নদীপাড়ের পুনরুজ্জীবন, রোহিঙ্গাদের জন্য বিশেষ আবাস: আবারও আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার জয় দেশের
স্থাপত্যজগতের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার জিতেছে দেশের দুইটি স্থাপত্য প্রকল্প। এগুলো হলো ঝিনাইদহের আরবান রিভার স্পেস প্রকল্প ও কক্সবাজারের কমিউনিটি স্পেসেস ইন রোহিঙ্গা রিফিউজি রেসপন্স প্রোগ্রাম।
প্রতি তিন বছর পরপর দেওয়া হয় পুরস্কারটি। বৃহস্পতিবার (২২ সেপ্টেম্বর) ঘোষণা করা ২০২০-২০২২ সাইকেলে বিভিন্ন দেশের মোট ছয়টি প্রকল্প পুরস্কার লাভ করেছে। এ প্রকল্পগুলোকে পুরস্কার হিসেবে মোট ১০ লাখ ডলার ভাগ করে দেওয়া হবে।
বিজয়ী বাকি চারটি প্রকল্প ইন্দোনেশিয়া, ইরান, লেবানন, ও সেনেগালের। এ বছর পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় ২০টি স্থাপত্য স্থান পেয়েছিল। সারাবিশ্বের ৪৬০টি প্রকল্প থেকে এ বছরের সংক্ষিপ্ত তালিকা ও বিজয়ীদের বেছে নেওয়া হয়েছে।
১৯৭৭ সালে চতুর্থ আগা খান এ পুরস্কার প্রবর্তন করেন। যেসব স্থাপনা মুসলমানদের তাৎপর্যপূর্ণ উপস্থাপনাসমৃদ্ধ কোনো সম্প্রদায়ের উপকারে লাগে, সেগুলোকে চিহ্নিত ও উৎসাহিত করতে এ পুরস্কারটি দেওয়া হয়।
এ পুরস্কারে অবকাঠামোগত ও সামাজিক চাহিদাপূরণের দিকটির পাশাপাশি স্থাপত্যের সাংস্কৃতিক আঙ্গিকের ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়।
আরবান রিভার স্পেস
ঝিনাইদহের এ প্রকল্পটি করা হয়েছে নবগঙ্গা নদীর পাড়ে। এটির কারিগর স্থপতি খন্দকার হাসিবুল কবির ও স্থপতি সুহেলি ফারজানা।
সময়ের সাথে সাথে নবগঙ্গা নদী ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যায়। একসময় বর্তমান প্রকল্পের এলাকাটি ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়। আরবান রিভার স্পেস প্রকল্পের মাধ্যমে বর্তমানে নদীর পাড়ে দুইটি ঘাট, মানুষজনের বসা ও হাঁটার জায়গা নির্মাণ করা হয়েছে।
খন্দকার হাসিবুল কবির জানান, নদীর আশেপাশের মানুষদের কাছ থেকেই তারা এ প্রকল্পের উৎসাহ পেয়েছেন। তবে ঝিনাইদহের স্থানীয় প্রশাসনের প্রকল্পের অধীনে কাজটি করেছেন তারা।
স্থানীয় মানুষেরা এ প্রকল্পের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। তাদের কাছ থেকে নানা পরামর্শও পেয়েছেন স্থপতিরা। স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য ইট ও কনক্রিটের মতো কাঁচামাল ব্যবহার করেই এ স্থাপত্যটি তৈরি করা হয়েছে।
আগা খান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক-এর ওয়েবসাইটে আরবান রিভার স্পেস প্রকল্পের নকশাকে 'সাধারণ ও প্রাসঙ্গিক' হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় শ্রমিক ও রাজমিস্ত্রীরাই এ প্রকল্পে কাজ করেছেন।
এ প্রকল্পের জন্য বিদ্যমান গাছ কাটেননি বা সবুজ ধ্বংস করেননি নির্মাতারা। এ প্রকল্পের ভবিষ্যৎ উদ্দেশ্য হলো নদী এলাকায় আরও হাঁটাপথ, বাগান, সাংস্কৃতিক সুবিধা নির্মাণ করা। এসবের মাধ্যমে নদীর জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধি করা যাবে।
খন্দকার হাসিবুল কবীর ও সুহেলি ফারজানা দুজনই ঝিনাইদহের মানুষ। এ শহরেই তাদের বেড়ে ওঠা। পড়ালেখা শেষে তারা ২০১৫ সালে ঢাকা থেকে ঝিনাইদহে ফিরে যান। উদ্দেশ্য শহরের নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য স্থাপত্যের দিক থেকে কিছু করা।
আরবান রিভার স্পেসের দুটো ঘাটের বড়টি সবার জন্য উন্মুক্ত। পাবলিক এ ঘাটতি ১১৫ মিটার লম্বা। এ ঘাটে বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের জন্যও নামার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। অন্য ঘাটটি আকারে ছোট। এটি সেখানকার নিম্ন-আয়ের সম্প্রদায়ের কথা বিবেচনা করে বিশেষভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। এ সম্প্রদায়ের অধিকাংশ সনাতন ধর্মাবলম্বী। তাদের ধর্মীয় আচাগুলো পালনেও ভূমিকা রাখছে ঘাটটি।
এ ঘাটটি এখন শহরের মানুষদের বিনোদনকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। মানুষের প্রাতভ্রমণ, সান্ধ্যভ্রমণ, আড্ডা, নদীর পাড়ে বসা এখন এ ঘাটের নিয়মিত দৃশ্য। এখন পর্যন্ত দেশের অর্ধশতের বেশি মিউনিসিপ্যালিটির প্রতিনিধিরা ঝিনাইদহের এ প্রকল্পটি পরিদর্শন করেছেন।
কমিউনিটি স্পেস ইন রোহিঙ্গা রিফিউজি রেসপন্স
কক্সবাজারের টেকনাফে রোহিঙ্গা শিবিরে ছয়টি আলাদা কমিউনিটি স্পেসের মাধ্যমে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। নারী শরণার্থীদের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা এ স্পেসগুলো নির্মাণে রোহিঙ্গাকর্মী ও স্থানীয়রা অংশ নিয়েছেন।
বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ৭৫ শতাংশই নারী আর শিশু। এ নারী ও শিশুরা বিভিন্ন শোষণ, ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার শিকার বেশি হন। তাই এ প্রকল্পটিতে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের বিভিন্ন প্রয়োজনীর কথা বিবেচনায় রাখা হয়েছে।
এ গৃহায়ণ প্রকল্পে রোহিঙ্গা নারীদের কুটিরশিল্প তৈরি ও প্রদর্শনের সুবিধাও রয়েছে। এ প্রকল্পটি তৈরি করেছেন স্থপতি রিজভী হাসান, খাজা ফাতমি, ও সাদ বিন মোস্তফা।
বিভিন্ন নকশায় তৈরি করা এ কমিউনিটি স্পেসগুলো রোহিঙ্গা শিবিরের অন্যান্য ঘর থেকে পুরোপুরি আলাদা। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চাহিদার কথা মাথায় রেখেই এ স্পেসগুলো তৈরি করেছেন স্থপতিরা। রোহিঙ্গাকর্মীদের কারিগরি দক্ষতাকে সামনে আনাও ছিল এ প্রকল্পের লক্ষ্য।
এ গৃহায়ণ স্পেসগুলো কেবলই থাকার জায়গা নয়। এখানে রয়েছে চিত্তবিনোদন, নারীদের জন্য ব্রেস্টফিডিং কর্নার, খেলাধুলা, আড্ডা ইত্যাদির জন্য পর্যাপ্ত জায়গাও।
প্রচলিত সিমেন্ট ও ঢেউটিনের বদলে স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য বাঁশ, ইট, সুপারি গাছ, খড়, ত্রিপল ইত্যাদি ব্যবহার করে এ স্থাপনাগুলো তৈরি করা হয়েছে।
এ স্পেসে রোহিঙ্গা সংস্কৃতির বিভিন্ন আলপনা, লেখা, অবকাঠামোগত নকশা ব্যবহার করেছেন স্থপতিরা। একইভাবে রোহিঙ্গাদের পরিচিত গাছপালা, ফুল-ফল স্পেসগুলোতে রোপণ করা হয়েছে যাতে তারা মানসিকভাবে নিজেদের সংস্কৃতি ও আবেগকে অনুভব করতে পারেন।
অতীত সাফল্য
বাংলাদেশি স্থাপত্যকর্ম এর আগেও আগা খান পুরস্কার লাভ করেছিল। ২০১৯ সালে এ পুরস্কারটি পায় স্থপতি সাইফ উল হকের নকশা করা কেরানিগঞ্জের দক্ষিণ কানারচরের আর্কেডিয়া এডুকেশন প্রজেক্ট। একই বছর স্থপতি জুবায়ের হাসানের নকশায় তৈরি করা গাজিপুরের অ্যাম্বার লুম ডেনিম শেড পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় নাম ওঠায়।
এছাড়া ২০১৬ সালে ঢাকার বাইত উর রউফ মসজিদ ও গাইবান্ধার ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার এ পুরস্কার লাভ করে। স্থাপনাদুটির নকশাকার ছিলেন যথাক্রমে স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম ও স্থপতি কাসেফ চৌধুরী।
২০০৭ সালে রুদ্রপুরের একটি বিদ্যালয়, এবং ১৯৮৯ সালে গ্রামীণ ব্যাংক হাউজিং প্রোগ্রাম ও জাতীয় সংসদ ভবন আগা খান পুরস্কার লাভ করে।
তথ্যসূত্র: আগা খান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক (একেডিএন), আর্কনেট, ইউএনবি, সিএনএন