ভয়েস ওভার ছাড়া ফুড ভ্লগিং: স্ট্রিট ফুড হান্টার শামীমের গল্প
রাস্তার পাশে ভ্যান গাড়ির উপর কেউ হামানদিস্তায় পিষছেন কাঁচকলা, তেঁতুল আর পেয়ারা, টোলের উপর কেউ নাগা মরিচের ফুচকা সাজিয়ে বাটিতে ঢালছেন টক, কেউ বা বরফ-দুধে মেশাচ্ছেন তরমুজ, রুহ আফজা। জিভে জল আনা খাবারগুলো পরিবেশন শেষে তৃপ্তি নিয়ে খেয়ে যাচ্ছেন কয়েকজন। তৈজসপত্রের খুটখাট আওয়াজের সাথে শোনা যায় ব্যস্ত রাস্তাঘাট আর খাওয়ার শব্দ। নেই কোনো অতিরঞ্জিত ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বা একঘেঁয়ে বর্ণনা।
"স্ট্রিট ফুড হান্টিং" ফেসবুক পেইজের ৮ লাখ ৭০ হাজার ফলোয়ার আর ইউটিউব চ্যানেলের প্রায় দেড় লাখ সাবস্ক্রাইবার আগ্রহ নিয়ে নিয়মিত দেখছেন এইসব মুহূর্ত। দেশ-বিদেশের ভোজন রসিকদের চোখের খিদে মেটাতে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে মুহূর্তগুলো সংগ্রহ করেন স্ট্রিট ফুড হান্টার শামীম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ শামীম। ২০১৬ সালে এইচএসসি পরীক্ষা শেষেই তার মাথায় ঢুকেছিলো অনলাইনে আয়ের চিন্তা। তার ভাষ্যে, "ততদিনে দেশে প্রায় সবাই ইউটিউবের সাথে পরিচিত। ভাবতাম এখানে এত মানুষ ভিডিও বানায়, আপলোড করে, নিশ্চয়ই তাদের কোনো ইনকাম সোর্স আছে।
কিছুদিন ইউটিইউবের ইনকাম প্রসেস নিয়ে রিসার্চ করে বন্ধুরা মিলে একটা চ্যানেল খুলি। সেখানে ফানি ভিডিওসহ নানা ধরনের কন্টেন্ট শেয়ার করতাম। কিন্তু সেগুলো সবই অন্যের কপিরাইটেড কন্টেন্ট হয়ে যাচ্ছিলো। নিজে নতুন কিছু করার ইচ্ছা ছিলো তাই।"
খাবারের প্রতি অন্যরকম ভালোবাসা তার ছোটবেলা থেকেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ক্যাম্পাসের স্ট্রিটফুড হয়ে যায় রোজকার চাহিদা। দেশের ইউটিউব চ্যানেল খাইদাই ডটকম আর বিশ্বখ্যাত ফুড ভ্লগার মার্ক উইয়েন্সের ভিডিও দেখে আশেপাশের নিত্যদিনের খাবারগুলোর ভিডিও করতে অনুপ্রাণিত হন শামীম।
চার হাজার টাকার ফোনে শুরু
ক্লাসের ফাঁকে বন্ধুদের সাথে হয়তো ঝালমুড়ি বা পানিপুড়ি খেতেন, সেগুলোরই র্যান্ডম ভিডিও করতেন তার চার হাজার টাকা দামের এন্ড্রয়েড ফোনে। সেই ফোন দিয়েই এডিট করে ইউটিউবে আপলোড করতেন ভিডিওগুলো।
"আমি ভালো স্টোরি টেলার না। তাই শুরু থেকেই কোনো ভয়েস ওভার দিতাম না ভিডিওতে। শুধু খাবারটাকে ফোকাস করাই আমার উদ্দেশ্য। কীভাবে খাবারটা বানাচ্ছে, কীভাবে পরিবেশন করছে সেটাই দেখাতে চাইতাম। এএসএমআর ভিডিওগুলো ফলো করতাম আমি," বলেন শামীম।
বাসা থেকে অল্প যা হাতখরচ পেতেন তা দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও আশেপাশের নানা স্ট্রিটফুডের স্বাদ নিতেন। ভিডিওর জন্য তাই কম দামী খাবারই ছিল শামীমের প্রথম পছন্দ।
সফলতার মন্ত্র
শুরু থেকেই শামীম খুব সিরিয়াস ছিলেন তার কাজ নিয়ে। একটা কিছু শুরু করলে সেটা নিয়ে লেগে থাকতে হবে ছেড়ে দেয়া যাবে না-এটাই ছিলো তার লক্ষ্য।
এই স্ট্রিট ফুড হান্টারের ভাষ্যে, "ইউটিউবে সাফল্যের দুইটা মন্ত্র আছে। একটা হলো কোয়ালিটি আরেকটা কোয়ান্টিটি। কোয়ালিটি কন্টেন্ট বানালে আপনি মাসে একটা আপলোড দেন বা সপ্তাহে একটা দেন সেটা ম্যাটার করে না। আমার যে ফোনটা ছিল সেটা দিয়ে তো আর কোয়ালিটি কন্টেন্ট বানানো সম্ভব ছিলো না।
আমি প্রতিদিন র্যান্ডমলি যা যা পাইতাম সব ভিডিও করতাম। ঢাকা মেডিকেলের সামনে সিংগারা বানাইতো, আলুর চপ, বেগুনি বানাইতো সেগুলার ভিডিও করেও আপলোড করতাম। যেখানে যে রাস্তার খাবার পাইতাম সেটার ভিডিও করাই আমার কাজ ছিলো তখন। শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রতিটা দিনই ভিডিও আপলোড করে গেছি আমি। কারণ আমার ফোকাসটা ছিলো কোয়ান্টিটিতে। এরকম ভিডিও করতে করতে হঠাৎ করে টিএসসি-র ২০ টাকার লাঞ্চের ভিডিওতে এক মিলিয়ন ভিউ হয়ে যায়। তখন আমার উৎসাহ আরো বাড়তে থাকে।"
দেশের বাইরে পরিচিতি
শামীমের মতে, ভিডিওগুলোতে কোনো ভয়েস ওভার না থাকায় ইউটিউবের এলগরিদম সেগুলোকে নির্দিষ্ট কোনো দেশের বলে চিহ্নিত করতে পারে না। যে কারণে দেশের বাইরের দর্শকদের কাছে স্ট্রিট ফুড হান্টিং এর ভিডিও পৌঁছে যায় শুরুতেই।
"ইন্দোনেশিয়া, ইন্ডিয়া, আমেরিকা, ইংল্যান্ডের অনেক মানুষ আমার ভিডিওর নিয়মিত দর্শক। টিএসসির লাঞ্চ আর নীলক্ষেতের রয়্যাল তেহারির দুইটা ভিডিও ইন্দোনেশিয়ার মানুষের মধ্যে হুট করেই অনেক জনপ্রিয়তা পায়। চ্যানেলের মনিটাইজেশনের ক্ষেত্রে কোন দেশের দর্শক দেখছে সেটার কিছু প্রভাব আছে।
ইউএস বা অন্যান্য উন্নত দেশের দর্শকদের ভিউ বাড়লে ভিডিওর ইনকামও বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে আমার বেশ সুবিধা হয়েছে," জানান শামীম।
ভিডিওর আয় থেকেই বাড়ি-গাড়ি
চার হাজার টাকা দামের সেই এন্ড্রয়েড ফোন দিয়ে ভিডিও করতে করতেই ইউটিউব থেকে আয় করা শুরু করেন মোহাম্মদ শামীম। বছরখানেক পর বড় বোনের কিনে দেওয়া একটা ১০ হাজার টাকা দামের ফোন হয় তার কাজের সঙ্গী। এরপর ভিডিওর আয় দিয়েই দামী এন্ড্রয়েড, আইফোন, ক্যামেরা, ড্রোন, কম্পিউটারসহ সব শখের জিনিস কেনেন তিনি।
ফেসবুকের ভিডিওতে মনিটাইজেশন শুরু হওয়ার পর ২০২০ সালে ফেসবুক পেইজও খোলেন স্ট্রিট ফুড হান্টিং নামে। এখন ইউটিউবের চেয়ে ফেসবুকেই বেশি আয় হচ্ছে শামীমের।
"অনলাইনের এই আয়টা নিয়মিত না। কোনো কোনো মাসে এক্সপেক্টেশনের চেয়ে অনেক বেশি ইনকাম হয় আবার কোনো মাসে একদম কমও হয়। এপর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ ৪০০ ডলার আর এক মাসে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ডলার আর্ন হয়েছে আমার ভিডিও থেকে।"
নির্দিষ্ট কোনো ভিডিও থেকে এখন পর্যন্ত শামীমের আয় সর্বোচ্চ ৩ হাজার ডলার। নিজের আয়ে ফ্ল্যাট আর গাড়ি কেনার স্বপ্নও পূরণ করেছেন এই বয়সেই। তবে তার কাছে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ইউটিউবের সিলভার প্লে বাটন।
স্ট্রিটফুডের পাশাপাশি এখন বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের খাবারের ভিডিও-ও করেন তিনি। শামীম বলেন, "এই পথে আমাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে আমার বন্ধুরা। যেকোনো উপলক্ষেই তারা বলতো ট্রিট দিতে। সেই ট্রিট দিতে গিয়ে খাবারের নতুন ভিডিও করাও হয়ে যেত।
আর আমি যেহেতু কখনো খাবারের ভালো-মন্দ কোনো রিভিউ দেই না তাই রেস্টুরেন্ট মালিকরাও কোনো আপত্তি করেন না। তবে এখন অনেকেই পেইড রিভিউ বা ভ্লগিং করার অনেক লোভনীয় অফার দেয় আমার ইনবক্সে। আমি সেসবে যাই না কখনো। কারো প্রতি দায়বদ্ধ হতে চাই না আমি।"
লক্ষ্য বিশ্ব ভ্রমণ
স্ট্রিটফুডের সন্ধানে শামীম ঘুরে বেরিয়েছেন দেশের প্রায় প্রতিটি জেলার রাস্তায় রাস্তায়। কিছুদিন আগে ভারত ভ্রমণে গিয়ে সেখানকার নানা খাবার নিয়েও বানিয়েছেন ভিডিও। কলকাতা ভ্রমণের স্মৃতিচারণ করে বলেন,
"বিরিয়ানি খেতে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম। সেখানে হঠাৎ করেই একটা মেয়ে আর ছেলে দৌড়ে এসে বলে 'ভাইয়া আপনি স্ট্রিট ফুড হান্টিং পেইজের শামীম না! আমরা আপনার ভিডিও অনেক দেখি।'
কলকাতার মতো একটা জায়গায় এমন ঘটনায় আমি খুব চমকে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশে এমন অনেকবার হয়েছে। কিন্তু অন্য একটা দেশের এই ঘটনা আমার কাছে অনেক স্মরণীয় হয়ে আছে। আমি তো তেমন কিছু করি না। তবু দেশ-বিদেশের মানুষ আমার প্রতি এই ভালোবাসা দেখায়, এইটা অনেক বড় বিষয়।"
পুরো পৃথিবী ঘুরে খাবারের ভিডিও বানাতে চান শামীম। "ছোটবেলায় থেকেই আমি বলতাম ৯টা-৫টার চাকরি আমি কখনো করবো না। কোনো জায়গায় আবদ্ধ থেকে কাজ করতে পারব না। আমার কাজের মাধ্যমে পৃথিবীকে এক্সপ্লোর করতে চাই আমি," বলেন তিনি।
পাশে পেয়েছেন পরিবারের সদস্য আর শিক্ষকদের
শামীমের সাফল্যে পরিবারের সদস্যরাও খুশি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছ থেকেও পেয়েছেন কাজে এগিয়ে যাওয়ার সাহস। প্রথাগত সরকারি চাকরির পেছনে না ছুটে নিজ উদ্যমে নতুন কিছু করার চেষ্টাকে স্বাগত জানিয়েছেন তার শিক্ষকেরা।
শামীমের এপর্যন্ত বানানো ফুড ভ্লগিং ভিডিওর সংখ্যা সাড়ে তিন হাজারের বেশি। নতুন কেউ পেশা হিসেবে ভিডিও ব্লগিং শুরু করতে চাইলে শামীমের একটাই উপদেশ দিয়ে থাকেন। তা হলো- উদ্যম না হারিয়ে কাজে লেগে থাকতে হবে। শুরুতেই হয়তো খুব ভালো ভিডিও বানাতে পারবেন না কেউ, কিন্তু 'কোয়ান্টিটি'র দিক দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।