ব্ল্যাক ফাঙ্গাস কী? কীভাবে এর সংক্রমণ প্রতিরোধ করবেন?
সম্প্রতি বাংলাদেশে কোভিড থেকে সেরে ওঠা রোগীদের ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণের খবরে জনমনে ভীতির সঞ্চার হয়েছে। ভারতের বর্তমান কোভিড পরিস্থিতির মধ্যে আরেক আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস। চলুন, ছত্রাকঘটিত এ রোগটির ব্যাপারে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস কী?
ছত্রাকঘটিত এই সংক্রমণটি ব্ল্যাক ফাঙ্গাস নামেই অধিক পরিচিত হলেও এটি মিউকোরমাইকোসিস নামেও পরিচিত। মিউকোরমাইসেটিস (mucormycetes) নামের এক ধরনের ছত্রাকই মূলত এ সংক্রমণের জন্য দায়ী। ইউএস সেন্টারস অফ ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)'র তথ্যানুযায়ী, ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা মিউকরমাইকোসিস মাটি এবং পচা পাতার মতো ক্ষয়কারী জৈব পদার্থের মধ্যে পাওয়া একটি ছত্রাক। প্রাকৃতিক পরিবেশেই মাটি বা গাছে এই ছত্রাকের বাস, সার বা পচনশীল ফল ও সব্জির মধ্যে যে শ্লেষ্মা থাকে তা থেকেও ছড়াতে পারে এটি। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় বিভিন্ন মাধ্যমে রোগীরা ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হতে পারেন- ওয়ার্ডে বাতাসের আদ্রতা বেশি থাকলে বা ভেন্টিলেশনের মাধ্যমেও পরিবাহিত হতে পারে এটি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কোভিড-১৯ মহামারির সময় গুরুতর অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসায় কিছু ঔষধ ব্যবহারের ফলে উল্লেখযোগ্য হারে রোগীদের রোগ প্রতিরোগ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে, একারণেই হঠাৎ করে রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে।
সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি কাদের?
কোভিড-১৯ আক্রান্ত বা কোভিড থেকে সেরে ওঠা রোগীরা ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে এটি শুধু কোভিডের কারণেই হয় তা নয়। যে কোনো কারণে শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কমে গেলে এটি সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে।
কিডনি বিকল রোগী, বিভিন্ন হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি, লিভার রোগে ভোগা ব্যক্তিও ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। তাছাড়া, অনিয়ন্ত্রিত ডায়বেটিসের রোগী, অঙ্গ প্রতিস্থাপনের রোগী, ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী, অন্তঃসত্ত্বা নারী, চরম অপুষ্টিতে ভোগা রোগী, মাত্রাতিরিক্ত স্টেরয়েডের ব্যবহারকারীরাও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন।
ইউএস সেন্টারস অফ ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)'র তথ্যানুযায়ী, এ রোগে আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুহার ৫৪ শতাংশ। রোগীর স্বাস্থ্য ও আক্রান্তের দেহের কোন অঙ্গে এর সংক্রমণ হয়েছে তার নির্ভর করে রোগের ধরনে ভিন্নতা দেখা যায়।
ভারতের ফরটিস হাসপাতালের হরমোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. বাদ্যাল জানান, যাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা খুবই দুর্বল তাদের ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
তিনি জানান, ভারতের ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা কোভিড-১৯ এর সময় ডায়াবেটিস রোগীদের ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়ার উচ্চ ঝুঁকির ব্যাপারে সতর্ক করে চলেছেন।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস কি সংক্রামক?
রোগটি সংক্রামক নয়, অর্থাৎ এটি একজন মানুষ থেকে আরেকজন মানুষে ছড়ায় না। বাতাসে ভাসমান ছত্রাকের স্পোর মানুষের নাক দিয়ে দেহে প্রবেশ করে সংক্রমিত হয়। এছাড়াও শরীরে কোনো কাটা বা পোড়ার ক্ষত থাকলে ওই ক্ষতস্থান দিয়েও এর সংক্রমণ হয়।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ফার্স্টপোস্টের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিভিন্ন স্থানে অপরিচ্ছন্ন পদ্ধতিতে অক্সিজেন সরবরাহ, অতিরিক্ত স্টেরয়েড ব্যবহার ভারতে রোগটির বিপজ্জনক হারে ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ।
উপসর্গ কী কী?
চোখ ও নাকের চারপাশে ব্যথা, লালচে দাগ, জ্বর, মাথাব্যথা, কাশি, রক্ত আমাশয়, নাক থেকে কালচে তরল পদার্থ ও রক্ত নির্গত হওয়া, মুখের একপাশে ও সাইনাসে ব্যথা, নাকের পাশে কালচে দাগ, দাঁত ব্যথা ও ঘোলা দৃষ্টি- এসব ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণের উল্লেখযোগ্য উপসর্গ।
চিকিৎসা কী? কীভাবে সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়?
হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ভারতের লোক নায়ক জয় প্রকাশ নারায়ণ হাসপাতালের মেডিক্যাল ডিরেক্টর ডা. সুরেশ কুমারের জানান, ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণ থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হলো রোগীদের রক্তের সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা, শুধু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী স্টেরয়েড ব্যবহার করা ও পরিচ্ছন্ন মাস্ক পরিধান করা। ড্রাই অক্সিজেন ব্যবহার না করার পরামর্শও দেন তিনি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য অধ্যাপক পিটার কলিগনন জানান, এই রোগের চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুল, চিকিৎসা পদ্ধতিও বেশ জটিল।
অ্যান্টিফাঙ্গাল ঔষধ ব্যবহার করা হয় এই রোগের চিকিৎসায়, তবে এই ঔষধের ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া রয়েছে।
কলিগনন বলেন, "সংক্রমণের উৎস পরিষ্কার করতে বেশিরভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই সার্জারির প্রয়োজন পড়ে। বেশিরভাগ সময় সাইনাস, নাক ও গলার পেছন দিক এই সংক্রমণের উৎস হতে পারে,"
"সংক্রমিত অঙ্গে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আক্রান্ত ও মৃত কোষ সরিয়ে ফেলতে হয়। মস্তিষ্কের মতো সংবেদনশীল অঙ্গেও অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে," বলেন তিনি।
কাদা-মাটি, শ্যাওলা ও সারের সংস্পর্শে এসে কোনো কাজ করার প্রয়োজন পড়লে জুতা, লম্বা প্যান্ট, বড় হাতার জামা ও গ্লাভস পরে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছে ভারতীয় চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের (আইসিএমআর)।
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ঔষধ সেবন না করার ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। যথাসম্ভব স্যাঁতসেঁতে স্থান এড়িয়ে চলা উচিৎ।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা ও স্টেরয়েডের মতো ঔষধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া- ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণ রোধে এসব মেনে চলতে হবে।