তছরুপ, প্রতারণা ও পঞ্জি স্কিম: ম্যাডফের কৌশল ব্যবহার করেছিলেন স্যাম ব্যাংকম্যান-ফ্রিড?
হুট করে স্যাম ব্যাংকম্যান-ফ্রিড আর বার্নি ম্যাডফের মধ্যে তেমন কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। একজন কেতাদুরস্ত, ওয়াল স্ট্রিটে ৪০ বছরের অভিজ্ঞতায় চুল পাকিয়ে ফেলা পোড়-খাওয়া ফাইন্যান্সিয়াল টাইটান, আর ৩০ বছর বয়সী অন্যজন ক্রিপ্টোকারেন্সি দুনিয়ার শর্ট আর টি-শার্ট পরা মিলেনিয়াল রাজা।
দীর্ঘদিন ধরে পিরামিড স্কিম পরিচালনা করে প্রতারণার অভিযোগে নিউ ইয়র্কে ম্যাডফ অবশেষে গ্রেপ্তার হন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের ১৪ বছর পর এখন স্যাম ব্যাংকম্যান-ফ্রিডের কোম্পানি এফটিএক্স-এর ক্রিপ্টো জালিয়াতিকে ম্যাডফের অপরাধমূলক কার্যকলাপের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে।
ম্যাডফের ৬৪ বিলিয়ন ডলারে প্রতারণার গভীরে অনুসন্ধান চালানো দ্য উইজার্ড অব লাইজ গ্রন্থের লেখক ও আর্থিক ইতিহাসবিদ ডায়ানা হেনরিকস বলেন, ব্যাংকম্যান-ফ্রিড ওরফে এসবিএফ আর ওয়াল স্ট্রিটের বিনিয়োগ ব্যবস্থাপকের মধ্যকার সাদৃশ্য 'অসামান্য'।
'এ দুজনেই নানা দিক থেকে অনেক ভিন্ন দুটি চরিত্র। কিন্তু তাদের মধ্যকার সাদৃশ্যটি হচ্ছে, তারা দুজনেই বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছিলেন। গড়পড়তা বিনিয়োগকারীরা বিনাপ্রশ্নে বার্নিকে বিশ্বাস করেছিলেন। এফটিএক্স'র গ্রাহকদের কাছেও সংস্থাটিকে বিশ্বাস করার মতো পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ ছিল না, তারপরও তারা স্রেফ বিশ্বাসের ওপর ভর করে বিনিয়োগে এগিয়ে গিয়েছিলেন।'
আপনি পালের গোদাকে বিশ্বাস করবেন। তার ওপর ভর করে আপনি বিনিয়োগের অনেক পদক্ষেপ এড়িয়ে যাবেন। এসব পদক্ষেপে থাকবে অনেকগুলো সতর্কতামূলক ব্যবস্থা (ডিউ ডিলিজেন্স)। অর্থাৎ পুরো ব্যাপারটা হবে 'চোর পালালে বুদ্ধি বাড়া'র মতো। আর এক্ষেত্রেই ম্যাডফ আর এসবিএফের মধ্যে দারুণ মিল রয়েছে,' বলেন ডায়ানা হেনরিকস।
'একজন প্রতারকের সবচেয়ে অপরিহার্য গুণটা হলো তারা এমনভাবে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে পারেন যা কখনো টলে না। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে অভিযোগ ও নেতিবাচক তথ্য মানুষের জানা থাকলেও। এফটিএক্স-এর বিষয়টিকে গণামানুষের 'লিপ অব ফেইথ' ছাড়া আর কিছু বলা যাচ্ছে না,' হেনরিকস বলেন।
মার্কিন কারাগারে ১৫০ বছরের সাজা ভোগরত অবস্থায় গত বছর মারা গেছেন ম্যাডফ। এ সপ্তাহে নিউ ইয়র্কের মার্কিন ফেডারেল অ্যাটর্নিরা এসবিএফের বিরুদ্ধে প্রতারণা নিয়ে আট কাউন্টের অভিযোগ প্রকাশ করেছেন। যদি দোষ প্রমাণ হয়, তাহলে তাকে সর্বোচ্চ ১১৫ বছরের কারাদণ্ড পেতে হবে। ব্যাংকম্যান-ফ্রিডের বিরুদ্ধে এখনো কোনো অভিযোগ গঠন করা হয়নি। শেষ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ থেকে তিনি মুক্তিও পেতে পারেন।
২০০৮ সালে ম্যাডফের সংকট, এবং এসবিএফের ক্রিপ্টোবাজারের পতন, কোভিড-১৯ ও উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি; দুটো আর্থিক পতনই তাদের ব্যবসায়র মধ্যকার ফাঁকিগুলো প্রকাশ করে দিয়েছে। একইসঙ্গে তাদের গ্রাহকদের দীর্ঘকালীন বিশ্বাসও ধুলোয় মিশে গিয়েছে।
ম্যাডফের পরিণতি নিয়ে হেনরিকস লিখেছিলেন, 'চোখের পলকে এক সুদর্শন রাজপুত্র কুৎসিত ব্যাং-এ পরিণত হলো।' তার এ পর্যবেক্ষণ হালের ব্যাংকম্যান-ফ্রিডের ক্ষেত্রেও খুব সহজেই খাটে।
দুজনের ব্যক্তিগত পরিস্থিতি অবশ্য খুব ভিন্ন ছিল। ওয়াল স্ট্রিটে ম্যাডফ দীর্ঘসময় ধরে বিখ্যাত ছিলেন। রেগুলেটরেরা তার কাজের ওপর নিয়মিত পর্যবেক্ষণও চালাতেন। অন্যদিকে এসবিএফ তরুণ বয়সে অতি দ্রুত নতুন একটি আর্থিক শিল্পের মাধ্যমে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে নিয়েছেন। তবে এ বিশ্বাসের প্রতিমূর্তির পর্যায়ে পৌঁছাতে দুজনকেই কঠিন পরিশ্রম করতে হয়েছিল।
ম্যাডফ ও এসবিএফ; দুজনেই ছিলেন আর্থিক উদ্ভাবক। তাদের পরিচালিক ব্যবসায় ছিল জটিল প্রকৃতির। কিন্তু এফটিএক্স'র পতনের কেন্দ্রে ছিল একটি সাধারণ ধারণা — গরু মেরে জুতো দান। ম্যাডফের ক্ষেত্রেও একই অভিযোগ ছিল।
ম্যাডফের মতো এফটিএক্স'র কার্যক্রমও ছদ্ম-জটিলতায় পরিপূর্ণ ছিল। ম্যাডফ তার গ্রাহকের কাছে এমনভাবে বিনিয়োগের কৌশল ব্যাখ্যা করতেন, গ্রাহক আর সত্য-মিথ্যার পার্থক্য ধরতে পারতেন না বলে জানান হেনরিকস। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীরা উপায়ন্তর না পেয়ে ম্যাডফকে অর্থ দিতেন।
কিন্তু ম্যাডফ মোটাদাগে যা করেছেন তা হলো, তিনি এক গ্রাহক থেকে অর্থ নিয়ে অন্য গ্রাহককে দিয়েছেন। আর এ স্থানান্তরের মাঝে নিজে কিছু অর্থ কেটে রেখে দিতেন। এটিই পঞ্জি স্কিম হিসেবে খ্যাত। কিন্তু আর সব পঞ্জি স্কিমের মতো, বিনিয়োগ কমে আসার পর ম্যাডফের স্কিমও আর কাজ করল না।
২০০৮ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের সময় ম্যাডফের গ্রাহকেরা প্রায় সাত বিলিয়ন ডলার উঠিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। আর এতেই প্রকাশ হয়ে পড়ে তার প্রতারণা। পরে সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়, ২০ বছর ধরে পঞ্জি স্কিম পরিচালনা করছিলেন ম্যাডফ।
এফটিএক্স-এর প্রতারণার এখনো অনেক বিষয় জানা বাকি। কিন্তু মার্কিন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকম্যান-ফ্রিডের বিরুদ্ধে আনা প্রতারণার অভিযোগও একই পদ্ধতি মেনে সংঘটিত হয়েছিল।
ক্রিপ্টোকারেন্সির জগতে এক্সচেঞ্জ প্ল্যাটফর্মগুলো যখন কুখ্যাত, তখন এসবিএফের প্ল্যাটফর্ম এফটিএক্স নিজেদের এ খাতে ভালো অ্যাক্টর হিসেবে গর্বভরে জানান দিত। ক্রিপ্টোবাণিজ্য বিষয়ে আরও স্বচ্ছ নীতিমালা তৈরি করতে কর্তৃপক্ষের কাছে লবিং করেছিলেন এসবিএফ। রাজনীতিবিদদের তহবিলে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার যোগান দিয়েছিলেন তিনি। সবসময় তিনি দাবি করতেন, তার অর্থ উপার্জনের একমাত্র কারণ ছিল ভালো কাজ করা।
কিন্তু সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন জানিয়েছে, ব্যক্তিগত সুবিধার জন্যই গ্রাহকদের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার নয়ছয় করেছেন তিনি।
কর্তৃপক্ষের দাবি অনুযায়ী, এসবিএফ তার প্রতারণা শুরু করেছিলেন একেবারে প্রথম থেকেই। ২০১৯ সালে এফটিএক্স চালু হওয়ার দিন থেকেই প্রতারণা পদ্ধতিকেও সচল করে দিয়েছিলেন ব্যাংকম্যান-ফ্রিড, এক ল-স্যুটে এমনটাই জানিয়েছে কমোডিটি ফিউচারস ট্রেডিং কমিশন।
দেউলিয়া বিশেষজ্ঞ তৃতীয় জন রে এফটিএক্স-এর জালিয়াতির পর বিষয়টির দায়িত্ব হাতে তুলে নিয়েছেন। এ সপ্তাহে কংগ্রেসকে তিনি জানিয়েছেন, ক্রিপ্টো জালিয়াতির ঘটনাটি ছিল 'পুরোনো ধাঁচের তছরুপে'র নিদর্শন। রে ও তার দল এখন কোম্পানিটর রেকর্ড দেখে জানতে চাইছেন, ঠিক কত পরিমাণ অর্থ খোয়া গেছে, কারা কত পাবেন, এবং গ্রাহকদের কী পরিমাণ অর্থ ফেরত দেওয়া সম্ভব।
ম্যাডফ তার ক্যারিয়ারের এক পর্যায়ে নাসডাক-এর চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন। তার গ্রাহকদের তালিকায় নাম আছে স্টিভেন স্পিলবার্গ, কেভিন বেকনের মতো তারকারা। অন্যদিকে এফটিএক্স-এ ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ করে কারা কারা অর্থ খুইয়েছেন তার সম্পূর্ণ তালিকা এখনো জানা যায়নি। তবে এ প্ল্যাটফর্মটির ইকুইটি ইনভেস্টর ছিলেন মার্কিন ফুটবলার টম ব্যাডি ও তার সাবেক স্ত্রী, মডেল জিজেল বুন্ডশেন প্রমুখ। এফটিএক্স'র বিজ্ঞাপনেও দেখা গিয়েছিল তাদেরকে।
এ কোম্পানিটিকে সমর্থন জানাতে আরও দেখা গেছে কমেডিয়ান ল্যারি ডেভিড, টেনিস তারকা নাওমি ওসাকা, সাবেক বাস্কেটবল তারকা শাকিল ও'নিল ও মার্কিন বিজনেস টিভি সিরিজ শার্ক ট্যাংক তারকা কেভিন ও'লিরিকে।
একটি প্রাইভেট ইকুইটি ফার্মের ক্রিপ্টো বিনিয়োগকারী এরিক শিফার বলেন, রাজনৈতিক পরিধি ও সেলিব্রিটি সমাজে ব্যাংকম্যান-ফ্রিডের প্রভাব ছিল। তিনি সবাইকে বুঝিয়েছেন, তার কাজ অর্থের জন্য নয় বরং তিনি হিতবাদে বিশ্বাসী। এসবের ফলেই তার গ্রাহকেরা বিনিয়োগের সব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ভুলে বসেছিলেন।
ক্রিপ্টোকারেন্সি এক্সচেঞ্জের দুনিয়ায় এসবএফই প্রথমবারের মতো অভিযোগের মুখে পড়লেন। তবে প্রসিকিউটরেরা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তার এ প্রতারণাটিই এ জগতের শেষ ঘটনা হতে চলছে না। এমনকি তারা প্রতারণায় যুক্ত থাকাদের সতর্কও করে দিয়েছেন: 'আমাদের কাছে এসে সব খুলে বলুন, আমরা আপনার কাছে আসার আগে।'
এসবিএফ আত্মপক্ষ সমর্থন করে টুইট করেছেন, অসংখ্য ইন্টারভিউতে নিজেকে ব্যাখ্যা করেছেন, এবং স্বীকার করেছেন, তিনি 'লেজেগোবরে পাকিয়ে ফেলেছেন'। আবার কখনো কখনো তিনি 'পুরো ব্যাপারটি একটা বড় ভুল' বলে তার অপরাধকে হালকা করতে চেয়েছেন।
আগামী মাসগুলোতে প্রসিকিউটরেরা এসবিএফের বিরুদ্ধে যে কেস দাঁড় করাবেন, তা-তে তারা মূলত ভিন্নরূপী এক মিলেনিয়াল ম্যাডফের বিরুদ্ধেই বিতর্ক চালাবেন। অবশ্য নিজেকে ম্যাডফের সঙ্গে মেলাতে কষ্ট হচ্ছে এসবিএফের।
'আমার মনে হয় না আমি ওরকমই (ম্যাডফের মতো)। আমি বুঝতে পারছি মানুষ কেন ওরকমভাবে দেখছেন আমাকে। তারা অনেক অর্থ হারিয়েছেন। কিন্তু দেখুন, দিন শেষে কী হয়েছে, কেন হয়েছে, কে করেছে, কীভাবে এসব ঘটেছে; এসব প্রশ্ন তো রয়েই যায়। আমার মনে হয়, সেগুলো পুরোপুরি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ তৈরি করবে,' এবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন স্যাম ব্যাংকম্যান-ফ্রিড।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান