চমৎকার বাগান ভেঙে কেন নতুন করে গড়েছিলেন ১৬ শতকের শাসক?
বাগান পরিকল্পনায় একসময় জ্যোতিষশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং আইকনোগ্রাফির ব্যবহার যে গুরুত্বের সঙ্গে প্রয়োগ করা হতো, তার একটি উদাহরণ ভারতের ফারাহ বখশ বাগের গল্প।
ঐতিহ্যগতভাবে মধ্যযুগীয় বাগানগুলো ছিল অভিজাতদের ভোগ বিলাসের কেন্দ্রস্থল। সামাজিক সমাবেশ, বিলাসিতা এবং ধারণা বিনিময়ের স্থান হিসেবেই ইতিহাসে এই বাগানগুলোর বর্ণনা পাওয়া যায়।
সেসময়ের বাগান নকশায় প্রায়ই জ্যোতিষশাস্ত্র, ভূতত্ত্ব, জাদুবিদ্যা এবং সংখ্যাবিদ্যার মতো সংবেদনশীল ধারণার প্রায়োগিক ব্যবহার দেখা যেত। এই বিষয়গুলো এতটাই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হতো, শুধু ত্রিভুজাকৃতির হওয়ার কারণে আহমদনগর [বর্তমান মহারাষ্ট্র] রাজ্যের একটি বিশাল বাগান পুনরায় নির্মাণ করা হয়েছিল।
ভারতীয় উপমহাদেশের ডেক্কান অঞ্চলের প্রথম মুর্তাজা নিজাম শাহের অধীনে রাজসভাসদ ছিলেন নি'মাত খান। তার ওপর একটি বাগান ও ভূগর্ভস্থ খাল নির্মাণের আদেশ অর্পিত হয়। ফারাহ বখশ রাজপ্রাসাদ সংলগ্ন বাগানটির নাম দেওয়া হয় ফারাহ বখশ।
নি'মাত খান অবশ্য নিজাম শাহকে সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। নিজাম শাহ তাকে বাগানের সুপারিনটেনডেন্টের পদ থেকে বরখাস্ত করে সালাবাত খানকে বাগানটির জায়গায় একটি ভবন নির্মাণের নির্দেশ দেন।
কিন্তু একজন শিয়া রাজার একটি চমৎকার বাগানের প্রতি এমন প্রতিক্রিয়ার কারণ কী হতে পারে? ব্যাপারটি বোঝার জন্য দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ: প্রথমত, ভারতীয় এবং পারস্য সংস্কৃতিতে ভবনগুলো বাগানের উদ্ভিদের মতোই অপরিহার্য ছিল।
দ্বিতীয় কারণটি বোঝার জন্য বিজাপুরের আদালতে মুর্তাজার শ্যালক আলী আদিল শাহের শাসনকার্যের দিকে নজর দিতে হবে।
বিজাপুরের শাসক 'নুজোম আল-উলুম' [দ্য স্টার অব দ্য সায়েন্সেস] নামে একটি উল্লেখযোগ্য পুস্তিকা লিখেছিলেন। এই গ্রন্থে মিরিকের [মঙ্গল গ্রহের] ব্যাপারে একটি বিশেষ বর্ণনা ছিল, 'ভবনগুলো ত্রিকোণাকার [মুসাল্লা] ছিল। ভারতীয়, পারস্যিক এবং হেলেনিস্টিক ঐতিহ্যে মঙ্গল গ্রহকে অশুভ বলে বিবেচনা করা হতো। তাই সেই আমলে এটি এমন কোনো আশ্চর্যের বিষয় ছিল না যে, নিজাম শাহ ত্রিকোণ কাঠামো দেখে একটি চমৎকার বাগান ভেঙে ফেলার আদেশ দিয়েছেন!'
জ্যোতিষবিদ্যা মধ্যযুগীয় বাগানে চিরস্থায়ী ভূমিকা রেখেছে। আহমদনগর এবং বিজাপুরই একমাত্র স্থান নয় যেখানে মধ্যযুগীয় নান্দনিকতার সাথে জ্যোতিষশাস্ত্রের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া সম্ভব। জ্যোতিষশাস্ত্র ছাড়াও বাগান নিয়ে এই আলোচনা তখন বাকি সব আলোচনার সাথে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
মৌর্য শাসনামল থেকেই দক্ষিণ এশীয় অভিজাতদের জন্য বাগান একটি উল্লেখযোগ্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা রেখেছে। ক্রেইগ ক্লুনাস ও ডিক্সন হান্টের মতো পণ্ডিতদের মতে প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব ছাড়াও এ বিষয়ে সাহিত্য এবং ভাস্কর্য সম্পর্কিত গবেষণার জায়গা রয়েছে। এর মাধ্যমে বাগানের পৃষ্ঠপোষকতা, নির্মাণ, যত্ন এবং অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মানুষের মনোভাব এবং অনুশীলনের প্রতিনিধিত্বকারী সংস্কৃতির ব্যাপারেও জানা যায়।
ফরাসি ইতিহাসবিদ ও সমালোচক হিপ্পোলাইট তাইনের মতে, সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের উদ্দেশ্য ও মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়। সাহিত্য বা চিত্রকর্ম যেমন সংস্কৃতির ইঙ্গিত বহন করে, তেমনি বাগানও সেসময় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারাবাহক বলে গণ্য হতো।
নি'মাত খানের এই ত্রিভুজ বাগানের কাহিনি শুধু একটি বিশ্লেষণ মাত্র। মধ্যযুগীয় ডেক্কান অঞ্চলে জ্যোতিষ ও জাদুশাস্ত্র কীভাবে বাগানের নকশা এবং চর্চাকে প্রভাবিত করত, তা দেখা যায় এই বিশ্লেষণে।
বাগানের প্রকৃত চর্চা নিয়ে গবেষণা করলে এমন অনেক ক্ষেত্র পুনরায় আবিষ্কার হওয়ার সম্ভাবনা আছে, যার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় পরিক্রমা সম্পর্কেও অনেক অজানা তথ্য জানা যাবে।
- সূত্র: স্ক্রল