যে দ্বীপে শুধুই চীনারা ভ্রমণ করতে পারে!
পরিষ্কার সামুদ্রিক জল, নরম সৈকত এবং রাজনৈতিক টানাপোড়েনের জন্য পরিচিত প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জ।
মহামারীর কারণে ১১ মাসের স্থগিতাদেশের পর চীনের ক্রুজ জাহাজে ভ্রমণ আবার শুরু হয়েছে, কারণ চীনে এখন করোনা মহামারী ভালোভাবেই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। শুরু হওয়া ক্রুজ ভ্রমণের প্রথম যাত্রাটিই হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বিতর্কিত এলাকার দিকে।
৯ ডিসেম্বর থেকে দুটি চীনা ক্রুজ জাহাজ দক্ষিণ হাইনান প্রদেশের বন্দর শহর সানিয়া থেকে প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জ অভিমুখে যাত্রা করেছে; প্যারাসেলপুঞ্জ চীনাদের কাছে জিশা নামে পরিচিত। দক্ষিণ চীন সাগরের বিতর্কিত এই দ্বীপপুঞ্জকে বেইজিং নিজেদের অঞ্চল হিসেবে দাবী করে আসছে বহুদিন ধরেই।
ভিয়েতনাম এবং ফিলিপাইন সহ ঐ অঞ্চলের আরও ছয়টি দেশও বিশ্বের ব্যস্ততম শিপিং লেন এবং সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদ ভরা এই বিশাল সমুদ্র অঞ্চলের দাবীদার।
এই দাবিদার এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন সরকার এই অঞ্চলে বেশ কিছু কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ করেছে। দ্বীপগুলো সজ্জিত করেছে অত্যাধুনিক সামরিক সজ্জায়।
প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জ দক্ষিণ চীন সাগরের উত্তর-পশ্চিম অংশে, ১৩০টি ছোট প্রবাল দ্বীপ এবং প্রবালপ্রাচীর নিয়ে গঠিত। সিআইএ ফ্যাক্টবুক অনুসারে চীন ১৯৭৪ সাল থেকে এই অঞ্চলের সব দ্বীপ দখল করে রেখেছে।
২০১৩ সাল থেকে এই দ্বীপপুঞ্জে ক্রুজ ভ্রমণ হয়েছে সামান্যই। কিন্তু ২০২০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এই ভ্রমণ বেড়ে গিয়ে প্রতি সপ্তাহে একটি ক্রুজ যাত্রা সম্পন্নের রেকর্ড পাওযা যায়। পরে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে গেলে এই ক্রুজ ভ্রমণও বন্ধ হয়ে যায়।
সাংহাই ভিত্তিক পর্যটন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান টি-আইডেন্টিফায়ার থিঙ্ক ট্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠাতা ঝু মিংকি বলেছেন, চীনারা এতদিন ধরে ভ্রমণ করতে না পারায় ছুটি কাটাতে এই দ্বীপে যেতেই যথেষ্ট আগ্রহী হয়ে উঠেছে। সঙ্গে "চীনের মালদ্বীপ" নামে প্রচারিত বিজ্ঞাপন ও প্রায় অবরুদ্ধ দ্বীপপুঞ্জে বিরল প্রবেশাধিকার গন্তব্য হিসেবে প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জের আবেদন পর্যটকদের কাছে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
"জিশা'র স্বপ্ন"
মালদ্বীপের মতো প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জে রয়েছে পুরোপুরি স্বচ্ছ ফিরোজা পানি এবং সাদা বালির সৈকত, যেখানে তিন রাতের ভ্রমণ আনন্দের জন্য অনেক কিছু দেখার রয়েছে দর্শনার্থীদের।
পর্যটকদের বেশীরভাগই রূপালী চুলের বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক।
চীনা সরকার বিতর্কিত অঞ্চলে, নিজেদের জাহাজের ভ্রমণের অনুমতি দিয়ে সার্বভৌমত্ব প্রদর্শনের আরেকটি উপায় হিসেবে গণ্য করছে।
সিঙ্গাপুরের নানইয়াং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল, নগর পরিকল্পনা এবং সমাজবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক ইয়ান রোয়েন বলেন, এই সফরগুলোকে মূলত অবসর এবং জাতীয় কর্তব্যের মধ্যকার অংশ হিসেবে পরিচালিত এবং বাজারজাত করা হয়।
দুইবার প্যারাসেলসে যাওয়া ৩০ বছর বয়স্ক চীনা নারী ইয়ান হুয়াং বলেন, ক্রুজারের বেশীরভাগেরই বয়স ৫০ বছরের বেশী।
এই ভ্রমণে ক্রুজ থেকে সমুদ্রের বিশালতা দেখা ছাড়াও ভ্রমণকারীরা দেশাত্মবোধক কাহিনীও শুনতে পায়- যা সাধারণত ক্ষমতাসীন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির দৃষ্টিকোণ থেকে বয়ান করা ইতিহাসের সংস্করণ।
জাহাজে কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে সামুদ্রিক জীবন সংরক্ষণ পর্যবেক্ষণ, যোগ ব্যায়াম এবং দলগত অনুশীলনের ক্লাস।
জাহাজ থেকে নামার পর, যাত্রীদের করার মতো কিছুই থাকে না- অথচ চীনের পশ্চিমে অবস্থিত এ দ্বীপপুঞ্জে যেতেও ১৩ ঘণ্টা সময় লাগে।
হুয়াং নামে একজন পর্যটক এই সফরে তার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে এক কাগজে লিখেছেন- এই দ্বীপে পর্যটকরা মাছ ধরার গ্রামে কেনাকাটা, খাওয়া দাওয়া, ছবি তোলা, নান্দনিক দৃশ্য উপভোগ বা সীমানা বেঁধে দেওয়া ছোট অঞ্চলে সাঁতার কাঁটা ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না।
তিনি বলেন অন্যান্য কার্যক্রম যেমন মাছ ধরা, স্নোরকেলিং কিংবা সাঁতার কাঁটা সেখানে ঐচ্ছিক, তবে এগুলোতে অতিরিক্ত ফি দিতে হয়।
জন-চাহিদা
প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জ ভ্রমণের খরচ জনপ্রতি ৪,২৮০ ইউয়ান (৬৬০ মার্কিন ডলার) থেকে ছয় ব্যক্তির কেবিনের জন্য ২৯,৩০০ ইউয়ান (প্রায় ৪,৫০০ মার্কিন ডলার) ।
হুয়াং বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন সামনে প্যারাসেলস সফর বেশি প্রমোদ কেন্দ্রিক এবং কম রাজনৈতিক হয়ে উঠবে।
২০১৯ সালে দুইবার চ্যাঙ্গেল প্রিন্সেস জাহাজে প্যারাসেলসে যাওয়া ইয়ান ওয়াং বলেন, ওখানকার দৃশ্য তাকে বিশুদ্ধতার স্বাদ দিয়েছে। ২৯ বছর বয়সী এই তরুণী বলেছেন যে তার লক্ষ্য ছিল চীনের "সমুদ্রের সবচেয়ে পরিষ্কার পানি" দেখা।
তিনি বলেন, আমি বিশ্রামের জন্য টাকা খরচ করেছি, অতিরিক্ত গুরুত্ব এবং উত্তেজনার জন্য নয়। এই সফরের গুরুতর বিষয় হচ্ছে যারা কেবল ভ্রমণের জন্য আসেন, এই দ্বীপপুঞ্জ তাদের জন্য নয়।
দক্ষিণ চীনা সাগরের পর্যটন এবং চ্যালেঞ্জ
দক্ষিণ চীন সাগরে পর্যটন উন্নয়নের জন্য একটি মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, হাইনান প্রাদেশিক সরকারের লক্ষ্য প্যারাসেল গুলোতে নতুন ক্রুজ রুট চালু করা এবং এই অঞ্চলে যাত্রীবাহী ফ্লাইট এবং প্যাকেজ ট্যুরও চালু করা।
চীন বলেছে দীর্ঘমেয়াদে যখন স্কারবোরো শোল এবং স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জে সুযোগ প্রসারিত হবে, তখন দক্ষিণ চীন সাগর জুড়ে মালদ্বীপের মতো রিসোর্ট নির্মাণ করা হবে। এর চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে এলাকাটিকে "২১ শতকের সামুদ্রিক সিল্ক রোড" হিসেবে গড়ে তোলা- যার মধ্যে রয়েছে একটি তথাকথিত "সামুদ্রিক পর্যটন সহযোগিতা অঞ্চল" এবং একটি " উষ্ণপ্রধান আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক ভ্রমণ গন্তব্য"।
তবে দ্বীপপুঞ্জের অন্যান্য দাবিদারদের বিরোধিতার মাঝে চীনের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা ঝুঁকিহীন নয়।
চীনের প্যারাসেলস ক্রুজ লাইনের প্রতিক্রিয়ায় ভিয়েতনাম ২০১৫ সালে স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জের দুটি দ্বীপ এবং দুটি প্রবালপ্রাচীরে ছয় দিনের ক্রুজ জাহাজ সফর চালু করে (ভিয়েতনামীরা যাকে অভিহিত করে ট্রুয়ং সা বলে), একই সাথে তারা ওই সময়ে "জাতীয় গর্ব এবং নাগরিকদের সচেতনতা পুনরুজ্জীবিত" করার আহ্বান জানায়।
২০১৬ সালে এক বার্ষিক রাজনৈতিক সভায় চীনের রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সানশার তৎকালীন মেয়র জি জিয়াও বলেন, দ্বীপগুলো ছোট। বাস্তুশাস্ত্র ভঙ্গুর। মানুষের পায়ের ছাপ অবশ্যই সেখানকার পরিবেশকে প্রভাবিত করবে।
জিয়াও বলেন, "আপনি মূলত একটি ক্রুজ জাহাজে খেতে পারেন এবং রাত্রীযাপনও করতে পারেন, কাজেই আপনাকে এই দ্বীপে থাকতে হবে না, তাই দ্বীপে আরো সুবিধা নির্মাণের কোন প্রয়োজন নেই।
প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জ লুকানো প্রবালপ্রাচীরে পূর্ণ, যে কারণে বিশাল জাহাজের কুলে ভেড়ানোও কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ।
- সূত্রঃ সিএনএন