বিজ্ঞানে এবং সাহিত্যের সবচেয়ে খারাপ, বিতর্কিত নোবেল পুরস্কার!
বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারের নাম নিতে গেলে সবার আগেই আসবে নোবেল পুরস্কারের নাম। এ পুরস্কার যারা জেতেন, তারা সাধারণত নিজ নিজ ক্ষেত্রে কিংবদন্তি হন।
১৯০১ সাল থেকে শুরু করে আজতক আলবার্ট আইনস্টাইন, মেরি কুরি, নেলসন ম্যান্ডেলা, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে প্রমুখের মতো জগদ্বিখ্যাত অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নোবেল পেয়েছেন।
তবে অনেকবারই নোবেল পুরস্কারপ্রদান নিয়ে উঠেছে বিতর্কের ঝড়। বেশ কয়েকবারই নোবেলজয়ী নির্ধারণ করতে ভুল করেছে নোবেল কমিটি। আর সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয় নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়ে। এ পুরস্কারটি নিয়ে ফি বছরই বিতর্ক হয়। চলুন ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ ও বিতর্কিত কয়েকটি নোবেল পুরস্কার সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
জোহানেস ফিবিগার: শারীরতত্ত্ব বা চিকিৎসাবিজ্ঞান, ১৯২৬
আগে কোনো আবিষ্কার, অর্জন বা ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হতো। আলফ্রেড নোবেলের নির্দেশনাই এর কারণ ছিল। তবে এর ফলে এমন কিছু আবিষ্কার পুরস্কার পেয়েছে, পরে যেগুলো অসার বা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এমন অসার আবিষ্কারকে পুরস্কৃত করার সেরা উদাহরণ সম্ভবত ১৯২৬ সালের চিকিৎসাবিজ্ঞানের নোবেল।
১৯২৬ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার ড্যানিশ বিজ্ঞানী জোহানেস ফিবিগার। 'স্পিরোপ্টেরা কার্সিনোমা' আবিষ্কারের জন্য এ পুরস্কার পান তিনি।
মোদ্দা কথা হলো, ফিবিগারের গবেষণায় দেখা যায় যে স্পিরোপ্টেরা কার্সিনোমা (Spiroptera carcinoma) নামের বিশেষ ধরনের কেঁচোকৃমির কারণে ইঁদুরের ক্যান্সার হয়ে থাকে। ফিবিগার বলেছিলেন, যেসব ইঁদুর কৃমির লার্ভাসংবলিত তোলাপোকা খায়, সেগুলোই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়।
কিন্তু পরবর্তীতে গবেষণায় দেখা যায়, কৃমির কারণে ইঁদুর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় না। ইঁদুরের ক্যান্সার হয় মূলত ভিটামিন এ-র অভাবে।
নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেওয়ার নিয়ম নেই। এ কারণে ভুল আবিষ্কার প্রমাণিত হওয়ার পরও ফিবিগারের নাম এখনও নোবেলজয়ীদের তালিকায় রয়ে গেছে।
বব ডিলান: সাহিত্য, ২০১৬
২০১৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পান মার্কিন গীতিকার ও সংগীতশিল্পী বব ডিলান। নোবেল কমিটির ভাষ্যে তিনি নোবেল জেতেন, 'আমেরিকার মহান সংগীত-ঐতিহ্যে নতুন কাব্যিক অভিব্যক্তি সৃষ্টির জন্য'।
এর আগেও অনেক কবি নোবেল জিতেছেন, কিন্তু ডিলানের গানের কথা সাধারণত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পাবলো নেরুদা বা টি.এস. এলিয়টের চেয়ে ভিন্ন ধারার।
তাই ২০১৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের ঘোষণা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওঠে বিতর্কের ঝড়। ডিলানের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া নিয়ে লেখক-পাঠকরা দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েন।
সাহিত্যে ডিলানের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার বিষয়টিকে ব্যতিক্রমী ও বিস্ময়কর ঘটনা হিসেবে অভিহিত করা হয়। কারণ তার আগে কোনো গান রচয়িতা ও সংগীতশিল্পী নোবেল পুরস্কার পাননি।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস ডিলানকে পুরস্কার দেয়ার সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করে। নোবেল কমিটির প্রতি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান ফরাসি ঔপন্যাসিক পিয়েরে অ্যাসোউলিন। তার মতে, নোবেল কমিটির এই সিদ্ধান্ত ছিল 'লেখকদের প্রতি অবমাননাকর'।
অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, ফিলিপ রথ, জন আপডাইক, জয়েস ক্যারল ওটসের মতো সমসাময়িক অন্যান্য মহারথী লেখকদের বাদ দিয়ে কীভাবে ডিলানকে নোবেল দেয়া হলো।
তবে ডিলানকে যে কমিটি নোবেল দেয়, সেই কমিটিতে ওটস ও রথ দুজনেই ছিলেন। অবশ্য সালমান রুশদিসহ অনেক লেখকই ডিলানের নোবেল পাওয়ার পক্ষে উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
জেমস ওয়াটসন, ফ্রান্সিস ক্রিক ও মরিস উইলকিন্স: শারীরতত্ত্ব বা চিকিৎসাবিজ্ঞান, ১৯৬২
কখনও কখনও কারও কারও পুরস্কার না পাওয়ার কারণে ওই পুরস্কারটি সবচেয়ে বিতর্কিত হয়। এমনটা ঘটেছিল ১৯৬২ সালের শারীরতত্ত্ব বা চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেলের বেলায়।
নিয়মানুসারে, একটি বিষয়ে সর্বোচ্চ তিনজনকে ভাগাভাগি করে নোবেল দেওয়া যায়। পাশাপাশি মরণোত্তর নোবেল দেওয়ার নিয়মও নেই।
তাই ডিএনএর দ্বিসূত্রক গঠন আবিষ্কারের জন্য ১৯৬২ সালে শারীরতত্ত্ব ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে জেমস ওয়াটসন, ফ্রান্সিস ক্রিক ও মরিস উইলকিন্স যখন নোবেল পুরস্কার পান, তখনই বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এই বিতর্কের কারণ ডিএনএর গঠন আবিষ্কারের গবেষণার সঙ্গে এই তিনজনের সঙ্গে ড. রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিনও যুক্ত ছিলেন, কিন্তু তিনি পুরস্কার পাননি।
দাবি করা হয়, চার বছর আগেই মারা যাওয়ায় ১৯৬২ সালে নোবেল পুরস্কারের তালিকা থেকে ডিএনএর কাঠামোর অন্যতম যৌথ অবিষ্কারক ফ্র্যাঙ্কলিনের নাম বাদ পড়ে। কিন্তু দাবিটি ঠিক নয়। ওই সময় আসলে মরণোত্তর পুরস্কার না দেওয়ার নিয়মটি চালু হয়নি—সেটি চালু হয় ১৯৭৪ সালে।
তাছাড়া সম্প্রতি অবমুক্ত একটি দলিলে দেখা গেছে, রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন ওই বছর আদতে পুরস্কারের জন্য মনোনয়নই পাননি। তার বদলে পুরস্কার পেয়েছেন ফ্রান্সিস ক্রিক, জেমস ওয়াটসন ও মরিস উইলকিন্স।
এছাড়া বিজয়ী তিনজন তাদের প্রথম প্রকাশনায় ফ্র্যাঙ্কলিনের অবদান বা নামই উল্লেখ করেননি। উল্টো 'দ্য ডাবল হেলিক্স' বইয়ে ওয়াটসন তাকে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরেছেন।
ধারণা করা হয়, রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। তার গবেষণা দলের এক সদস্য, ড. অ্যারন ক্লুগ ১৯৮২ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার জেতেন। আর ক্লুগ পুরস্কারটি জিতেছিলেন ফ্র্যাঙ্কলিনের সঙ্গে শুরু করা কাজটি অব্যাহত রেখে। এ থেকে বোঝা যায়, ফ্র্যাঙ্কলিনের কাজ সত্যিই নোবেল জয়ের দাবিদার ছিল।
আন্তোনিও ইগাস মোনিজ: চিকিৎসাবিজ্ঞান বা শারীরতত্ত্ব, ১৯৪৯
পর্তুগিজ বিজ্ঞানী আন্তোনিও ইগাস মোনিজ মানসিক অসুস্থতার চিকিৎসার জন্য লিউকোটমি বা লোবোটমি (আমেরিকায় এ নামে পরিচিত পায়) আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কারের জন্য ওয়াল্টার রুডলফ হেসের সঙ্গে যৌথভাবে ১৯৪৯ সালে তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান।
লিউকোটমি হলো মানসিক রোগ সারানোর জন্য মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচারের একটি পদ্ধতি। মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সংযোগ কেটে দিয়ে এই পদ্ধতিতে অস্ত্রোপচার করা হতো। এই অস্ত্রোপচার উদ্বিগ্নতা, বিষণ্ণতার উপসর্গ কমাত।
১৯৪০-এর দশকে এই অস্ত্রোপচার দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আনুমানিক ৪০ হাজার মার্কিন এই অস্ত্রোপচার করিয়েছিল, আর ইংল্যান্ডে ১৭ হাজার মানুষ লিউকোটমি করায়।
নোবেল কমিটি একে মানসিক রোগের 'চিকিৎসায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলো একটি' বলে অভিহিত করে। কিন্তু এই অস্ত্রোপচারের নেতিবাচক দিক তখনও কারও কাছে স্পষ্ট হয়নি।
পরবর্তীকালে দেখা গেল, লিউকোটমি মানসিক চিকিৎসায় কাজে লাগলেও এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত গুরুতর। এই অস্ত্রোপচারে সিংহভাগ ক্ষেত্রেই মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতো। এমনকি অনেক ক্ষেত্রেই রোগী মারাও যেত।
এমনকি সফল অস্ত্রোপচার হওয়া রোগীরাও মানসিকভাবে প্রতিক্রিয়াহীন বা অসাড় হয়ে পড়ত। তাদেরকে প্রায়ই 'নির্বোধ', 'উদাসীন', 'আড়ষ্ট', 'পরনির্ভর' অভিহিত করা হতো।
ভয়ংকর এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য ১৯৫০-এর দশকেই এই অস্ত্রোপচার পদ্ধতির প্রয়োগ কমতে থাকে। তাছাড়া ওই সময় মানসিক চিকিৎসার জন্য বিওল্প ওষুধও বাজারে আসতে থাকে।
১৯৭০-এর দশকে বেশিরভাগ দেশেই লিউকোটমি নিষিদ্ধ করে। যদিও ফ্রান্সে ১৯৮০-র দশক পর্যন্ত এ পদ্ধতিতে অস্ত্রোপচার চলতে থাকে। বর্তমানে একে বর্বর পদ্ধতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
নোবেলজয়ী ড. টরস্টেন উইজেল ড. মোনিজের পুরস্কার পাওয়াকে 'বিচারের গুরুতর ভুল' হিসেবে আখ্যা দেন। কিন্তু যেহেতু পুরস্কার ফিরিয়ে নেওয়ার নিয়ম নেই বলে গুরুতর ভুল আবিষ্কারের জন্য আজও ড. মোনিজ নোবেল পুরস্কারজয়ীদের তালিকায় রয়ে গেছেন।
ফ্রিৎস হেবার, রসায়ন, ১৯১৮
নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেন গ্যাস থেকে অ্যামোনিয়া তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করেন জার্মান রসায়নবিদ ফ্রিৎস হেবার। এই পদ্ধতিতে সারা বিশ্বে সার তৈরি করা হতো। এর ফলে দারুণ উপকার পায় কৃষি।
এই অবদানের কারণে ১৯১৮ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন হেবার।
কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান বাহিনীর পক্ষে বেলজিয়ামে ক্লোরিন গ্যাস আক্রমণ তদারকির দায়িত্ব পালন করেছিলেন হেবার। এতে মিত্রপক্ষের হাজার হাজার মারা পড়েছিলেন। এই প্রাণঘাতী পরিকল্পনায় নিজেই স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন হেবার।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এমনতর মানবতাবিরোধী কাজ করার পরও হেবারকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করার জন্য তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়।
অং সান সু চি, শান্তি, ১৯৯১
নোবেল পুরস্কারের যে বিভাগটি প্রায় প্রতি বছরই সবচেয়ে বেশি বিতর্কের জন্ম দেয় সেটি হলো, শান্তি। এই ক্যাটাগরি নিয়ে এত বেশি বিতর্ক সৃষ্টি কারণ এর রাজনৈতিক প্রকৃতি।
শান্তিতে বিতর্কিত নোবেলজয়ীদের তালিকাটা বেশ লম্বা। তবে তাদের মাঝেও অন্যতম অং সান সু চি। মিয়ানমারের এই রাজনীতিক দেশটির সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলনের জন্য ১৯৯১ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।
কিন্তু পুরস্কার পাওয়ার প্রায় দুই দশকের মাথায়ই অসহায় রোহিঙ্গাদের রক্তে হাত রাঙান সু চি। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর গণহত্যা ও তাদের ওপর ব্যাপক নির্যাতনে মদদ জোগানোর জন্য তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি।
রাখাইনের ঘটনাকে জাতিসংঘ গণহত্যার স্বীকৃতি দিয়েছে।
সু চির পদক প্রত্যাহারের দাবিও উঠেছে অনেকবার। কিন্তু নিয়মের কারণে তার পুরস্কার ফিরিয়ে নেওয়া যায়নি।
হেনরি কিসিঞ্জার, শান্তি, ১৯৭৩
১৯৭৩ সালে নোবেল পান তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। তার সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন উত্তর ভিয়েতনামের বিপ্লবী নেতা লি ডাক থো।
কিসিঞ্জার পরিচিত ছিলেন যুদ্ধবাজ কূটনীতিক হিসেবে। কম্বোডিয়ায় বোমাবর্ষণ ও দক্ষিণ আমেরিকায় কনডর অপারেশনের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তিনি। এছাড়া তিনি ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ে একের পর এক বোমা ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এতে হাজার হাজার মানুষ হতাহত হয়।
এছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধেও অবস্থান নিয়েছিলেন কিসিঞ্জার।
তাই স্বাভাবিকভাবেই কিসিঞ্জারের নোবেল জয় নিয়ে বিশ্বব্যাপী ওঠে সমালোচনার ঝড়। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস ওই বছরের পুরস্কারটিকে আখ্যায়িত করেছিল 'নোবেল ওয়ার প্রাইজ' হিসেবে।
হেনরি কিসিঞ্জারকে নোবেল দেওয়ার প্রতিবাদে নোবেল কমিটির দুজন সদস্য পদত্যাগ করেছিলেন।
- সূত্র: বিগ থিঙ্ক, বিবিসি