ঘোড়া চক্কর গাছ থেকে আঁশ তৈরির কারিগরদের গল্প
২০১৯ সালে সাব্বির হোসেন প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকে ভর্তি হন। একদিন গ্রামের বাড়ি গাজিপুরে একটি শল্কাবৃত গাছ খুঁজে পান। এর আগে এমন গাছ তার কখনো চোখে পড়েনি।
কাপাসিয়ার ফকির-বাড়ি বাগানে এ গাছটির একটি ছোট ঝাড়ের দেখা মেলে। গাছের আকার লম্বা তরবারির মতো, পাতাগুলো বেশ মোটা। একদম পূর্ণবয়স্ক পাতাগুলোর গায়ের রং গভীর সবুজ, তার ওপর হালকা সবুজের ছোপ। হঠাৎ দেখে সাপের গায়ের ছোপের মতো মনে হয়।
ওই ঝাড়ের মধ্যে কিছু পাতা ছেঁড়া অবস্থায় মাটিতে পড়ে ছিল। সাব্বির খেয়াল করলেন পাতাগুলোর ভেতরে আঁশ বা তন্তুর মতো উপাদান রয়েছে।
সাব্বির নিজে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারের ছাত্র। পাতার চরিত্র তাকে অবাক করল। সেই ঝাড় থেকে একটি পাতা সংগ্রহ করে নিয়ে এলেন আরও বিস্তারিত অনুসন্ধান চালানোর জন্য।
সাব্বিরের দেখা ওই গাছটি হচ্ছে স্নেক প্ল্যান্ট। বাংলায় এটি ঘোড়া চক্কর গাছ নামে পরিচিত। এছাড়া সুতাহারা, গোরাচাঁপা, গোড়াচক্র ইত্যাদি নামেও ডাকা হয় এটিকে। ঘোড়া চক্করের বৈজ্ঞানিক নাম স্যানসেভিরিয়া ট্রাইফাসিয়াটা (Sansevieria trifasciata)।
ঘরের বাতাস বিশুদ্ধ করার জন্য এ গাছটি ঘরের ভেতর ও বাগানে রাখা হয়। এ বর্গের প্রায় ৭০টির মতো প্রজাতি আছে। ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ও আফ্রিকায় স্থানীয়ভাবে জন্ম হয় এ গাছের।
'স্যানসেভিরিয়া প্রজাতির এ গাছগুলো বাতাস থেকে ফর্মালডিহাইড, জাইলিন, টলুইন ইত্যাদি বিষাক্ত কণা দূর করে বাতাসকে বিশুদ্ধ করে বলে মনে করা হয়। এজন্য ঘোড়া চক্কর গাছ ইনডোর ও গার্ডেন প্ল্যান্ট হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। রাতের বেলা এ গাছ কার্বন ডাই অক্সাইডকে অক্সিজেনে পরিণত করে,' সাব্বির জানান।
কিন্তু সাব্বির বেশি আগ্রহী হয়েছিলেন ঘোড়া চক্করের তন্তময় উপাদান নিয়ে।
নিজের বন্ধু এমএকে অয়নকে গাছটি সম্পর্কে জানান তিনি। এরপর তারা এমন একজনের সন্ধানে নামলেন যিনি তাদেরকে বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিতে পারবেন।
'এরপর আমাদের এক সিনিয়র টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক এবিএম আবদুল্লাহ'র সঙ্গে দেখা করার পরামর্শ দিলেন,' সাব্বির ও অয়ন বলেন।
৩০ বছর পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটে কাজ করেছেন বিজ্ঞানী আবদুল্লাহ। তিনি প্রথমবারের মতো পাট থেকে আঁশ ও সুতা তৈরি করেন যেগুলো জামদানি শাড়ি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছিল।
'আমাকে স্বীকার করতেই হবে, বিজ্ঞানী ও পরে শিক্ষক হিসেবে আমার দীর্ঘ কর্মজীবনে গবেষণায় উৎসাহী এমন মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। সাব্বির ও অয়ন যখন তাদের গাছের খবর নিয়ে আমার কাছে এসেছিল, তখন তাদের চোখে আমি তুমুল কৌতূহল দেখেছিলাম। এমন দুই ছাত্র পেয়ে আমারও যারপরনাই আনন্দ হয়েছিল,' আবদুল্লাহ বলেন।
সেদিনই তিনি সাব্বির ও অয়নকে স্নেক প্ল্যান্ট বিষয়ে কাজ এগিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন।
প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর দুই তরুণ গবেষক নিশ্চিত হলেন ঘোড়া চক্করের দেহে তন্তুময় উপাদান আছে। ২০১৩ সালে 'এক্সট্রাকশন অভ ফাইবার ফ্রম স্যানসেভিরিয়া ট্রাইফাসিয়াটা প্ল্যান্ট অ্যান্ড ইটস প্রোপার্টিজ' শীর্ষক একটি গবেষণাপত্রে ভারতীয় দুজন গবেষক ঘোড়া চক্কর গাছের আঁশকে কীভাবে বয়নের সুতায় পরিণত করা যায় তা নিয়ে আলোকপাত করেছিলেন।
'টেক্সটা্ইল শিল্পে প্রচুর বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এটি তার আরেকটি সমাধান হতে পারে,' পরিবেশবান্ধব, বায়োডিগ্রেডেবল, রিসাইকেল ও পুনর্ব্যবহার করার মতো টেক্সটাইল পণ্যের সারাবিশ্বে চাহিদা রয়েছে জানিয়ে বলেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ।
তার কাছ থেকে জানা গেল বর্তমানে তুলা, পাট, কেনাফ, রেইমি ইত্যাদিন মতো সেলুলসিক ও লিগনোসেলুলসিক আঁশ বৈশ্বিক মনোযোগ পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিগুলো এখন এ ধরনের প্রাকৃতিক আঁশের সুতা দিয়ে পোশাক তৈরি করতে চায়। কলা, বাঁশ, কচুরিপানা ইত্যাদি থেকেও এ ধরনের বায়ো-পলিমার উৎপাদন করা যায়।
'ঘোড়া চক্কর গাছ থেকে আঁশ তৈরি করা নতুন কিছু নয়। আমার বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আগের অনেকগুলো গবেষণার সন্ধান পেয়েছি। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য ছিল এ গাছটি থেকে আঁশ তৈরি করা সহজ বা সাশ্রয়ী মূল্যের হবে কিনা এবং এ আঁশ থেকে সুতা তৈরি করে তা দিয়ে পোশাক তৈরি করা যাবে কিনা তা জানা,' আবদুল্লাহ বলেন।
গবেষণাটির জন্য তারা ফকির-বাড়ি বাগান থেকে ঘোড়া চক্কর গাছের পূর্ণবয়স্ক পাতা সংগ্রহ করেন। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল আঁশ তৈরির প্রক্রিয়া ও আঁশের উপাদান, রাসায়নিক গঠন, শক্তি, ব্যাস, রং, দৈর্ঘ্য, আর্দ্রতার পরিমাণ ইত্যাদি পরখ করে দেখা।
২০২০ সালে গবেষক দলটি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে তাদের প্রাথমিক গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেন। বর্তমানে তারা এ আঁশ নিয়ে আরও পরীক্ষানীরিক্ষা চালাচ্ছেন। তাদের তৈরি করা আঁশ হাতে নিয়ে অধ্যাপক আবদুল্লাহ ও দুই গবেষকের সঙ্গে ছবি তুলে ফেইসবুকে পোস্ট করেছেন ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল।
'বিবি জানিয়েছেন যেভাবে আমার তৈরি করা পাটের আঁশের সুতা দিয়ে তিনি জামদানি তৈরি করেছেন, তেমনিভাবে ঘোড়া চক্করের আঁশ নিয়েও কাজ করতে চান,' দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ।
বিবি রাসেলও একই কথা জানান। 'এটা অবশ্যই দারুণ একটা কাজ। এটা অনেক বড় একটা খবর। আমি এর আগে অধ্যাপক আবদুল্লাহর সঙ্গে কাজ করেছি। এ আঁশ তৈরির গবেষণাটির বিষয়ে প্রথম থেকেই জানতাম আমি। এটা থেকে তৈরি সুতা প্রস্তুত হলে ও তারা আমাকে দিলে আমি বুননের কাজটা শুরু করতে পারব,' বলেন তিনি।
বিবি রাসেল বলেন, 'বাংলাদেশে সুতা তৈরির বেশিরভাগ কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। কিন্তু আমরা যদি এ কাঁচামাল স্নেক প্ল্যান্ট গাছ থেকে তৈরি করতে পারি অথবা আমদানি করা কাঁচামাল দিয়ে মিশ্র সুতা তৈরি করতে পারি, তাহলে এটি পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দেবে।'
রেটিং-এর নতুন পদ্ধতি
গাছ থেকে আঁশ তৈরির প্রক্রিয়া সহজ নাকি কঠিন তা নির্ভর করে পাতা থেকে এটি ছাড়াতে কতদিন সময় লাগে তার ওপর।
'অ্যাকাডেমিক ভাষায় এটিকে রেটিং বলা হয়,' জানান অধ্যাপক আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, 'এটা আদতে গাছের পেকটিকজাতীয় উপাদানগুলো ভেঙে পড়ার প্রক্রিয়া। এ উপাদানগুলো আঁশকে পাতা বা কোষের সঙ্গে আটকে রাখে।'
এটা করার অনেক পদ্ধতি রয়েছে- হাত দিয়ে করা যায়, পানিতে জাগ দেওয়ার মাধ্যমে করা যায়, ডিউ রেটিং, রাসায়নিক উপায়ে রেটিং ইত্যাদিও অবলম্বন করা যায়। 'পানিতে জাগ দিলে আঁশ ছড়াতে তিন সপ্তাহের মতো লাগে। এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। আমরা চেয়েছিলাম আরও দ্রুত কীভাবে এটি করা যায় তা খুঁজে বের করতে,' অয়ন বলেন।
এ লক্ষ্যে গবেষকদলটি কেমি-বায়োকেমি-মেকানিক্যাল নামক একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এ পদ্ধতিতে ন্যূনতম সময়ে ন্যূনতম পানি ব্যবহার করে গাছ থেকে আঁশ ছাড়ানো যায়।
বনানীতে অবস্থিত প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে এ তরুণেরা নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করে ৪৮-৭২ ঘণ্টার মাধ্যমে পরিষ্কার, ধূসর-সাদা, উজ্জ্বল আঁশ উৎপাদন করতে সক্ষম হলেন।
আঁশ ছাড়ানোর পর রং ও অন্যান্য চটচটে উপাদান দূর করার জন্য কলের পানি দিয়ে আঁশগুলোকে ভালোভাবে ধোয়া হয়। এরপর সর্বশেষ এগুলোকে ডিস্টিলড পানি দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। তারপর এ আঁশগুলোকে খোলা জায়গায় কক্ষ তাপমাত্রায় শুকানো হয়।
'এ আঁশকে পরিমার্জন, ব্লিচ দিয়ে ধোয়া, এমনকি বাণিজ্যিক ডাইয়ে ছোপানো যায়। এর অন্যান্য সম্ভাবনা জানার জন্য আমাদেরকে আরও গবেষণা করতে হবে,' বলেন আবদুল্লাহ।
পাট ও কলার আঁশ থেকে উত্তম
ঘোড়া চক্করের ৫০০ গ্রাম পেষা পাতা থেকে গবেষকেরা ১৬-১৭ গ্রাম আঁশ পেয়েছেন। এটি প্রায় তিন শতাংশ উৎপাদন যেখানে পাট ও কলা থেকে পাওয়া যায় যথাক্রমে দুই ও দুই দশমিক ছয় শতাংশ আঁশ।
'প্রতি একক পাতা থেকে পাওয়া আঁশের পরিমাণ, শক্তি, ব্যাস, আর্দ্র উপাদান- সবক্ষেত্রেই আমরা ইতিবাচক ফলাফল দেখেছি। কিন্তু এ আঁশের কুঞ্চনের মাত্রা কম থাকায় এটি থেকে কাপড় বোনার ক্ষমতা তুলা ও পাটের আঁশের চেয়ে কম। তারপরও বুটিকশিল্পে, জামদানি ও কাতান তৈরিতে ঘোড়া চক্কর আঁশের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে,' বলেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ।
তিনি আরও জানান, ঘোড়া চক্কর গাছ তীব্র সূর্যালোক, ছায়া, এমনকি অন্ধকারেও বেড়ে উঠতে পারে। এর জন্য বিশেষ কোনো যত্নের প্রয়োজন হয় না। বাংলাদেশের আবহাওয়া এ গাছ জন্মানোর জন্য উপযুক্ত।
ঘোড়া চক্করের আরও গুণ
২০১৫ সালে ভারতে করা আরেকটি গবেষণা থেকে জানা যায়, ঘোড়া চক্কর গাছের মূল থেকে অনেক ন্যানোপণ্য তৈরি করার সম্ভাব্যতা আছে। এছাড়া এ মূলের মেডিকেলমূল্যও রয়েছে। এটির মূলে ফ্ল্যাভোনয়েডের উপস্থিতি আছে যা অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এজেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
এসবের পাশাপাশি, বায়ু দূষণ কমাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এ গাছ। এটি বাতাস থেকে বিষাক্ত কণাগুলো শুষে নেওয়ার পাশাপাশি বিশুদ্ধ অক্সিজেন তৈরি করে। রাতের বেলা সালোকসংশ্লেষণ বন্ধ থাকে বলে বেশিরভাগ গাছ কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসারণ করলেও ঘোড়া চক্কর রাতে অক্সিজেন তৈরি করে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সুজন সেন গুপ্ত