কলেজ পর্যায়ের অংক কষে দিতে পারবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন মেশিন
দীর্ঘ সময় ধরে কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে কঠিন গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাতে বিশেষ সাফল্য দেখেননি তারা। ওই মেশিনগুলো হাই স্কুল পর্যায়ের অংক কষতে পারলেও তা দিয়ে পরীক্ষায় পাস করা যেত না।
এমন পরিস্থিতি দেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অভ টেকনোলজি (এমআইটি)'র একজন লেকচারার ইড্ডো ড্রোরি ও তার সহকর্মীরা একটি মেশিন লার্নিং মডেল তৈরি করার চেষ্টা করেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এ মডেল যেন এমআইটি ও কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারগ্র্যাজুয়েট গণিত কোর্সের ক্যালকুলাস, ডিফারেনসিয়াল ইকুয়েশন, লিনিয়ার আলজেব্রার অঙ্কগুলো করতে পারে।
গত মাসে ড্রোরি ও তার দল মানুষের মস্তিষ্কের গঠন ও কাজের ওপর ভিত্তি করে একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) অ্যালগরিদম তৈরি করেছেন। আর এ অ্যালগরিদমটি মানুষের মতো কলেজ পর্যায়ের অঙ্কগুলো করতে সক্ষম, তাও কয়েক সেকেন্ডে। গত মাসে তারা তাদের গবেষণার ফলাফল প্রসিডিংস অভ দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অভ সায়েন্সেস জার্নালে প্রকাশ করেছেন।
তাদের এ মডেলটি যেমন অঙ্কের উত্তরগুলো ব্যাখ্যা করতে পারে, তেমনি এটি নতুন নতুন গাণিতিক সমস্যাও তৈরি করতে পারে। আর এ সমস্যাগুলো মানুষের তৈরি করা অনুশীলনীর চেয়ে ভিন্ন বলেই জানিয়েছেন অ্যালগরিদমটি ব্যবহার করা শিক্ষার্থীরা।
এ অ্যালগরিদমটি ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এখন চাইলে তাদের কোর্সের জন্য নতুন কনটেন্ট তৈরি করতে পারবেন, মূল্যায়নে অটোমেশন আনতে পারবেন, ও বড় ধরনের অনলাইন কোর্স পরিচালনা করতে পারবেন। এছাড়া এটি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা কঠিন অঙ্কের সমাধানগুলো বুঝতে পারবে। তাদের আর ক্লাসে শিক্ষকের মুখ চেয়ে বসে থাকতে হবে না।
তবে কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এ অ্যালগরিদম গাণিতিক সমস্যার যে ব্যাখ্যা দিতে পারবে, তা মানুষের ব্যাখ্যার সমপর্যায়ের হবে না। এছাড়া এতে করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতারণা করার প্রবণতা বাড়ারও আশঙ্কা করেছেন তারা।
'আমাদের এ অ্যালগরিদমটি এমআইটি'র কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগ থেকে পাস করবে। এটার কোনো আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি থাকবে না, কিন্তু কোর্স সম্পন্ন করে পরীক্ষায় পাস করবে এটি,' বলেন ড্রোরি।
এ ধরনের নিউরাল নেটওয়ার্ক এআই অ্যালগরিদমগুলোকে আগে বড় ডেটাসেটে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এসব ডেটাসেট যত বড় হয়, অ্যালগরিদম তত ভালো শিখতে পারে। ডেটাসেটের প্রশিক্ষণের পর নিজে নতুন উদাহরণ তৈরি করে অ্যালগরিদম। এভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের চেহারার আসল প্রতিরূপও তৈরি করতে পারে। কিন্তু গণিতের ক্ষেত্রে অনুমানের চেয়ে নির্ভুলতার বেশি প্রয়োজন হয়।
গিটহাবে ওপেন সোর্স হিসেবে এ অ্যালগরিদমটি পাওয়া যাচ্ছে বর্তমানে। যেকোনো শিক্ষক চাইলে তার শিক্ষার্থীদের জন্য এটি ব্যবহার করতে পারেন।
'এ বস্তু আরও আগে তৈরি করা হয়নি ভেবে অবাক লাগছে। কারণ আন্ডারগ্র্যাজুয়েট গণিতের কোর্সগুলো একপ্রকার ক্লোজড সিস্টেম,' বলেন শিপেনসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্কের অধ্যাপক ডোগ এনসলে।
তবে অনেক বিশেষজ্ঞ এ ধরনের নিউরাল নেটওয়ার্কেও সীমাবদ্ধতা দেখতে পান। কেউ কেউ মনে করেন এ অ্যালগরিদম গণিত সমাধানের যে ব্যাখ্যা দেয় তা কেবল সমাধানের বিভিন্ন ধাপের উচ্চ পর্যায়ের সারাংশ। এতে পুরো প্রক্রিয়ার গভীর অনুধাবন জানা যায় না, ওই সমস্যাটির সঙ্গে জড়িত গাণিতিক ধারণাগুলোরও কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয়টির সেন্টার ফর মাইন্ড, ব্রেইন, কম্পিউটেশন অ্যান্ড টেকনোলজি'র পরিচালক জে ম্যাকক্লেলান্ড বলেন, 'এ অ্যালগরিদম দিয়ে হয়তো অনুশীলনের অঙ্ক তৈরি করা ও শিক্ষার্থীদের সেগুলো সমাধানের মূল্যায়ন করা সম্ভব, কিন্তু গণিতের গূঢ় ধারণাগুলো শিক্ষার্থীদের বোঝানোর ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রযুক্তির বিষয়ে আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে।'
ড্রোরি নিজেও জানেন, তিনি ও তার দলের এখনো অনেক কাজ বাকি। অ্যালগরিদমটি গ্রাফ ও চার্ট ব্যবহার করা অঙ্ক ও ও যেসব প্রশ্নের উত্তরে গাণিতিক প্রমাণ দরকার হয়, তার সমাধান দিতে পারে না। তবে এটির বর্তমান ফলাফলে তিনি সন্তুষ্ট এবং ভবিষ্যতে এ প্রযুক্তির আরও উন্নয়ন ঘটানোর ক্ষেত্রে তিনি বেশ আশাবাদী।
ড্রোরি তার শিক্ষার্থীদের এ অ্যালগরিদমটি ব্যবহারে উৎসাহ দেন। এটি ব্যবহার করে অনেক গাণিতিক সমস্যা ঘণ্টার বদলে মিনিটে সমাধান করে ফেলতে পারে শিক্ষার্থীরা। এর ফলে বাড়তি সময়ে শিক্ষার্থীরা বড় ও ধারণাগত প্রশ্নগুলো নিয়ে চিন্তা করতে পারে বা বিভিন্ন প্রযুক্তিগত দক্ষতা শিখতে পারে। তিনি বিশ্বাস করেন, ক্লান্তিকর কাজগুলো যন্ত্রের মাধ্যমে করে ফেলাই শ্রেয়। এতে মানুষ বেঁচে যাওয়া সময় অন্য জ্ঞান আহরণে কাজে লাগাতে পারে।
তবে এ ধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মানুষ শিক্ষকদের প্রতিস্থাপিত করার কোনো উদ্দেশ্য নেই ড্রোরির। তিনি বরং চান এ প্রযুক্তির কারণে শিক্ষার্থীদের পেছনে কম সময়ে দেওয়া গেলে শিক্ষকেরা নিজেদের গবেষণা ও পাঠদান পদ্ধতি নিয়ে আরও বেশি মনোযোগী হতে পারবেন।
সূত্র: ইনসাইড হায়ার এড