৩০ টাকায় বাগানভ্রমণ, নিজে হাতে গাছ থেকে ছিঁড়ে কেনার সুযোগ: দার্জিলিং কমলা চাষে সফল ৪ উদ্যোক্তা
সদিচ্ছা আর চেষ্টা থাকলে যে কোনও স্বপ্নই এক সময় ধরা দেয়। এমনই এক সফলতার গল্প তৈরি করেছেন চার উদ্যোক্তা। দার্জিলিং ও চীনা ম্যান্ডারিন জাতের কমলা শুধু পাহাড়ি অঞ্চলেই চাষ হয়—এটি প্রচলিত ধারণা। কিন্তু গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার সাতখামাইর পশ্চিম পাড়া এলাকায় সমতল ভূমিতে এই দুই জাতের কমলা চাষ করে সফল হয়েছেন তারা।
চার উদ্যোক্তার বাগানে দার্জিলিং ও ম্যান্ডারিন জাতের কমলায় এবারই প্রথম শতভাগ গাছে ফলন এসেছে। পাকা কমলার রং ধরার আগেই আশপাশের মানুষের মধ্যে প্রচুর আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।
বাগানে দার্জিলিং ও চায়না ম্যান্ডারিন কমলার রূপ, রস, আর গন্ধ চারদিকে হইচই ফেলে দিয়েছে। প্রতিদিন অনেক দর্শনার্থী ও ক্রেতা বাগানে ভিড় করছেন। সবুজ বাগানের কমলার গাছে সবুজ পাতার আড়াল ভেঙে ডালে ঝুলে থাকা হলুদ ও সবুজ বর্ণের কমলা দর্শনার্থী ও মালিকদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে।
তারা কমলার সঙ্গে নিজেদের ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এ কারণেই প্রত্যন্ত পল্লী গ্রামের এই কমলার বাগান এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল বাগান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এখন প্রতিদিনই ক্রেতা ও দর্শনার্থীরা আসছেন।
সবাই সুমিষ্ট ও সতেজ রাসায়নিকমুক্ত কমলা পেয়ে খুশি। দর্শনার্থীদের ভিড়ের কারণে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ১০ বছরের ঊর্ধ্বে সবার জন্য ৩০ টাকা মূল্যের প্রবেশ ফি চালু করা হয়েছে। প্রবেশের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত।
জানা গেছে, ২০২১ সালে ১০ বছরের চুক্তিতে প্রায় আট বিঘা জমি ভাড়া নিয়ে বাগানটি তৈরি করেন চারজন কৃষি উদ্যোক্তা। তারা কেউই স্থানীয় বাসিন্দা নন; চারজনই চার জেলার বাসিন্দা। উদ্যোক্তারা হলেন—নেত্রকোনার মো. অলিউল্লাহ বাইজিদ, চট্টগ্রামের মো. ফারুক আহমেদ, নোয়াখালীর আব্দুল মতিন, এবং রংপুরের আইনুল হক।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, শ্রীপুর উপজেলা সদর অথবা মাওনা চৌরাস্তার ওয়াপদা মোড় থেকে টেংরা গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের সামান্য পূর্ব পাশে অবস্থিত কমলার বাগানটি অবস্থিত। এই বাগানটির নাম রাখা হয়েছে 'তাওয়াক্কালনা ফ্রুটস বাগান'। এটি মূলত একটি মিশ্র ফলের বাগান।
এখানে অন্তত ১০ জাতের আম, বলসুন্দরী বরই, সফেদা, জাম্বুরা, ড্রাগনসহ বিভিন্ন দেশি-বিদেশি ফল রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে দার্জিলিং ও চীনা ম্যান্ডারিন জাতের কমলা। চার বছর আগে সারিবদ্ধভাবে বাগানে কমলাগাছ রোপণ করা হয়। গাছগুলোর উচ্চতা ৮ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত।
এবার গাছগুলোতে দ্বিতীয়বারের মতো ফল এসেছে। প্রথমবার ফলন কম হলেও এবার ফলন অনেক ভালো হয়েছে। বাগানে প্রবেশ করতেই গাছের ডালে ঝুলে থাকা সুমিষ্ট ও রসালো হলুদ এবং সবুজ রঙের কমলা নজর কাড়বে। প্রতিটি থোকায় ১০ থেকে ১২টি করে বড় বড় কমলা ঝুলছে।
দেখা গেছে, সারিবদ্ধভাবে দর্শনার্থীরা বাগানে প্রবেশ করছেন এবং ঘুরে ঘুরে দেখছেন। কেউ কেউ নিজ হাতে গাছ থেকে কমলা ছিঁড়ে খাচ্ছেন, আবার কেউ ছবি তুলতে ব্যস্ত। অনেকে ফেসবুকে লাইভ করছেন। কেউ কেউ কমলার স্বাদ পরীক্ষা করে নিজের হাতে ছিঁড়ে নগদ টাকায় কিনে নিচ্ছেন।
নিজেদের পছন্দমতো কমলা সংগ্রহ করতে পেরে সবাই আনন্দিত। আর এটাই বাগানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক। নিজে হাতে কমলা গাছ থেকে ছিঁড়ে কিনতে পারার সুযোগই এই বাগানের প্রচারের মূল ভিত্তি।
এখানে প্রতি কেজি কমলার দাম ৩০০ টাকা। কমলা না কিনলেও ৩০ টাকা প্রবেশ মূল্য দিয়ে যে কেউ বাগান ঘুরে দেখতে পারেন। গাছ থেকে কমলা ছিঁড়ে স্বাদ নেয়ার সুযোগও থাকছে।
বাগানের পরিচর্যাকারী মো. সবুজ মিয়া জানান, চার বছর আগে ঝিনাইদহের একটি নার্সারি থেকে সব মিলিয়ে ১৫০টি কমলার চারা সংগ্রহ করে রোপণ করা হয়। এর মধ্যে দার্জিলিং চারা ১০০টি, বাকি ৫০টি ম্যান্ডারিন জাতের চারা।
'এ বাগান থেকে গত বছর প্রায় ৭০ শতাংশ ফলন পাওয়া যায়। গেল বছর বিক্রির পরেও আমাদের খরচই ওঠেনি। এ বছরই প্রথম প্রতিটি গাছেই প্রচুর পরিমাণে কমলা ধরেছে। দার্জিলিং জাতের প্রতিটি গাছে কমপক্ষে ২০ কেজি পরিমাণ কমলা এসেছে। এবারেও বিক্রি শেষ হলে বলা যাবে খরচ কতটা ওঠবে।'
তিনি আরো জানান, বাগান থেকে এ বছর দার্জিলিং জাতের কমলা গত ১৫ নভেম্বর থেকে বিক্রি শুরু করেছেন। ম্যান্ডারিন জাতের কমলা বিক্রি শুরু হবে আগামী ডিসেম্বর থেকে। বাগান থেকে দার্জিলিং কমলা ৩০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর ম্যান্ডারিন জাতের কমলা ২০০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি দরে কেনা যাবে।
উদ্যোক্তা ওয়ালীউল্লাহ বায়েজীদ বলেন, ব্যবসার সুবাদে চারজনের পরিচয়। পরে কৃষির প্রতি ঝোঁক থেকে তারা উদ্যোগটি নেন। এর আগে ওই চারজনের মধ্যে একমাত্র তিনিই শখের বশে কমলা চাষ করেছিলেন।
ওয়ালীউল্লাহ বায়েজীদ আরো বলেন, আমাদের বাগানে প্রধান ফল কমলা এবং আম। দার্জিলিং এবং চায়না ম্যান্ডারিন কমলা মূলত ভারত ও সিলেটের লাল মাটিতে উৎপাদন হয়। ২০০০ সালে ঝিনাইদহে কমলার উৎপাদন দেখেছি এবং তা থেকেই কমলা চাষে উদ্যোগী হই।
'বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেফিরে দেখি গাজীপুরের লাল মাটিতেও কমলা উৎপাদন সম্ভব। আমাদের চেষ্টা সফল হয়েছে। এখানে রোপণের পর উৎপাদনের প্রথম বছরেই দু-তিনটা কমলা এক কেজি পরিমাণ ওজন হয়েছে। ২০২৩ সালের তুলনায় এবার দার্জিলিং ও ম্যান্ডারিন দুটোই ভালো উৎপাদন হয়েছে,' বলেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, কমলা গাছে ফুল আসা থেকে শুরু করে হার্ভেস্ট করা পর্যন্ত কোনো মেডিসিন প্রয়োগ করতে হয় না। ফুল আসার আগে গাছের সুস্থতার জন্য কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়। দেশের মাটিতে যে কমলা হয়ে থাকে, সেগুলো সুমিষ্ট এবং রসালো হয়।
'আমরা আশা করছি, কোনো একসময় দেশের বাইরে থেকে কমলা আমদানি করতে হবে না। নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, গাজীপুরের ফাঁকা লাল মাটির জমি ফেলে না রেখে কৃষি অফিসের সহায়তায় কমলা উৎপাদন সম্ভব।'
অপর উদ্যোক্তা আব্দুল মতিন বলেন, 'আমরা চার বন্ধু ১০ বছরের চুক্তিতে ৮ বিঘা জমি লিজ নিয়ে বাগান করেছি। ক্রেতাসাধারণকে অরগানিক তরতাজা ফল খাওয়ানোর উদ্দেশ্যেই এই বাগান করা।'
শ্রীপুরের কেওয়া থেকে এসেছেন মাহমুদুল হাসান। তিনি বলেন, বাগান ঘুরে দেখে নিজ হাতে পছন্দ মতো কমলা সংগ্রহ করছি। প্রতি কেজি কমলার মূল্য ৩০০ টাকা। 'নিজের হাতে টাটকা ও সুস্বাদু কমলা কিনতে পেরে ভালো লাগছে।'
কমলার দেখতে ও কমলা ক্রয় করতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসেছেন মনির হোসেন। তিনি বলেন, ফেসবুকে দেখে গাছে থাকা কমলা দেখার শখ হয়েছে।
উৎফুল্ল হয়ে তিনি বলেন, 'এখানে এসে সবার মন খুশিতে ভরে গেছে। বাগানের গেটে ৩০ টাকায় টিকিট সংগ্রহ করে বাগানে ঢুকেছি। বাগান ঘুরে দেখে বিমোহিত হয়েছি। নিজ চোখে না দেখলে অনুভূতি বোঝানো যাবে না।'
শ্রীপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুমাইয়া সুলতানা বন্যা বলেন, ব্যক্তি-উদ্যোগে দার্জিলিং কমলা চাষে চার উদ্যোক্তা আজ সফল। দার্জিলিং কমলার মান খুবই ভালো।
'আমাদের এ আবহাওয়া দার্জিলিং কমলা চাষের উপযোগী হওয়ায় আকার ও রং চমৎকার হয়েছে। তাদের এমন সাফল্য অনন্য কৃষকদের কমলা চাষে আগ্রহী করবে।'
শ্রীপুর উপজেলা কমলা চাষে একটা উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় জায়গা জানিয়ে তিনি বলেন, 'আমদানি-নির্ভরতা কমানোর জন্য অনেক চাষিকে আমরা কমলা চাষে উৎসাহিত করছি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যোগে চাষিদের দার্জিলিং জাতের কমলার চারা সরবরাহ করছি। কৃষি বিভাগের পক্ষে কৃষকদের সব ধরনের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।'