৫০-এর বদলে ৫০০, সরবরাহের এ ভুলে যেভাবে পোল্ট্রি এখন ৩০ বিলিয়ন ডলারের শিল্প
বিশ্বব্যাপী মানুষ প্রচুর পরিমাণে মুরগির মাংস খায়। কেবল ২০২০ সালেই সারা পৃথিবীর মানুষ সাত হাজার কোটি মুরগি খেয়েছে। ১৯৬৫ সালে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৮০০ কোটি। এত পরিমাণে মুরগি সরবরাহ করতে বেগ পেতে হয় না বৈশ্বিক পোল্ট্রি শিল্পের। মজার ব্যাপার হলো, এ শিল্পের সূচনা হয়েছিল ছোট্ট একটি ভুল থেকে। সে গল্প জানিয়েছে ভক্স।
গল্পের শুরু আজ থেকে ১০০ বছর আগে — ১৯২৩ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়ারে বাস করতেন গৃহিনী ও কৃষক সিসিল স্টিল। তখনকার আরও অনেক মার্কিনীর মতো তিনিও মুরগি পালন করতেন ডিম খাওয়ার জন্য। কিন্তু একদিন স্থানীয় হ্যাচারি তাকে ভুলক্রমে ৫০০টি বাচ্চা পাঠিয়ে দিলো। সিসিল মূলত কিনেছিলেন ৫০টি ছানা।
তখনকার দিনে পণ্য ফেরত দেওয়ার কোনো নিয়ম প্রচলিত ছিল না। তাই বাধ্য হয়েই মুরগির বাচ্চাগুলোকে পালতে শুরু করেন সিসিল। সে সময়ে আমেরিকার সবচেয়ে বড় খামারেও মুরগির সংখ্যা ছিল কেবল ৩০০টি। সাড়ে চার মাস পরে ৫০০ ছানার মধ্যে ১০০টি মরে গেল। তা সত্ত্বেও বাকি ছানাগুলোকে মুরগি হিসেবে বিক্রি করে বিস্তর লাভ করলেন সিসিল।
এরপর ব্যবসা বাড়তে শুরু করেন সিসিল। তার স্বামী ডেভিড স্টিল কোস্ট গার্ডের চাকরি ছেড়ে দিলেন তাকে সহায়তা করার জন্য। তিন বছর পরে তাদের খামারে মুরগির সংখ্যা দাঁড়াল ১০ হাজারে। এ পরিবারের সাফল্যের গল্প চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল এবং ১৯২৮ সালের মধ্যে ওই এলাকায় কয়েকশ কৃষক মাংসের জন্য মুরগি পালন করতে শুরু করেন। প্রসঙ্গত, সিসিলের এ ব্যবসার আগে বেশিরভাগ কৃষক মুরগি পালন করতেন কেবল ডিমের জন্য।
সিসিলের এ মুরগির ব্যবসার ঘটনা শুরু হয় '২০-এর দশকে যখন আমেরিকার অর্থনীতির প্রভূত শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল। একই সঙ্গে কৃষিপণ্য সংরক্ষণ ও পরিবহনের ক্ষেত্রেও উন্নতি হয়েছিল। আর এসবের পাশাপাশি তখন মুদিদোকানগুলোর চেইন গড়ে উঠতে শুরু করেছিল দেশজুড়ে।
কাছাকাছি সময়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারও পোল্ট্রি শিল্পকে বৃদ্ধি করতে সহায়তা করেছিল। ১৯২২ সালে ভিটামিন ডি আবিষ্কৃত হয়। শীতকালে মুরগিগুলোকে ঘরের ভেতর রাখা হতো। ফলে সূর্যের আলো না পাওয়ায় অনেক মুরগি রিকেটসে ভুগে মারা যেত। রিকেটস হয় ভিটামিন ডি-এর অভাবে। কিন্তু যেই না কৃষকেরা মুরগির খাদ্যে ভিটামন ডি মেশাতে শুরু করলেন, তখন থেকে তাদের মুরগির সংখ্যা বেড়ে যেতে থাকল, একই সঙ্গে তারা সারাবছরজুড়ে মুরগি পালন করতে আর কোনো সমস্যার মুখে পড়লেন না।
সিসিল স্টিলের মুরগিভাগ্যের সময়টা যেমন তার অনুকূলে ছিল, তেমনিভাবে তার খামারের অবস্থানও মুরগি পালনের জন্য অত্যান্ত উপযোগী ছিল। তার খামারটি ছিল ডেলমার্ভা পেনিনসুলায়। এখানে খালি জমির পরিমাণ ছিল অনেক, আর দামেও সস্তা। আর এখান থেকে ওয়াশিংটন, বাল্টিমোর, ফিলাডেলফিয়া, ও নিউ ইয়র্ক সিটিও বেশি দূরে ছিল না। এ শহরগুলোতে মুরগির ভোক্তার সংখ্যা ছিল প্রচুর।
২০ শতকের প্রথমার্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মোট মাংস খাওয়ার প্রায় ২০ শতাংশ ছিল মুরগির। বর্তমানে এ হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪ শতাংশ। স্টিল পরিবারের হাত ধরেই মার্কিনীদের খাবার প্লেটের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে মুরগি।
আগামীর মুরগি, আজকের মুরগি
হালের একটি গবেষণা অনুযায়ী, আজ থেকে ৩,০০০ বছর আগে বর্তমানের থাইল্যান্ডে মানুষ প্রথমবারের মতো মুরগিকে পোষ মানিয়েছিল। এরপর চীন, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা, ইতালি, ব্রিটেন, ও স্ক্যান্ডেনেভিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে মুরগি।
প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, মুরগিকে মানুষ প্রথম পোষ মানিয়েছিল মোরগ লড়াইয়ের জন্য, খাদ্য হিসেবে নয়। এমনকি ১৯৪০-এর দশক পর্যন্ত গরু ও শূকরের তুলনায় কৃষিখাতে মুরগির অবদান ছিল নিতান্তই সামান্য। স্টিল ও তার সমসাময়িক উদ্যোক্তাদের কল্যাণে মুরগির এ ভূমিকার পরিবর্তন ঘটে। এরপর মুরগির বাচ্চা জন্ম দেওয়া, পালন ইত্যাদি ক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হওয়ার পর মুরগির ভূমিকা ডিম পাড়া থেকে বৃহত্তর মাংস উৎপাদকে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
১৯৪৬ সালে মার্কিন বিজ্ঞানী, সরকারি কর্মকর্তা, মাংস উৎপাদনকারী, ও স্বেচ্ছাসেবীরা দেশব্যাপী একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। 'দ্য চিকেন অব টুমরো' শীর্ষক ওই প্রতিযোগিতার লক্ষ্য ছিল একটি বড় আকারের মুরগি খুঁজে পাওয়া। তখন মুরগি ডিমের জন্যই পালা হতো, কিন্তু গ্রোসারি চেইন এঅ্যান্ডপি চেয়েছিল এমন জাতের মুরগি যেটি বেশি করে মাংস সরবরাহ করতে পারত।
৪০ জন প্রতিযোগীকে হারিয়ে প্রতিযোগিতায় শীর্ষস্থান জেতেন ক্যালিফোর্নিয়ার কৃষক চার্লস ভ্যান্ট্রেস। দ্য নিউ হ্যাম্পশায়ার রেড ও কর্নিশ জাতের মুরগির সংকর করেছিলেন তিনি। পোল্ট্রির জিনতত্ত্ব নিয়ে পরে আরও গবেষণা করেন ভ্যান্ট্রেস। শেষে ১৯৭৪ সালে নিজের সংকর জাতের মুরগিগুলোকে তিনি টাইসন ফুডস নামক একটি বড় পোল্ট্রি কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেন।
টাইসন আবার তার কোম্পানিকে কব নামক আরেকটি কোম্পানির সঙ্গে একীভূত করে কব-ভ্যান্ট্রেস গঠন করেন। ২০১৬ সালে বিশ্বে মাংস উৎপাদনের জন্য পালা মুরগির প্রায় অর্ধেক ছিল 'কব ৫০০' জাতের।
১৯২৮ সালে আলেকজান্ডার ফ্লেমিং পেনিসিলিন আবিষ্কার করেন। এর দুই দশক পরে মার্কিন বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন, অরিওমাইসিন অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ালে খামারের পশুর বৃদ্ধি দ্রুত ঘটে। এ আবিষ্কারের ফলে গবাদি পশু ও পাখির খাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হুহু করে বেড়ে যায়।
১৯৭০-এর দশকে মার্কিন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা নাগরিকদের পশুচর্বি খাওয়া কমিয়ে মাংস খাওয়ার আহ্বান করেন। তারা মানুষদের মুরগি, টার্কি, মাছ খাওয়ার পরামর্শ দেন। এর ফলে ১৯৭০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে গরুর মাংস খাওয়ার পরিমাণ ২৮ শতাংশ কমে যায় এবং পোল্ট্রিজাত মাংস ভক্ষণ ১৭৩ শতাংশ বাড়ে।
মুরগির মাংসের আজকের পর্যায়ে আসার জন্য মুরগিকে অনেক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। একটা সময় মুরগি নারীদের এবং গরু পুরুষদের খাবার হিসেবে বিবেচনা করা হতো। প্রাচীন গ্রিসের চিকিৎসক হিপ্পোক্রেটসও তার লেখায় লিখেছিলেন, মুরগি ছিল দুর্বল মানুষের খাবার। অবশ্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বডিবিল্ডার ও প্যালেও ডায়েটারদের কাছে পছন্দের মাংস হিসেবে মুরগি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ
মুরগি থেকে বেশি মাংস উৎপাদন করার জন্য মানুষ মুরগির ওপর অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছে। হালের পোল্ট্রি মুরগিগুলোর শরীর এতটাই ভারী হয়ে ওঠে যে এগুলোর বেশিরভাগ ঠিকমতো হাঁটতেই পারে না। 'দ্য চিকেন অব টুমরো' প্রতিযোগিতার সময়কালে একটি মুরগির 'বাজারের ওজন' তথা তিন পাউন্ড হতে ৮৪ দিন সময় লাগত। বর্তমানে এর অর্ধেক সময়ে একটি মুরগি দ্বিগুণ ওজনের হতে পারে।
কানাডিয়ান পোল্ট্রি গবেষকদের নতুন একটি বিখ্যাত গবেষণায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, পোল্ট্রি কোম্পানিগুলো মুরগির জীবতত্ত্ব নিয়ে কতদূর পর্যন্ত নাড়াচাড়া করেছেন। ওই গবেষকেরা ১৯৫৭, ১৯৭৮, ও ২০০৫ সালের মুরগির জাত সংগ্রহ করে সেগুলো টানা ৫৬ দিন একই ধরনের খাবার খাওয়ান। গবেষণা শেষে দেখা যায়, ১৯৫৭ সালের জাতের মুরগিটির ওজন হয়েছে দুই পাউন্ড, ১৯৭৮ সালেরটির চার পাউন্ড এবং ২০০৫ সালের মুরগিটির ওজন দাঁড়িয়েছে একেবারে ৯.২ পাউন্ডে।
এভাবে মুরগির বৃদ্ধি দ্রুত হওয়ায় সেটা ভোক্তা, কোম্পানি এমনকি আশ্চর্যজনকভাবে কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানোর পক্ষে ভালো। কিন্তু এ পদ্ধতি মুরগির স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর। আর গোমাংসের বদলের মুরগি খাওয়ার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় মানুষ এখন এককভাবে একটি প্রাণীকে বেশি সংখ্যায় হত্যা করছে। কারণ একটি গরু থেকে যে পরিমাণ মাংস পাওয়া যায়, তার সমপরিমাণ মাংসের জন্য ১০০টি মুরগি জবাই করতে হবে।
গত ৫০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা বাড়লেও গবাদিপশু পালন ও জবাইয়ের সংখ্যা কয়েক মিলিয়ন করে কমেছে। অন্যদিকে বার্ষিক মুরগি জবাইয়ের পরিমাণ ৬০০ কোটি বেড়েছে।
ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড-এর ফলিত পরিবেশগত স্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক স্যাকবি উইলসন মুরগির বিষ্ঠা থেকে কতভাবে পরিবেশ দূষিত হতে পারে, তা ব্যাখ্যা করেছেন। এ বিষ্ঠায় থাকা নাইট্রেট পানি দূষণ করতে করে, অ্যামোনিয়া শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, এবং 'পোল্ট্রি ধুলা' শ্বাসপ্রশ্বাস ও হৃদপিণ্ডের সমস্যার কারণ হতে পারে।
শতবছর আগে সিসিল স্টিল ৫০টির বদলে ৫০০টি মুরগি নিয়ে যে 'চেইন অব ইভেন্ট' শুরু করেছিলেন, তা আজ সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মাত্রা নিয়েছে। আমাদের কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন, পানি ও বায়ু দূষণ, এবং মুরগি প্রজাতিটিকে এর সক্ষমতার সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে যাওয়ার পরেও বিশ্বব্যাপী পোল্ট্রি শিল্পের আয়তন বাড়ছে, কারণ মাংস উৎপাদনের অন্যতম সহজ ও কার্যকরী উপায় হচ্ছে এ শিল্প।