বামীনাথন বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ধনী দেশগুলো বুস্টার শটকে অগ্রাধিকার দিলে ভাইরাসের আরও নতুন নতুন প্রকরণ তৈরি হতে পারে। যদিও অন্য বিজ্ঞানীরা বলছেন, এখনই এরকম কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সবকিছু মিলিয়ে বুস্টার ডোজের ব্যাপারে অনেক বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। বুস্টার ডোজের ব্যাপারে মানুষের সবচেয়ে বেশি জিজ্ঞাসিত প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া হল এই প্রতিবেদনে।
কাদের জন্য এই তৃতীয় ডোজ?
যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা মধ্যম থেকে চূড়ান্ত পর্যায়ে কম, আপাতত শুধু তাদেরকেই বুস্টার ডোজ দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। এই তালিকার সিংহভাগই বয়স্ক লোকজন।
অল্প বয়সী ও সুস্থ মানুষের তুলনায় বয়স্কদের দেহে এমনিতেই কম অ্যান্টিবডি থাকে। এছাড়া বিশ্বের সব জায়গাতেই টিকাদান শুরু হয়েছে বয়স্কদের দিয়ে। যে কারণে প্রথম ডোজগুলোর কার্যকারিতাও কমে যাচ্ছে তাদের দেহে।
বুস্টার ডোজ কীভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়?
আপনার শরীর প্রথমে নিজেই সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে। এবং লড়াই করার জন্য তার হাতে বেশ কিছু অস্ত্র আছে। যখন আপনার দেহে প্রথম কোভিড-১৯ এর ভাইরাস প্রবেশ করে, তখন আপনার রোগ প্রতিরোধকারী ব্যবস্থা এর আক্রমণকে সংহত করার চেষ্টা করে, এই ভাইরাসকে মেরে ফেলার জন্য কিছু অনাক্রম্য কোষ তৈরি করে। কিন্তু এতে বেশ সময় লাগে, এবং অনেক ক্ষেত্রে আপনার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ঠিকভাবে সাড়া দেওয়ার আগেই ভাইরাসটি কিছু ক্ষতিসাধন করে ফেলে।
প্রথম ডোজ আপনার দেহে করোনা ভাইরাসে পাওয়া একটি প্রোটিন প্রবেশ করিয়ে দেয়। আপনার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ধরতে পারে এই প্রোটিন বাইরে থেকে এসেছে, এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে। এই প্রোটিনের বিরুদ্ধে কার্যকর অ্যান্টিবডি তৈরি করে আপনার অভ্যন্তরীণ রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রোটিনটিকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। বি এবং টি কোষগুলো সেসব অ্যান্টিবডিকে তৈরি করে থাকে, যারা পরবর্তীতে মূল ভাইরাসের সংস্পর্শে আসলে তাকে নিমিষেই নিষ্ক্রিয় করে দেয়।
কিন্তু আপনি অনেকদিন পর্যন্ত ভাইরাসের সংস্পর্শে না আসলে আপনার দেহ এসব অ্যান্টিবডিকে ছেড়ে দিতে পারে। তবে বি এবং টি কোষগুলো তখনো নতুন অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে।
যখন আপনি টিকার দ্বিতীয় ডোজ নেন, তখন আপনার বি এবং টি কোষগুলো প্রোটিনকে চিনতে পারে এবং পূর্বের চেয়েও দ্রুত ও শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলে। তৃতীয় ডোজের কাজও একই- আপনার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে মনে করিয়ে দেয়া ভাইরাসটি দেখতে কেমন এবং প্রকৃত ভাইরাসের জন্য দেহকে প্রস্তুত রাখা।
কোন ঝুঁকি আছে কি বুস্টার ডোজে?
প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের জন্য যে ঝুঁকি, তৃতীয় ডোজের জন্যও বলতে গেলে একই। টিকা নেয়ার পর জ্বর, মাথা ব্যথা, গায়ে ব্যথার মতো উপসর্গ দেখা যেতে পারে। এর বাইরে, রক্তের জমাট বাঁধা বা অ্যানাফিল্যাকটিক প্রতিক্রিয়ার মতো মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
বয়স্কদের দেয়া শুরু হলেও স্বাস্থ্যকর মানুষের উপর বুস্টার ডোজের কার্যকারিতা ও নিরাপত্তার ব্যাপারগুলো এখনো পর্যালোচনা করেনি ডব্লিউএইচও।
পূর্বে যে টিকা নিয়েছিলাম, বুস্টার ডোজ হিসেবেও সেই টিকাই নিতে হবে?
মার্কিন রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) বর্তমানে তাদের জনগণকে সুপারিশ করছে পূর্বে যে প্রতিষ্ঠানের টিকা নিয়েছে, বুস্টার ডোজ হিসেবেও একই টিকা নিতে। আপনার প্রথম দুই ডোজ যদি ফাইজারের হয়ে থাকে, তাহলে তৃতীয় ডোজটিও তাদের কাছ থেকেই নেয়া উচিত।
যদিও কিছু গবেষণায় অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও ফাইজারের একত্র করে সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়া গেলেও সার্বিকভাবে বিজ্ঞানীরা ফাইজার, মডার্না এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকাগুলো একসাথে কাজ করতে পারে কি না সে ব্যাপারে এখনো সন্দিহান।
যদি আমি জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা নিয়ে থাকি, তাহলে?
সিডিসি এবং এফডিএ জানিয়েছে, জনসন অ্যান্ড জনসনের অতিরিক্ত ডোজ সুপারিশ করার জন্য তাদের কাছে বর্তমানে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত নেই। তবে তারা শীঘ্রই এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্তে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বুস্টার ডোজ নেওয়ার পরেও কি আমি সংক্রমিত হতে পারি?
কোনো টিকাই শতভাগ কার্যকর না। তবে তৃতীয় ডোজে নেয়ার পর আপনার ভাইরাসের সাধারণ ধরনটিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি চলে যায়।
কিন্তু নতুন নতুন প্রকরণের উৎপত্তির কারণে আপনি তৃতীয় ডোজ নেয়ার পরও সংক্রমিত হতে পারেন। তবে সেই সম্ভাবনাও অনেক কম। সংক্রমিত হলেও আপনার গুরুতর অসুস্থতা বা মারা যাওয়ার সম্ভাবনা একদম নেই বললেই চলে।