রাজধানীতে কৃষকের বাজার: কৃষকেরা নিজেরাই যেখানে নিজেদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করেন
ঘড়িতে তখন ৬টা বেজে ৫০ মিনিট, নভেম্বরের সকালের হালকা কুয়াশা ভেদ করে নরম রোদ ছড়িয়ে পড়েছে রাস্তায়। রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেন রোডে শুক্রবারের ঘুম ভেঙ্গে মর্নিংওয়াকে বের হওয়া মানুষের আনাগোনা। লেডিজ ক্লাবের পাশের ফুটপাতে রঙ-বেরঙের ছাতার নিচে শীতের সবজির পসরা সাজিয়ে বসেছেন কয়েকজন। মর্নিংওয়াকে বিরতি দিয়ে কেউ কেউ দাঁড়িয়ে পরখ করছেন সেসব সবজি। সামনে এগিয়ে জানা গেল কৃষকের বাজার বসেছে এখানে।
সরাসরি কৃষকের ক্ষেত থেকে তাজা শাকসবজি এসেছে এই বাজারে। বিক্রেতা হিসেবেও আছেন খোদ কৃষকেরাই। নিজের হাতে ফলানো সবজি সরাসরি ভোক্তার হাতে তুলে দিচ্ছেন তারা। ঢাকার অদূরেই সাভারের গ্রাম থেকে এসেছেন এই কৃষকেরা। বৃহস্পতিবার বিকেলে সবজি তুলে শুক্রবার সকালের আলো ফোটার আগেই ঢাকায় রওনা হয়েছেন এই বাজারের উদ্দেশ্যে। প্রতি শুক্রবার সকাল ৭টা থেকে শুরু হয় কৃষকের বাজার। চলে জুম্মার নামাজের আগ পর্যন্ত। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রকল্পের আওতায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, অ্যাম্বেসি অব দ্য কিংডম অব দ্য নেদারল্যান্ডস, সিটি করপোরেশন এবং ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের সম্মিলিত উদ্যোগে ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের ১৬টি জায়গায় নিয়মিত বসছে এই বাজার।
ঢেঁড়শ, গোল বেগুন, টমেটো, ঝিঙা, ফুলকপি, জলপাই, লেবু, ধুন্দল, পেঁপে নিয়ে বসেছেন সাভারের হেমায়েতপুরের কৃষক মো. বসির। জানালেন সাভারের কৃষি অফিস থেকে তার মতো কয়েকজন কৃষকের সাথে যোগাযোগ করে যাচাই-বাছাই শেষে ১০ জনকে নির্বাচন করা হয়েছিল। তারা ১০ জনই গত দেড় মাস ধরে ইস্কাটন গার্ডেন রোডের এই কৃষকের বাজারে বসছেন। তাদের উৎপাদিত পণ্যের বিশেষত্ব কী জানতে চাইলে বলেন, "আমাদের শাক-সবজি বিষমুক্ত। কৃষি অফিসের দেখানো ফেরোমন ফাঁদ দিয়ে পোকা দমন করি আমরা। সার হিসেবে বেশি ব্যবহার করি জৈব সার। যেগুলো না দিলেই হয় না এমন কিছু কেমিক্যাল সার ব্যবহার করি শুধু।"
পসরা সাজিয়ে বসা কৃষকদের পাশে ছাতা দিয়ে সাজানো জায়গা ফাঁকা ছিল কয়েকজনের জন্য। চারজন কৃষক তখনো এসে পৌঁছায়নি। ৭টা ১৫ নাগাদ মাঝারি একটি পিকআপ ভ্যানে করে পৌঁছান তারা। ব্যস্ত হয়ে সবজি সাজাতে লাগেন। তাদের ঝুড়িতে আছে লাউ, মূলা, কলার মোচা, দেশি মুরগির ডিম, গরুর দুধের বোতল, কাঁচাপাকা পেঁপে, নানা জাতের শাকসহ দেশীয় সবজির সমাহার। শাক-সবজির পরিবহন খরচ বা বাজার বসার জায়গার খরচ- কিছুই বইতে হয় না এই কৃষকদের।
বাজার ঘুরে ঘুরে দুই হাতের ব্যাগ ভর্তি করে ফিরে যাচ্ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা শহীদ হোসেন। এখানে বাজার করতে আসার কারণ জিজ্ঞেস করতে বললেন, "এখান থেকে ২ মিনিটের হাঁটার দূরত্বে আমার বাসা। আমি মূলত বড় বাজারেই যাই। কিন্তু গত তিন সপ্তাহ ধরে শুক্রবার সকালে এখান থেকে বাজার করছি। সাভার থেকে আসা সব ফ্রেশ শাকসবজি পাচ্ছি এখানে। যা প্রায় অরগানিক বলা যায়। তবে দামটা সাধারণ বাজারের তুলনায় বেশি। যেমন বেগুন কারওয়ান বাজারে যেটা ৫০ টাকা এখানে কিনেছি ৭০ টাকা দিয়ে, পটল ওই বাজারে ৪০ টাকা এখানে কিনেছি ৬০ টাকায়, ফুলকপি দুটো কিনলাম ১২০ টাকায় যেটা কারওয়ান বাজারে ৮০ টাকা। তবু সবকিছু ফ্রেশ বলে প্রায়ই বাজার করি এখান থেকে। পাশাপাশি এতদূর থেকে তারা বাজার নিয়ে আসে, তাদের উৎসাহ দিতেও আসি এখানে।"
বাজার করছিলেন অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি চাকরিজীবি ফরহাদ হোসেন ও ব্যাংক কর্মকর্তা আমাতুজ জোহরা দম্পতি। ফজরের নামাজ শেষে পার্কে হাঁটতে এসে বাজার বসেছে দেখে স্ত্রীকে ডেকে এনেছেন ফরহাদ। আমাতুজ জোহরা বললেন, "এই বাজার উদ্বোধন হওয়ার পর থেকেই এখানে কেনাকাটা করছি আমরা। এখানে দামটা তুলনামূলক বেশি হলেও সবজিগুলো ভালো। শাকটা সবচেয়ে বেশি ভালো। রান্না করলেই পার্থক্য বোঝা যায়। শাকটাই বেশি কিনি এখান থেকে আমি।"
কথা হয় সাভার থেকে আসা আরেক কৃষক সোহরাব হোসেনের সাথে। বিক্রি কেমন হয়, লাভ থাকে কেমন জানতে চাইলে সোহরাব বলেন, "বাজার এখানে ভালোই। লাভও হয় মোটামুটি। এখানে বসার, সবজি পরিবহনের কোনো খরচ দিতে হয় না সেটাই আমাদের লাভ। এই বাজারে সবকিছুর ফিক্সড দাম। আমার এখানে সব নিজের ক্ষেতের জিনিস। কৃষি অফিসারের পরামর্শমতো সার ব্যবহার করি সবসময়।"
৮টা নাগাদ বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে বাজার। শুধু বাজার করতে আসা ক্রেতাই নয়, কৌতূহলী দর্শকদেরও ভিড় দেখা যায় আশেপাশে। রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে দূর থেকে ছবি তুলছিলেন এক বয়স্ক ভদ্রলোক। কথা বলে জানা যায় তিনি অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, নাম জালাল। এই বাজারের বিশেষত্ব নিয়ে সন্দিহান তিনি। ইস্কাটনেই তার বাসা। সপ্তাহে একদিন বসা এই বাজারের লাভটা কী তা নিয়ে কৌতূহল থেকেই দেখতে এসেছেন এখানে। জালাল বলেন, "এরকম শাকসবজি তো কারওয়ান বাজারেই পাওয়া যায়। আলাদাটা কী এই বাজারে! দামও শুনলাম বেশি এখানে, তাহলে তো কোনো লাভই নাই। বড় বাজার রেখে কেন এখান থেকে কিনব!"
ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষক মনিরা আমিন এখানকার নিয়মিত ক্রেতা। বেইলি রোডে তার বাসা। আগে নিরাপদ শাকসবজি কিনতে তিনি নিয়মিত আগারগাঁও-এর দিকে এক বাজারে যেতেন। ইস্কাটনে কৃষকের বাজার শুরু হওয়ার পর থেকে এখানেই আসেন বাজার করতে। মনিরা বলেন, "বাচ্চাদের জন্য খাবারের ব্যাপারে আমি খুব সচেতন। চেষ্টা করি সবসময় ন্যাচারাল খাবার তাদের দিতে। সেজন্যই সাধারণ বাজারের চেয়ে এদের শাকসবজি বেশি পছন্দ করি আমি। রান্না করলেই এর পার্থক্য বোঝা যায়। এখানকার অধিকাংশ জিনিসই ভালো। কিন্তু গত সপ্তাহে দেশি মুরগি বলে কক মুরগি বিক্রি করা হয়েছে আমার কাছে। সেটা ফেরত দিয়ে কমপ্লেইন জানাতে এসেছি আজ আয়োজকদের কাছে।"
ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাশে দাঁড়িয়ে বাজার মনিটরিং করছিলেন প্রজেক্ট কর্মকর্তা রাফসান আহমেদ। কৃষকেরা কোন কোন সবজি এনেছেন, কত দাম রাখছেন সব নোট করে পাশের বোর্ডেও লিখছেন। মনিরা আমিনের অভিযোগ শুনে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিস্তুতি দিলেন তিনি। তার কাছে জানা যায়, এই কৃষকদের ফসল উৎপাদনে তদারকি করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তুর। তাদের মাধ্যমেই নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। পণ্যের উৎপাদন পদ্ধতি নিয়ে ক্রেতাদের স্বচ্ছ ধারণা দেওয়ারও চেষ্টা করেন তারা। মধ্যসত্ত্বভোগীদের হাত বেয়ে না আসায় কৃষক ও ক্রেতা উভয়পক্ষই লাভবান হয়। একই সাথে স্থানীয় অর্থনীতিও হয়ে ওঠে শক্তিশালী। বাজারে বাইরের কোনো হকার জায়গা দখল করার সুযোগ নেই। শুধু বাছাইকৃত কৃষকেরাই বসতে পারেন নির্ধারিত স্থানে। তবে সেই কৃষকেরা যদি নিয়ম ভঙ্গ করেন তবে শাস্তিস্বরূপ এই বাজার থেকে বহিঃস্কৃত করা হয় তাদের।
রাফসান আহমেদ বলেন, "প্রথম কৃষকের বাজার কর্মসূচী শুরু হয়েছিল ২০২১ সালের জুন মাসে, মিরপুর ৬ নম্বরে। প্রায় দেড় বছর যাবত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে বাড়ানো হয়েছে বাজারের সংখ্যা। ইস্কাটনের এই বাজার উদ্বোধন করা হয়েছে গত ৩০ সেপ্টেম্বর। ঢাকায় মোট ১২টি, নারায়ণগঞ্জে দুইটি ও গাজীপুরে দুইটিসহ মোট ১৬টি জায়গায় কৃষকের বাজারের আয়োজন করতে পেরেছি আমরা। সাভার, নারায়ণগঞ্জসহ ঢাকার আশেপাশের গ্রামাঞ্চলে উৎপাদিত শাক-সবজি, ফল-মূল, দুধ-ডিম, হাঁস-মুরগি আনা হয় বাজারগুলোতে। স্থানীয় বাজারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কৃষকদের সাথে পরামর্শ করে সব পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয় আমাদের পক্ষ থেকে।"
বর্তমানে ঢাকায় ইস্কাটন গার্ডেন রোড ছাড়াও মিরপুর ৬, রূপনগর, পল্লবী, কামরাঙ্গীরচর, টিকাটুলি, খিলগাঁও, লালমাটিয়া, মোহাম্মাদপুরের আদাবর ও মোহাম্মাদিয়া হাউজিং সোসাইটি, আজিমপুর ও হাজারীবাগে রয়েছে কৃষকের বাজার। এছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয়ের ভিন্ন উদ্যোগে মানিক মিয়া এভিনিউতে সেচ ভবনের প্রাঙ্গণে প্রতি শুক্র-শনিবারে বসে আরেক 'কৃষকের বাজার'। ভোক্তাদের কাছে স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ খাদ্য পৌঁছে দেওয়াই উভয় বাজারের মূল লক্ষ্য।