সাজিদের ‘চিঠি ডট মি’ যেভাবে ফেসবুকের ভাইরাল অ্যাপ, চিঠি আসছে বাংলায়!
আজকের দিনে আর চিঠি লেখে না কেউ। লিখলেও শখের বশে। যোগাযোগমাধ্যম এখন অতি সাধারণ ও সহজলভ্য। ইচ্ছে হলেই যখন-তখন ঢুঁ মারা যায় মেসেঞ্জার কিংবা হোয়াটসঅ্যাপে। অনায়াসে বলা যায় হুটহাট যত কথা। মোবাইলের মেসেজ টোন বা নোটিফিকেশনের শব্দে ভরে আছে প্রতিদিনের ব্যস্ত জীবন।
ডিজিটাল এই যুগে দাঁড়িয়ে যখন হাতের লেখায় কেউ আর কথা বলেন না— তখন চিঠির সেই স্নিগ্ধতা যেন এক রূপকথার গল্প।
'ভালো আছি, ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো'
হয়তো রুদ্রের মত এমন ভাবনা-চিন্তা সাজিদেরও। পুরো নাম সাজিদ হাসান। মেধাবী এই তরুণ পড়ছেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। চিঠির প্রতি তার প্রেম শৈশব থেকেই। সে ভালো লাগা থেকে তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত সাজিদ মস্ত বড় এক কাণ্ড ঘটিয়েছেন। বানিয়েছেন অনলাইনে চিঠি আদান-প্রদানের উপায়। তৈরি করেছেন এক অ্যাপ; যার নাম 'চিঠি ডট মি' (Chithi.me)।
যুগ পাল্টেছে, আধুনিক হয়েছে চারপাশ। সে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চিঠি দেওয়ার আধুনিক উপায়ও বের করেছেন তিনি। এই অ্যাপে ইচ্ছে হলেই যখন-তখন লিখতে পারেন চিঠি। তাও আবার পুরোনো দিনের লেখার স্টাইলে। ভিন্ন ভিন্ন লেখার ধরণে প্রিয়জনকে বলতে পারেন মনের কথা। অবশ্য এর পেছনেও আছে চমৎকার গল্প। সাজিদ নিজের মুখেই শোনালেন তা।
"আমার বড় ভাইয়া পড়তো ক্যাডেট কলেজে। আমি তখন খুব ছোটো। হয়তো ৬-৭ বয়স হবে। আমি আর আমার বোন ভাইয়াকে চিঠি লিখতাম। আমার আব্বু আম্মুকেও দেখতাম চিঠি লিখতে। সেই থেকে আমার চিঠির ওপর একটা ফ্যাসিনেশন রয়ে গেছে। আর এই ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং, চ্যাটিংয়ের যুগে কি যেন একটা মিসিং মনে হতো আমার। একটা চিঠিতে যতটা চিন্তা, যত্ন, ভালোবাসা থাকতো, তা আমাদের বর্তমান যান্ত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় নেই। এই ভাবনা থেকে এই অ্যাপ তৈরির যাত্রা," বললেন সাজিদ।
এইতো নভেম্বরের ১০ তারিখে গুগল প্লে স্টোরে প্রকাশ করে এই অ্যাপ। এরই মধ্যে মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলে দিয়েছে এটি। সাজিদ জানালেন প্রায় দেড় লাখেরও বেশি মানুষ এই অ্যাপে রেজিস্ট্রেশন করেছেন।
এবার তার কাছে প্রশ্ন ছিল এই, কেন বেনামী চিঠি লেখার অপশন রাখা হলো? সাজিদ জানান, "সোশ্যাল মিডিয়ায় রেগুলার যোগাযোগে আমাদের মনের কথার প্রায় সব এমনিতেই বলা হয়ে যায়। মাঝে মাঝে এমন কিছু কথা থাকে, যেগুলো হয়তো আমরা সরাসরি বলতে পারি না বিভিন্ন কারণে। সেসব যেন বলা যায়, তাই বেনামী অপশন।"
তার মতে, সত্যিকারের চিঠিও বেনামী হতে পারে। ডাকবক্সে চিঠি রাখার সময় প্রেরকের জায়গায় যেমন যা খুশি দেওয়া যায়, এখানেও ঠিক তাই। কেউ যদি চায় তবে সত্যিকারের চিঠির মতো উল্লেখ করতে পারেন নিজের নামও! আবার হতে পারেন কারও গোপন শুভাকাঙ্ক্ষীও। এটি নিয়ে জল্পনার ব্যাপারটা অনেক সময় বেশ ইন্টারেস্টিং হয়ে দাঁড়ায় বেনামী চিঠিতে।
এই অ্যাপের এমন জনপ্রিয়তার কারণ অনুসন্ধান করার ইচ্ছে হলো এবার। কেউ জানালেন ডিজাইনিং এর কথা। তাদের ভাষ্যে, কেমন যেন পুরোনো দিনের হারিয়ে যাওয়া চিঠির মতই লেখা, কাগজের ধরণ। এক দুটি ফন্ট নয়, ৪টি ভিন্ন ভিন্ন ফন্টে লেখা যায় চিঠি। পাশাপাশি পুরোনো দিনের ঝর্ণা কলম বা ফাউন্টেন পেনে লেখার অনুরূপ ফন্টেও মুগ্ধ হচ্ছেন সবাই।
এই যেমন রাফিয়া মাহমুদের কথাই ধরা যাক। আগে অ্যানোনিমাস মেসেজ দেওয়ার একটা অ্যাপ থাকলেও কখনো সেসব ডাউনলোড করার আগ্রহ পাননি। কিন্তু 'চিঠি ডট মি' অ্যাপটি তিনি খুলেছেন। কেন আগ্রহ তৈরি হলো? জানালেন, "এই অ্যাপের ফন্ট আমাকে আকৃষ্ট করেছে বেশ। আগেকার দিনের চিঠির মত একটা ব্যাপার আছে এইটায়।"
রাফিয়ার মতো অনেকেরও একই ভাষ্য। এই অ্যাপের লেখার ফন্টে তারা খুঁজে পেয়েছেন পুরোনো চিঠির গন্ধ। আবার কেউ কেউ অ্যাপের নামের কথাও তুলে ধরেন।
যেমন— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুনতাহা বলেন, "অ্যাপের শুরুতে চিঠি লেখা থাকাতে মানুষ সিরিয়াস হয়েই চিঠি লিখছে। আজেবাজে কিছু লিখছে না। আগে এমন অনেক অ্যাপ এসেছে। যেখানে বেনামী লেখা পাঠানো যেতো, যেগুলো বেশিরভাগই হতো নেতিবাচক কথাবার্তা। কিন্তু এটির ক্ষেত্রে সেটি ঘটছে না বললেই চলে।"
মজার ব্যাপার হলো, মানুষের মাঝে সাড়া জাগানো এই অ্যাপ কিন্তু সাজিদের একটি উইকেন্ড প্রজেক্ট! আশ্চর্য হলেও সত্য, এখনো এই অ্যাপ ব্যবহার করা হয়ে উঠেনি তার! না, ভুল শোনেননি।
তিনি বলেন, "সত্যি বলতে কোনো টার্গেট অডিয়েন্স নিয়েও আমি এটা বানাইনি। এমনকি, এটা কোনো টার্গেটেড অ্যাপই ছিল না!"
জানালেন, এত বেশি সাড়া পাবেন, সেটিও ছিল তার কল্পনার বাইরে। কাছে বন্ধুরাও এই কাজের জন্য প্রশংসার জোয়ারে ভাসিয়েছেন তাকে।
"হয়তো জানেন, এই বিপুল সংখ্যক ব্যবহারের চাপের মাঝে সার্ভার টিকিয়ে রাখাটা কত চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু তবুও এত ভালো লাগছে যখন দেখছি অ্যাপটা অনেকের আনন্দের উপলক্ষও। আমি আমার কাজটা যথেষ্ট উপভোগ করছি," যোগ করলেন সাজিদ।