মৌলভীবাজারের এক সিএনজি চালক যেভাবে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ২৪ হাজার টাকা আয় করলেন!
"আমি হাসান আহমেদ। আমি সবসময় একজন জনপ্রিয় ইউটিউবার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু আমার পরিবার আর্থিকভাবে সচ্ছল না থাকায় আমাকে সিএনজি চালাতে হয়েছিল।"
মৌলভীবাজারের একটি প্রত্যন্ত গ্রামের ২৪ বছর বয়সী যুবকের কাছে মেসেঞ্জারে তার গল্প শুনতে চাইলে তিনি এই কথাগুলো দিয়েই তার গল্প বলা শুরু করেন।
হাসান একজন উঠতি ভ্লগার যার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব এবং টিকটকে প্রায় ৫৫ হাজার ফলোয়ার রয়েছে। তিনি ইতোমধ্যে শুধু ফেসবুক থেকেই ২৪ হাজার টাকা আয় করতে পেরেছেন।
কিন্তু হাসানের যাত্রা এত সহজ ছিল না।
'তুমি কখনোই একজন ইউটিউবার হতে পারবে না'
হাসান টানা তিন বছর সিএনজি চালানোর পাশাপাশি ছোট ছোট ভিডিও তৈরি করতেন এবং এই সময়ের মধ্যে অন্তত ৬-৭টি ইউটিউব চ্যানেল নিয়ে কাজ করেন। কিন্তু কোনো চ্যানেল থেকেই তিনি কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের দেখা পাচ্ছিলেন না।
হাসান বলেন, "আমি সাফল্য না পাওয়ায় আমার পরিবারের সদস্যরা, আত্মীয়স্বজন এমনকি বন্ধুরা আমাকে এসব বন্ধ করার কথা বলতে থাকেন। তারা বিশ্বাস করেনি যে আমি যা করতে চাই, তা করতে পারব। প্রায় সব ভাবেই তারা আমাকে নিরুৎসাহিত করেন। কিন্তু আমি হাল ছেড়ে দেইনি।"
তিনি আরো বলেন, "একদিন আমার বাবা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। সেই দিনটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ দিন। আমি সেদিন অনেক কেঁদেছিলাম।"
হাসান তার স্বপ্নপূরণ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন এবং হাল ছেড়ে দেয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না তার। তিনি সিএনজি চালানোর পাশাপাশি মোটিভেশনাল ভিডিও তৈরি করতে থাকেন।
"কান্না থেকে আমি আমার স্বপ্ন নিয়ে আরো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হই। আমি ভিডিও তৈরি করার ব্যাপারে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিলাম, এমনকি আমার পরিবার থেকে আমাকে বের করে দিলেও। এবং তারপরেই আমার মাথায় নতুন বুদ্ধি আসে।"
নিজের সংগ্রামকেই কন্টেন্টে রূপান্তর করেন হাসান
যেহেতু হাসান আগে থেকেই সংগ্রাম করছিলেন, তাই তিনি সেই সংগ্রামকেই কন্টেন্টের বিষয়বস্তুতে পরিণত করার কথা ভেবেছিলেন। এই নিয়ে কন্টেন্ট বানিয়ে প্রথমবারের মতো তিনি সাড়া পেতে শুরু করেন।
সময়টা ছিল ২০২৩ সালের নভেম্বর মাস।
তিনি বলেন, "আমি সিএনজি চালানোর সময় ভ্লগ বানানো শুরু করি। তাই এতে আমার অতিরিক্ত সময় ব্যয় করার দরকার ছিল না। আমি আমার পরিবারকে জানাতে পারিনি যে আমি এখনও ভিডিও তৈরি করছি। তাই আমাকে ভয়েসওভারটি গোপনে রেকর্ড করতে হয়েছিল।"
হাসান বলেন, "আমার ভিডিওতে মাত্র ২০০ থেকে ৪০০ ভিউ পাওয়ার পাশাপাশি অনেকেই নেতিবাচক মন্তব্য করতেন। কিন্তু আমি হঠাৎ করে টিকটকে গড়ে এক থেকে তিন লাখ ভিউ পাওয়া শুরু করি।"
প্রথমে এক হাজার ফলোয়ার পেতে তার প্রায় দুই থেকে তিন মাস সময় লেগেছিল। কিন্তু তারপর দ্রুতই তার ফলোয়ার সংখ্যা বাড়তে থাকে। টিকটকে তার কন্টেন্ট দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং ফলোয়াররা তাকে ফেসবুকে এবং ইউটিউব রিলস-এ নিয়মিত দেখতে পান।
হাসান আহমেদ এখন পর্যন্ত মার্চ ও এপ্রিল মাসে ফেসবুকের দুটি পেচেক থেকে ২৪ হাজার টাকা আয় করেছেন।
সিএনজি চালিয়ে প্রতি মাসে প্রায় ২০ হাজার টাকা আয় করার পাশাপাশি কন্টেন্ট থেকে প্রাপ্ত টাকা হাসানকে অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা সচ্ছল করেছে।
সিএনজির আয় থেকে কেনা সেটআপ
ভ্লগ তৈরির জন্য হাসান খুবই সহজ সেটআপ ব্যবহার করেন। তার কাছে একটি স্মার্টফোন, একটি ল্যাপটপ, একটি ট্রাইপড, একটি সবুজ পর্দা এবং একটি বয়া এম১ মাইক্রোফোন আছে।
৫০ হাজার টাকায় একটি ল্যাপটপ কিনতে তার প্রায় এক বছর লেগেছিল। শুরুতে তিনি ইনফিনিক্স ব্রান্ডের একটি ১০ হাজার টাকার স্মার্টফোন ব্যবহার করে তার ভিডিও রেকর্ড করতেন।
এই ল্যাপটপটি ছিল তার প্রথম বিনিয়োগ। দ্বিতীয় বিনিয়োগ তিনি করেছিলেন একটি নতুন স্মার্টফোনের ওপর যা তার জন্য অনেকটা উপহারের মতো ছিল। কিন্তু এজন্য তার ভালো পরিমাণ টাকা খরচ করতে হয়েছে।
হাসান বলেন, "আমার এক মামা বিদেশে থাকেন। আমি প্রায়ই আমার মাকে আমার মামার মাধ্যমে একটি ফোন আনানোর জন্য অনুরোধ করতাম। আমি কথা দিয়েছিলাম, আমার সিএনজি চালানোর আয় থেকে অল্প করে ফোনের টাকা ফেরত দিয়ে দেব।"
পুরো টাকা ফেরত দিয়েছেন কিনা প্রশ্ন করা হলে তিনি জানিয়েছেন, তিনি কিছু টাকা ফেরত দিয়েছেন। কিন্তু তিনি কত টাকা দিয়েছেন তা খেয়াল নেই।
হাসান বলেন, "আমি আগেই বলেছিলাম যে আমি আমার পরিবারের কাছ থেকে কোনও সমর্থন পাইনি। কিন্তু এখন আমি কিছুটা সমর্থন পেয়েছি। এই স্যামসাং এ৫২ স্মার্টফোনটি আমাকে দুর্দান্তভাবে সাহায্য করেছেন। আমি নিজে এটা কিনতে পারতাম না।"
ফেসবুক থেকে প্রথম উপার্জন তুলে দেন মায়ের হাতে
হাসান ফেসবুক থেকে আয় করা দুই মাসের পেচেকের টাকা মায়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, "মা খুব খুশি হয়েছিলেন। তারা এই টাকায় আমাদের ঘর মেরামত করেন। আমরা একটা পারটেক্স সিলিং বসিয়েছি এবং আমি একটা কুলার (শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র) কিনেছি।"
হাসান জানিয়েছেন, তার পরিবার এখন তার স্বপ্নকে এখন আগের থেকে আরো বেশী সম্মান করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তার এক ফলোয়ার তাকে ইনস্টাগ্রামে উপহার হিসেবে ১১ হাজার টাকা পাঠিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, "আমার অনেক ফলোয়ার আমাকে বিদেশ থেকে উপহার পাঠাতে চায়। আমি সাধারণত তা নেই না। কিন্তু তিনি খুব জেদি ছিলেন।"
হাসান এখন খুশি। পরবর্তী পেচেক পাওয়ার পর হাসান তার বাবা-মায়ের ঘর থেকে শুরু করে তার বাড়ির বাকি ঘরগুলো নতুন ভাবে সাজানোর পরিকল্পনা করছেন।
লুকিয়ে তাকে আর ভিডিও বানাতে হচ্ছে না এবং তার পরিবার তার কাজের প্রতি সম্মান দেখানো শুরু করেছে, হাসানের কাছে এর থেকে আনন্দের আর কিছু নেই।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়