গ্রিনল্যান্ড দখলের হুমকি: ট্রাম্পকে সতর্ক করল জার্মানি ও ফ্রান্স
যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে গ্রিনল্যান্ড নিয়ে হুমকি না দিতে সতর্ক করেছে জার্মানি ও ফ্রান্স। ট্রাম্প সম্প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, ডেনমার্কের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গ্রিনল্যান্ড দখল করতে সামরিক শক্তি ব্যবহার করতে পারেন। খবর বিবিসি'র।
জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস বলেছেন, "সীমান্তের অখণ্ডতার নীতি প্রতিটি দেশের জন্য প্রযোজ্য, সেটা ছোট হোক বা শক্তিশালী।"
ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যঁ-নোয়েল ব্যারো বলেছেন, "ইউরোপীয় ইউনিয়নের সার্বভৌম সীমান্তে অন্য কোনো দেশের আক্রমণ কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না।"
মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) ট্রাম্প পুনরায় গ্রিনল্যান্ড কেনার আগ্রহ প্রকাশ করে বলেছেন, এই আর্কটিক দ্বীপ জাতীয় ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য "গুরুত্বপূর্ণ"।
তবে ডেনমার্ক পরিষ্কারভাবে জানিয়েছে, গ্রিনল্যান্ড বিক্রির জন্য নয় এবং দ্বীপটি তার বাসিন্দাদের সম্পত্তি।
ট্রাম্প এর আগেও গ্রিনল্যান্ড কেনার আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন তিনি প্রথম এই প্রস্তাব দেন।
ডেনমার্ক, জার্মানি এবং ফ্রান্স যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের সদস্য। তবে, গ্রিনল্যান্ড নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে এই দুই দেশের নেতারা কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস বলেছেন, "সীমান্তের অখণ্ডতার নীতি প্রতিটি দেশের জন্য প্রযোজ্য, সেটা পূর্বে হোক বা পশ্চিমে।" তিনি আরও বলেন, "ন্যাটো আমাদের প্রতিরক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার এবং ট্রান্সআটলান্টিক সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু।"
ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যঁ-নোয়েল ব্যারো বুধবার ফ্রান্স ইন্টার রেডিওকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, "আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন যুক্তরাষ্ট্র কি গ্রিনল্যান্ড আক্রমণ করবে, আমার উত্তর হবে না। তবে কি আমরা এমন একটি সময়ে প্রবেশ করেছি যেখানে 'ক্ষমতাবান টিকে থাকবে'-এর নীতি ফিরে আসছে? তাহলে উত্তর হবে হ্যাঁ।"
তিনি আরও বলেন, "তাহলে কি আমাদের ভয় পেয়ে থেমে থাকা উচিত? একেবারেই না। আমাদের জেগে উঠতে হবে, শক্তি বাড়াতে হবে।"
জার্মানি ও ফ্রান্স ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মূল চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত। তবে, ইইউর নিজস্ব কোনো প্রতিরক্ষামূলক সক্ষমতা নেই। অধিকাংশ সদস্য দেশ ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত হলেও সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করা তাদের পক্ষে কঠিন।
ফ্লোরিডার মার-এ-লাগোতে এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন, "গ্রিনল্যান্ড বা পানামা খাল দখলের জন্য সামরিক বা অর্থনৈতিক শক্তি প্রয়োগ থেকে আমি বিরত থাকব, এমন নিশ্চয়তা দিতে পারছি না।" তিনি আরও বলেন, "আমাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য এগুলো প্রয়োজন।"
গ্রিনল্যান্ডে কোল্ড ওয়ার-এর (স্নায়ুযুদ্ধ) সময় থেকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি রাডার ঘাঁটি রয়েছে। ওয়াশিংটনের জন্য দ্বীপটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, দ্বীপটি চীন ও রাশিয়ার জাহাজ পর্যবেক্ষণে সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, "আমি মুক্ত বিশ্ব রক্ষার কথা বলছি।"
ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডরিকসেন ডেনিশ টেলিভিশনে বলেন, "গ্রিনল্যান্ড গ্রিনল্যান্ডবাসীর। তাদেরই ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অধিকার আছে।" তবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন।
গ্রিনল্যান্ডের সংসদ সদস্য কুনো ফেনকার বিবিসিকে বলেছেন, তারা ট্রাম্পের "কিছু সাহসী মন্তব্য" আশা করছিলেন। তবে দ্বীপের "সার্বভৌমত্ব ও আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা আলোচনার বাইরে।"
গ্রিনল্যান্ডের শাসক জোটের সিউমুত দলের সদস্য ফেনকার জানান, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে "গঠনমূলক আলোচনা ও পারস্পরিক লাভজনক অংশীদারিত্ব" তারা স্বাগত জানাবে।
তিনি ডেনমার্ক ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়কে নিয়ে একটি ফ্রি অ্যাসোসিয়েশন গঠনের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেননি। তবে বলেন, "এটি গ্রিনল্যান্ডবাসীর সিদ্ধান্ত। এটি কোনো একক রাজনীতিকের সিদ্ধান্ত নয়।"
গ্রিনল্যান্ডের জনসংখ্যা মাত্র ৫৭ হাজার। দ্বীপটি ব্যাপক স্বায়ত্তশাসন ভোগ করলেও অর্থনীতির ক্ষেত্রে কোপেনহেগেনের ভর্তুকির ওপর নির্ভরশীল এবং এটি এখনো ডেনমার্কের রাজ্যের অংশ। গ্রিনল্যান্ডে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বিরল খনিজের মজুদ রয়েছে, যা ব্যাটারি এবং উচ্চপ্রযুক্তি পণ্যের নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ।
ডেনিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশনের জ্যেষ্ঠ আন্তর্জাতিক প্রতিবেদক স্টেফেন ক্রেটজ বলেন, "ট্রাম্পের সামরিক শক্তি ব্যবহার করে গ্রিনল্যান্ড দখলের ইঙ্গিতে বেশিরভাগ মানুষ 'অবাক' হয়েছেন।"
তিনি আরও বলেন, যদিও অধিকাংশ গ্রিনল্যান্ডবাসী ভবিষ্যতে স্বাধীনতা চায়, তারা স্বীকার করে যে ডেনমার্কের মতোই এমন একজন অংশীদার প্রয়োজন, যে জনসেবা, প্রতিরক্ষা এবং অর্থনৈতিক ভিত্তি নিশ্চিত করতে পারবে। ক্রেটজ বলেন, "আমি এখনো গ্রিনল্যান্ডকে এমন কাউকে পাইনি, যে দ্বীপটির যুক্তরাষ্ট্রের মতো অন্য কোনো শক্তির উপনিবেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখে।"
ক্রেটজ বিবিসিকে বলেন, ডেনিশ সরকার ট্রাম্পের সঙ্গে সংঘাত এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে। তবে "আড়ালে তারা বুঝতে পারছে, এই পরিস্থিতি ডেনমার্কের আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক সংকটে পরিণত হতে পারে।"
মঙ্গলবার ট্রাম্পের ছেলে ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র গ্রিনল্যান্ডে এক দিনের সংক্ষিপ্ত সফরে যান। তিনি এটিকে "ব্যক্তিগত ভ্রমণ" বলে বর্ণনা করেন এবং সেখানে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেন। পরে তিনি একটি সেখানকার একটি বারে স্থানীয়দের সঙ্গে প্রো-ট্রাম্প ক্যাপ পরা অবস্থায় একটি ছবি পোস্ট করেন।