স্পেইসএক্স-এর অস্তিত্বহীন চীনা প্রকৌশলীরা
মাই লিনঝেং-এর লিংকডইন প্রোফাইল দেখলে যে কেউ মুগ্ধ হয়ে যাবেন। প্রোফাইলের তথ্য অনুযায়ী তিনি চীনের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। এরপর সেমিকন্ডাকটর বিষয়ে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। আগে একটি মহাকাশ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে কাজ করার পর ২০১৩ সালে স্পেইসএক্স-এ কাজ শুরু করেন তিনি।
প্রোফাইলে দেওয়া এসব তথ্যে চোখ বুলিয়ে মনে হবে মাই বুঝি বড়মাপের একজন প্রকৌশলী। কিন্তু একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, বেশকিছু জায়গায় অনেক ঘাপলা আছে।
যেমন, নিজের প্রোফাইলে সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ইংরেজির বদলে চীনা ভাষায় লিখেছেন মাই। প্রোফাইল ছবির সঙ্গে তার বয়সের সম্পর্কটাও অনেক কষ্টে মেলাতে হয়। একটু খুঁজতেই দেখা গেল, ওই ছবিটা আসলে কোরিয়ান একজন ইনফ্লুয়েন্সারের ইনস্টাগ্রাম থেকে চুরি করা। সোজা কথায়, মাই তার লিংকডইনে যেসব তথ্য লিখেছেন, তার কোনোটিই সঠিক নয়।
পেশাদার মানুষদের জন্য তৈরি করা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম লিংকডইনে সাধারণ ব্যবহারকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করার জন্য এরকম কয়েক লাখ ভুয়া অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। আর এগুলোর লক্ষ্য সারাবিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা চীনা নাগরিকেরা।
এ ধরনের প্রতারকেরা নিজেদের প্রোফাইলে বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখার তথ্য দিয়ে রাখেন। মানুষ এগুলো দেখে তাদের বিশ্বাস করে তাদের অ্যাকাইন্টগুলো নিজেদের প্রোফাইলে কানেক্ট করেন। এরপর টার্গেট ব্যবহারকারীর সঙ্গে একটি সুসম্পর্ক গড়ে এক সময় তাদেরকে অর্থনৈতিক ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করেন এ প্রতারকের দল।
এখন পর্যন্ত এ ধরনের প্রতারকদের পাল্লায় পড়ে ভুক্তভোগীরা কয়েক মিলিয়ন ডলার খুইয়েছেন। এ বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই জানিয়েছে, তারা এ ধরনের প্রতারণার বিষয়ে তদন্ত শুরু করবে। তবে একবার এভাবে অর্থ হারালে তা ফেরত পাওয়া ভীষণ কঠিন।
'এ প্রতারকেরা নিত্যনতুন কৌশল বের করছে প্রতারণার জন্য। তারা মাঠে নামার আগে পর্যাপ্ত হোমওয়ার্ক করে, তাদের লক্ষ্য-কৌশল সুনির্দিষ্ট করে, এবং কী কী পদ্ধতি ও টুল ব্যবহার করে প্রতারণা করবে তা ঠিক করে,' গত জুন মাসে মার্কিন গণমাধ্যম সিএনবিসিকে জানিয়েছিলেন শন রাগান নামক এফবিআই'র একজন স্পেশাল এজেন্ট। তিনি এ অপরাধগুলোকে 'যথেষ্ট হুমকিজনক' হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
স্পেইসএক্সের কর্মী'র কানেকশনের আবেদন
লিংকডইনে একটি অ্যাকাউন্টের সঙ্গে আরেকটি অ্যাকাউন্টের যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়াটি 'কানেক্ট' হওয়া নামে পরিচিত। একজনের প্রোফাইলে থাকা তথ্যের ওপর নির্ভর করে তিনি সমগোত্রীয় বা একই ধরনের কাজ করা ব্যক্তিদের সঙ্গে কানেক্টেড হতে পারেন।
গত জুলাই মাসে, চীনের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা করে স্পেইসএক্সে কাজ করার তথ্য উল্লেখ থাকা ভুয়া লিংকডইন অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ১০০০ ছাড়িয়েছিল। এ অ্যাকাউন্টগুলো মূলত তৈরি করা হয় গণহারে। অনকে সময় এ প্রোফাইলগুলোতে কানেকশনের সংখ্যা অবিশ্বাস্যরকমের কম হয়। আর এগুলোতে থাকা ছবিগুলোও সবসময় সুদর্শন নারী-পুরুষদের হয়।
প্রতারণার একটি পদ্ধতি হলো 'পিগ-বুচারিং স্ক্যামস'। ২০১৭ সালে চীনে এটির সূচনা হয়েছিল। এ পদ্ধতিতে প্রতারক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ডেটিং সাইটে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খোলার পর কারও সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ায়। এরপর ব্যক্তিকে তার সব সম্পদ ওই প্রতারকের কাছে স্থানান্তর করার জন্য প্ররোচিত করে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন এ ধরনের প্রতারকদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার পর তারা চীনের বাইরে চীনা বংশোদ্ভূত বা মান্দারিন জানা মানুষদেরকে তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। এরকম প্রতারণার শিকার হওয়া একজন ব্যক্তি ২০২১ সালে গ্লোবাল অ্যান্টি-স্ক্যাম অর্গ (জিএএসও) নামক একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এ প্রতিষ্ঠানটি প্রতারক ও তাদের সন্ধানে কাজ করে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির ৭০ জনের মতো স্বেচ্ছাসেবী আছে।
জিএএসও-এর মুখপাত্র গ্রেস ইউয়েন বলেন, 'ডেটিং সাইটের চেয়ে লিংকডইনে প্রতারণা করার সুবিধা হলো এখানে ব্যবহারকারী সম্পর্কে তুলনামূলক বেশি ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় যেগুলো তাদের প্রতারণায় কার্যকরীভাবে কাজে লাগাতে পারে প্রতারকেরা। এমনকি ব্যক্তির কাজ বা চাকরি দেখেও প্রতারক তার টার্গেটের আর্থিক অবস্থা নিয়ে ধারণা পেয়ে যায়।'
ক্রিপটো নিয়ে আলাপে আগ্রহী লিংকডইন বন্ধু
অনেকসময় প্রতারণাকারী কোনো ব্যক্তির সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের পর যোগাযোগের মাধ্যম পরিবর্তন করে ফেলে। যেমন লিংকডইনের পরিবর্তে তারা ইনস্টাগ্রাম বা হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদি মাধ্যম ব্যবহার করতে শুরু করে।
এভাবে আলাপ দীর্ঘায়িত করে বিশ্বাস অর্জন করার পর বিভিন্ন ব্যবসায়িক সম্ভাবনা বিষয়ে জানাতে থাকে প্রতারক। বর্তমানে 'ক্রিপটোকারেন্সি' একটি জনপ্রিয় ব্যবসায়িক ধারণায় পরিণত হয়েছে। অনেক প্রতারকই তার টার্গেট ব্যক্তিকে ক্রিপটোকারেন্সি দিয়ে কীভাবে সহজে আয় করা যায়, সে বিষয়ে তথ্য ও পরামর্শ দেওয়া শুরু করে।
দেখা যায়, ব্যবহারকারীকে ক্রিপটোকারেন্সিতে বিনিয়োগ করার জন্য রাজি করিয়ে ফেলে প্রতারক। বিনিয়োগের পর প্রাথমিকভাবে নিজের লভ্যাংশ ডিজিটাল ওয়ালেটের মাধ্যমে সহজে তুলতে পারেন ব্যক্তি। এর ফলে তার বিশ্বাস আরও গাঢ় হয়। তিনি বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করেন।
তারপর একদিন অর্থ তুলতে গিয়ে তিনি আর তা তুলতে পারেন না। কারণ, তিনি যে প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ করেছেন তা আসলে ভুয়া। তার মতো আরও অনেক ভুক্তভোগীকে এ ধরনের ফাঁদে ফেলার জন্য এটি তৈরি করেছে প্রতারকচক্র। এরকম প্রতারণার ভুক্তভোগী মিলিয়ন ডলারের বেশিও হারাতে পারেন।
এ ধরনের প্রতারণায় ক্রিপটোকারেন্সির ফাঁদ তুলনামূলক নতুন। কারণ সচরাচর এসব ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে ভুয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ স্থানান্তর, জুয়া খেলার আহ্বান, বিভিন্ন সম্ভাবনাময় সম্পদে বিনিয়োগ ইত্যাদি কাজ করতে বলে প্রতারক।
একটি বৈশ্বিক সমস্যা
'পিগ-বুচারিং স্ক্যাম' চীনে শুরু হলেও ক্রমে এটি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।
চীনের সরকারের বিষয়টি নিয়ে কঠোর হওয়ায় অপরাধীরা কম্বোডিয়া, মায়ানমার, লাওস, ও অন্যান্য দক্ষিণ-এশীয় দেশগুলোতে ঝুঁকে পড়েছে। এশিয়ার মান্দারিনভাষী সম্প্রদায়গুলো থেকে অনেকসময় কর্মসন্ধানী মানুষদের মিথ্যা কাজের লোভ দেখিয়ে পরে এ ধরনের প্রতারণার কাজ করতে বাধ্য করে এ চক্রগুলো।
বৈশ্বিক পরিমণ্ডল থেকে এ প্রতারণাগুলো পরিচালনা করা হয় বলে এ প্রতারকদের আটক করা কঠিন হয় পড়ে। তবে জিএএসও বর্তমানে মার্কিন এফবিআই ও সিক্রেট সার্ভিসের সঙ্গে একত্রে বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে যাতে দক্ষিণ-এশিয়ার দেশগুলোর সরকারের সহায়তায় প্রতারকদের খুঁজে বের করা যায়।
জুন মাসে প্রকাশিত এক রিপোর্টে লিংকডইন জানিয়েছিল, কোনো ব্যবহারকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করে ওঠার আগেই ৯৬ শতাংশ ভুয়া অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত করতে পেরেছে প্ল্যাটফর্মটি।
গত বছরের শেষের দিকে এ ধরনের ভুয়া অ্যাকাউন্টগুলো তিন-চার দিনও টিকে থাকতে পারত, যেখানে বর্তমানে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এগুলোকে সরিয়ে দিতে পারছে লিংকডইন।
সূত্র: এমআইটি টেকনোলজি রিভিউ