যুদ্ধে কেন কনজিউমার ড্রোন ব্যবহার করছে রাশিয়া, ইউক্রেন?
সামরিক কোনো হার্ডওয়্যার না হলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে দুই দেশই ব্যবহার করেছে সাধারণ কনজিউমার ড্রোন। মে মাসে একজন ক্রেমলিনপন্থী সাংবাদিক টেলিগ্রামে রাশিয়ানদের উদ্দেশ্যে একটি পোস্ট দেন। রাশিয়ানরা যাতে তাদের ব্যক্তিগত ড্রোন সশস্ত্র বাহিনীকে দান করে সেই উদ্দেশ্যেই পোস্ট করেন তিনি।
কিন্তু, সামরিক হার্ডওয়্যার না হওয়া সত্ত্বেও খেলনাসদৃশ এই ডিভাইস যুদ্ধে কেন ব্যবহার করছে দেশগুলো?
কনজিউমার ড্রোন প্রথম জনপ্রিয় করে তোলে প্যারট নামক একটি ফরাসি কোম্পানি। ২০১০ সালে তারা এআর.ড্রোন প্রকাশ করে। ৪০০ গ্রামের একটি কোয়াডকপ্টার ছিল সেটি।
বার্ড আই ভিউ এর ক্যামেরাযুক্ত সেই ড্রোনটি সফল হওয়ার পেছনে একটি বড় কারণ ছিল এর সহজ কার্যকারিতা। ড্রোনটি চালাতে তেমন পাইলটিং স্কিলেরও প্রয়োজন পড়তো না।
এর তিন বছর পর, ২০১৩ সালে চীনা স্টার্টআপ কোম্পানি ডিজেআই এর তৈরি ফ্যান্টম আসে। এরপরই বাজার আমূল বদলে যায়। গোপ্রো ভিডিও ক্যামেরাসহ এই ডিভাইসটি এক কিলোমিটার পরিসরে উড়তে পারে।
ফ্যান্টমই প্রথমবারের মতো জনসাধারণের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে এরিয়াল ফটোগ্রাফির সুযোগ নিয়ে আসে।
তখন থেকেই ডিজেআই কনজিউমার ড্রোন বাজারে আধিপত্য বিস্তার করেছে। কোম্পানির সাম্প্রতিক ড্রোনগুলো কয়েক কিলোমিটারে ওড়ার ক্ষমতা, ভালো ব্রডকাস্ট কোয়ালিটিসম্পন্ন ক্যামেরা এবং অটোমেটিক অবস্টাকল-অ্যাভয়ডেন্স (ওড়ার পথে কোনো বাধা থাকলে নিজ থেকেই সরে যাওয়ার ক্ষমতা)সহ আরো উন্নত ফিচার নিয়ে বাজারে এসেছে।
এসব ফিচারের কারণেই কনজিউমার ড্রোন যুদ্ধে উপযোগী একটি ডিভাইস হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এর আগেও যুদ্ধে এসব ব্যবহার করা হয়েছে। বিশেষ করে ইরাক ও সিরিয়ায় বোমা ফেলার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে এসব ড্রোন। তবে তা বেশ ছোট পরিসরে।
ইউক্রেনের যুদ্ধে ড্রোন আরো বড় ভূমিকা পালন করছে। রাশিয়া যখন ফেব্রুয়ারিতে আক্রমণ শুরু করে তখন ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ড্রোন-মালিকদের কাছে তাদের ডিভাইসের জন্য আবেদন করেন। এখনো কয়েক হাজার ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এসব ড্রোন মূলত আর্টিলারি স্পটার হিসাবে কাজ করে। মাটিতে থাকা একজনের পক্ষে শত্রু এবং সরাসরি গুলি সঠিকভাবে সনাক্ত করা কঠিন। কিন্তু ড্রোন থেকে এটি সহজেই করা সম্ভব।
পাহাড়ের আড়ালে বা কোনো ভবনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা যানবাহন সহজে সনাক্ত করতে পারেন ড্রোনের অপারেটর। আদতে, উপর থেকেই আর্টিলারি রাউন্ড ট্র্যাক করা সহজ।
একজন ইউক্রেনীয় আর্টিলারিম্যান দাবি করেছিলেন, প্রতিটি আর্টিলারি ব্যাটারিতে এখন একটি করে কোয়াডকপ্টার রয়েছে। ইউক্রেনীয় ট্যাংক-হান্টিং দলগুলো কোনো ঝুঁকি ছাড়াই রাশিয়ান যানবাহন খুঁজে পেতে এবং তাড়াতে ড্রোন ব্যবহার করে।
কনজিউমার কোয়াডকপ্টার ট্যাংক-বিরোধী বোমা বহন করার জন্য যথেষ্ট বড় না হলেও এগুলোকে অ্যান্টি-পারসনেল গ্রেনেড ফেলার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ইউক্রেনের পূর্ব ডনবাস অঞ্চলে রাশিয়ান বাহিনীরা বছরের পর বছর ধরে কনজিউমার ড্রোন ব্যবহার করে আসছে। ২০১৯ সালে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ঘোষণা করে, সেনাবাহিনীর প্রতিটি ইউনিটে কোয়াডকপ্টার ইস্যু করা হবে। সেসময় অনেকেই ভেবেছিলেন এসব ড্রোন হয়তো সেনাবাহিনীতেই তৈরি করা হবে।
কিন্তু, ইউক্রেনে কনজিউমার ড্রোন পর্যবেক্ষণকারী এক সূত্রমতে, রাশিয়াও ইউক্রেনের বাহিনীর মতো সাধারণ কনজিউমার ড্রোন ব্যবহার করে আসছে।
তবে কনজিউমার ড্রোনগুলোর কিছু ত্রুটি রয়েছে।
২০১৭ সালে নিজেদের পদাতিক ইউনিটগুলোতে ডিজেআই ড্রোন ইস্যু করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। কিন্তু, নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে বর্তমানে স্থানীয়ভাবে তৈরি কোয়াডকপ্টার দিয়ে সেগুলো প্রতিস্থাপন করছে তারা।
এর একটি প্রধান কারণ হলো ড্রোনগুলোর মাধ্যমে করা যোগাযোগ এনক্রিপ্ট করা হয়নি। তাছাড়া, ড্রোনের নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি চীনা কোম্পানি হওয়াতেও তারা এ পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে অনুমান করা হয়।
যুদ্ধক্ষেত্রে ড্রোন ব্যবহারের একটি বড় কারণ- একে সহজে ট্র্যাক করতে না পারা। কিন্তু ডিজেআই কোম্পানিরই অ্যারোস্কোপ নামে আরেকটি ডিভাইস রয়েছে যার মাধ্যমে এ কোম্পানির তৈরি ড্রোন এবং তাদের অপারেটরদেরকে ৫০ কিলোমিটার বিস্তৃত অঞ্চলে ট্র্যাক করা যেতে পারে। এই ডিভাইসের কারণে ড্রোন ব্যবহারের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়।
ইউক্রেনের ভাইস-প্রাইম মিনিস্টার মিখাইলো ফেদোরভ দাবি করেন, ডিজেআই রাশিয়ান বাহিনীকে অ্যারোস্কোপ ব্যবহার করার অনুমতি দিয়ে তাদেরকে সাহায্য করেছে। যদিও ডিজেআই এই দাবি অস্বীকার করে।
কোম্পানিটি আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের পণ্যের সামরিক ব্যবহারে নিন্দা প্রকাশ করেছে। চলতি বছরের এপ্রিলে তারা ইউক্রেন এবং রাশিয়ায় নতুন করে ড্রোন বিক্রি নিষিদ্ধ করে।
কিন্তু, অন্যান্য কোম্পানি এই সুযোগ হাতছাড়া করেনি। ফরাসি কোম্পানি প্যারট বর্তমানে সামরিক ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য ড্রোন তৈরি করছে।
অন্যদিকে, উৎপাদনে চীনাদের একচেটিয়া অবস্থান নির্মুলের আশায় পেন্টাগনের একটি ইনিশিয়েটিভ আমেরিকান নির্মাতাদেরকে ড্রোন তৈরি করতে উৎসাহিত করে আসছে।
তারা মূলত চাচ্ছে, নিরাপদ যোগাযোগের একটি নির্দিষ্ট মান অনুসরণ করে ড্রোন বানাতে। প্যারট ইতোমধ্যেই সেই মান অনুযায়ী কিছু নতুন ড্রোন তৈরি করেছে, যা ইউক্রেনীয় বাহিনী ব্যবহার করে আসছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে সস্তা, সাধারণ কনজিউমার ড্রোনের ব্যবহার ভবিষ্যতের সংঘাতে নতুন একটি দৃষ্টিভঙ্গি আনতে পারে।
শত্রু বাহিনী কোথায় আছে, কী করছে- তা জানতে পারা বিশাল একটি সুবিধা। আর যদি এত সহজেই তা জানা যায় তাহলে যুদ্ধক্ষেত্রে এর ব্যবহার কেনই বা হবে না!
- সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট