কসপ্লেয়ার: বিচিত্র একেকটি চরিত্র সেজেই যাদের আনন্দ!
ড্রাগন বল সুপার হিরো'র ব্ল্যাক গোকু, অ্যাটাক অন টাইটান থেকে মিকাসা একারমেন, চোজি আকিমিচি, ররোনোয়া জরো, সিজুকুর মতো অ্যানিমে ও কার্টুন চরিত্রগুলোকে বাস্তবরূপে ঠিক অবিকল সাজ আর পোশাক পরে ঘুরতে দেখা যায় 'ঢাকা পপ ও কসপ্লে ফেস্টে'। এই মেলায় কোনোকিছুর বেচাকেনা নয়, বরং দেখা মিলে একঝাঁক তরুণ-তরুণীকে নানারকম ভিন্নধর্মী সাজপোশাকে ঘুরে বেড়াতে।
টিভিতে দেখা নিজেদের পছন্দের চরিত্রের মতো করে সেজেগুজে তরুণ-তরুণীরা এ মেলার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। কসপ্লে যাদের শখের কাজ, যারা এটি করতে ভালোবাসেন, তারা একত্রিত হতে প্রায় প্রতিবছরই এমন ফেস্টের আয়োজন করেন। কসপ্লেয়ারদের সাজপোশাক ও পারফম্যান্সের ওপর নানা ক্যাটাগরিতে পুরস্কারের ব্যবস্থাও করে থাকেন আয়োজকেরা।
এ বছর 'ঢাকা পপ ও কসপ্লে ফেস্ট'-এর আয়োজন করেন দুজন পেশাদার কসপ্লেয়ার। একসময় অন্যদের মতো এই কসপ্লে জগতে নবীন ছিলেন শুভ রহমান ও শারিয়ার খান। সেখান থেকে আজ তারা নিজেরাই হয়ে উঠেছেন কসপ্লে মেলার আয়োজক। তাদের এ আয়োজক হয়ে ওঠার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, এ প্রজন্মের তরুণদের মাঝে কসপ্লেকে আরও জনপ্রিয় করে তোলা এবং সবাইকে একটা নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা।
চারদিকে নানা চরিত্রে সাজা কসপ্লেয়ারদের মাঝে সাদাসিধে পোশাকে সবকিছুর ব্যবস্থাপনা করতে দেখা গেল আয়োজক শুভ রহমানকে। তার সঙ্গে কথা বলার সময় বাংলাদেশে কসপ্লের বিস্তার নিয়ে জানাচ্ছিলেন। বলেন, 'জাপানিজ অ্যানিমে, ও কে-পপ সারাবিশ্বে আলোড়ন তুলতে শুরু করলে বাংলাদেশের তরুণেরাও এ সংস্কৃতির চর্চা শুরু করে। ২০১২ সালে 'ঢাকা কমিকন'-এর মাধ্যমে কসপ্লে তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। খুব অল্পসংখ্যক লোকই তখন কসপ্লে করতেন। সামাজিক পরিস্থিতিও এতো খোলামেলা ছিল না বর্তমান সময়ের মতো। তাই টিভিতে কার্টুন আর গেম খেলার মধ্যে অনেকে ডুবে থাকলেও সেগুলো নিয়ে কসপ্লে করার কথা ভাবতো না।
'শখের বশেই কসপ্লে করতে শুরু করি। কিন্তু আমার পরিবার কখনোই এসব মেনে নেয়নি। সৌদি আরবের রিয়াদে আন্তর্জাতিক কসপ্লে প্রতিযোগিতায় প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে আমি অংশগ্রহণ করি। কসপ্লে করার পাশাপাশি ঢাকায় কয়েকবার কসপ্লে ফেস্টের আয়োজন করেছি। প্রথমদিকে টিউশনের টাকা জমিয়ে ভেন্যু ভাড়া নিতাম। এখন টিকেট বিক্রি, স্টল ভাড়া আর স্পন্সরদের দেওয়া টাকা থেকেই বিভিন্ন প্রতিযোগিতার জন্য পুরস্কারের আয়োজন করা হয়। আমার এ তীব্র ইচ্ছা দেখার পর ধীরে ধীরে পরিবার সমর্থন দিতে শুরু করে। আমার বাবাই এখন নিজ থেকে টিকেট বিক্রির স্থানে চেয়ার নিয়ে বসে থাকেন, সবকিছু দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করেন', বলছিলেন শুভ রহমান।
ছোটবেলার স্বপ্নপূরণ করতে কসপ্লেয়ার হয়ে ওঠা
কসপ্লে হচ্ছে স্কুল-কলেজের যেমন খুশি তেমন সাজো অনুষ্ঠানের মতো। বিভিন্ন কার্টুন, সিরিজ থেকে পছন্দের একেকটি চরিত্রের মতো করেই নিজেদের সাজিয়ে তোলেন কসপ্লেয়ারেরা। ছোটবেলায় টিভিতে সুপারহিরো চরিত্র দেখে আমাদের অনেকের মনেই ইচ্ছা জাগত — 'আমিও যদি এমন হতে পারতাম!' মনের মধ্যে থাকা সে ইচ্ছাকেই বাস্তবে রূপ দেন কসপ্লেয়ারেরা। কেবল সাজ আর পোশাকে নয়, তারা ওই চরিত্রের মধ্যে এতবেশি আবিষ্ট হয়ে পড়েন যে, সেভাবেই অঙ্গভঙ্গি করা ও কথা বলা রপ্ত করে ফেলেন। কোনো কোনো কসপ্লেয়ারের একাধিক পছন্দের চরিত্র থাকে। তারা একেক বছর একেকটি চরিত্রের মতো করে পোশাক বানিয়ে নিজেদের সাজিয়ে তুলেন।
প্রথমবারের মতো দেখলে যে কারও কাছে এমন সাজপোশাক উদ্ভট মনে হতে পারে। কসপ্লেয়ারদের পরিবারের মানুষের কাছেও প্রথমদিকে তা-ই মনে হতো। সময়ের সাথে বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের পছন্দ ও বিনোদনের বিষয়ে পরিবর্তন এসেছে। তাই বাবামায়েরা শুরুতে আপত্তি করলেও একসময় তা মেনে নিয়ে উৎসাহ দিয়ে যান।
'চোজি' চরিত্রে সেজে আসা কসপ্লেয়ার সাদমান হক এমন কথাই জানাচ্ছিলেন। তার মতো জামা, কপালে, হাতে ও বুকে যুদ্ধ সৈনিকদের মতো বেল্ট পরে ঠিক অবিকল চোজি সেজে ফেস্টে এসেছিলেন সাদমান। উচ্চ মাধ্যমিক দেওয়া এই তরুণ কথায় কথায় জানাচ্ছিলেন এটিই তার প্রথম কসপ্লে। এর আগে তিনি কসপ্লে শো দেখতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন কিন্তু নিজে করেননি।
সাদমান বলেন, 'প্রায় ১৫ বছর ধরে আমি অ্যানিমেটেড সিরিজ, কার্টুন দেখি। এগুলো দেখার প্রতি আমি এত বেশি আসক্ত হয়ে পড়ি যে, সেখান থেকেই শখ জাগে কসপ্লে করার। সে সময়ে আমাদের দেশে কসপ্লে এত বেশি জনপ্রিয়তা পায়নি। বিভিন্ন দেশের কসপ্লেয়ারদের ইনস্টাগ্রাম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনুসরণ করা শুরু করি। দেখতাম তারা কীভাবে সাজত আর নিজেরাই সেই পোশাকগুলো বানাত। যেখানে কসপ্লে শো হতো, আগ্রহ নিয়ে দেখতে চলে যেতাম। তারপর ঠিক করি আমিও এবার কোনো একটা চরিত্রে কসপ্লে সাজব।
'কিন্তু মা এসব শুরুতে পছন্দ করেননি। আস্তে আস্তে বুঝতে পারল আমি এসব ব্যাপারে কতবেশি আগ্রহী। তখন তিনি নিজেই আমার কসপ্লে পোশাক বানাতে সাহায্য করেন। দর্জির কাছে ছবি দেখিয়ে মা বুঝিয়ে দেন এই চোজির পোশাক কীভবে বানাতে হবে। বুকের, হাতের বেল্টগুলো আমি নিজে ফোম কেটে কেটে ডিজাইন করে বানিয়েছি। এগুলো বানাতে আমার ১৫ দিনের মতো লেগেছে। মাথার আলগা নকল চুল কিনে নিয়েছি। আমাদের দেশে কসপ্লে করার পোশাক ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তেমনভাবে দোকানে কিনতে পাওয়া যায় না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু গ্রুপ আছে, অর্ডার করলে ওরা চীন থেকে এনে বিক্রি করে। তবে সেক্ষেত্রে দাম বেশি পড়ে। তাই আমার মতো নতুনেরা নিজেরাই পোশাক ও অন্যান্য জিনিস ভিডিও দেখে হাতে বানিয়ে নেয়।'
ফেস্টে সবাই কসপ্লে করতে এসেছেন এমনটা নয়। অনেকেই এসেছিলেন কসপ্লেয়ারদের দেখতে এবং বাকিরা বিভিন্ন কোনায় টেবিল সাজিয়ে বসেছিলেন কসপ্লে সরঞ্জাম বিক্রি করতে। টেবিলের ওপর সাজানো ছিল বিভিন্ন কমিক ও অ্যানিমেটেড চরিত্রের ছোটবড় পুতুল, পোস্টার, চাবির রিং, মানিব্যাগসহ অনেক শোপিস ও পিন।
হলরুমের টেবিলের এক কোনায় দেখা গেল বিখ্যাত কোরিয়ান সিরিজ 'স্কুইড গেমের' ব্যানার। টেবিলের ওপর টুকরা করে কেটে রাখা সারিসারি ফোম। উল্টো করে রাখা ফোমগুলোয় ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ ও গোলাকৃতি এঁকে রাখা হয়েছিল। ঠিক যেমনটি সিরিজে দেখা যায় তেমনভাবেই চার মিনিট সময় বেঁধে দেওয়া হয় আকৃতি অনুযায়ী ফোমগুলো পিনের খোঁচায় কেটে নেওয়ার জন্য। সময়ের মধ্যে 'স্কুইড গেম ডালগোনা' খেলাটি শেষ করতে না পারলে এখানে পুতুলের গুলিতে মেরে ফেলার ভয় নেই। তবে নির্দিষ্ট সময়ের আগে খেলা শেষ করতে পারলেই পাওয়া যাবে পছন্দসই বিভিন্ন কে-ড্রামা ও সিরিজের পোস্টার।
'ঢাকা পপ ও কসপ্লে ফেস্টে' কয়েকটি ভাগে নানা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় — কে-পপ ও হিপ-হপ নাচ, গেমিং প্রতিযোগিতা, কসপ্লে পারফম্যান্স, ব্যান্ড দলের গান ও ডিজে পারফম্যান্স। দুই দিনের আয়োজনে প্রায় ২০০'র ওপর মানুষ অংশগ্রহণ করেন এই আয়োজনে।
মূল কসপ্লে প্রতিযোগিতার পুরস্কার ছিল ২০ হাজার টাকা। কে-পপ, ব্যান্ড গানের দল ও গেমিং প্রতিযোগিতার জন্য প্রতিটি বিভাগে ৫ হাজার টাকা করে পুরস্কার দেওয়া হয়। প্রতিবছর এভাবেই কসপ্লে মেলার আয়োজন করে সবাইকে একত্রিত করার পাশাপাশি নতুন কসপ্লেয়ারদের উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন প্রবীণ কসপ্লেয়াররা।
বিদেশি সংস্কৃতির প্রতি ঝোঁক
কে-পপ ও কসপ্লে বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও এটি মূলত কোরিয়ান, জাপানিজ সংস্কৃতি থেকে এসেছে। যে চরিত্রগুলো কসপ্লেয়াররা সাজেন, তার বেশিরভাগই ভিন্ন দেশের সিরিজ, কমিক থেকে নেওয়া। কে-পপ উঠতি বয়সের তরুণদের কাছে এত বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠার কারণে কসপ্লে করার প্রবণতাও বাড়ছে। কিন্তু নিজ দেশের সংস্কৃতি চর্চা না করে কেন ভিনদেশি সাজে নিজেদের সাজাচ্ছেন এ কসপ্লেয়ারেরা?
একজন পেশাদার কসপ্লেয়ার ও আয়োজক হিসেবে শুভ রহমান বিদেশি সংস্কৃতিকে কেন তুলে ধরছেন – এমন কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলেন, 'এ প্রশ্নের মুখোমুখি একাধিকবার হয়েছি। এখানে সংস্কৃতির চর্চার চেয়ে শিল্পচর্চা বেশি হচ্ছে আমি বলব। একেকজন কসপ্লেয়ার ভিন্ন দেশের চরিত্র সাজলেও নিজেদের সাজিয়ে তুলতে ডিজাইন করে জামা বানাচ্ছেন, সে চরিত্রে অভিনয় করছেন। যারা কে-পপ গানে নাচছেন তারাও কোরিওগ্রাফি করছেন। এগুলোর সবই আর্টের মধ্যে পড়ে।
'এখানে শিল্পীদের জায়গা করে দেওয়ার মাধ্যমে তাদের প্রতিভা তুলে ধরা হচ্ছে। আমি বাংলাদেশের প্রথম পপ কালচার ম্যাগাজিন নিয়ে কাজ করা শুরু করি। তখন থেকেই আমার লক্ষ্য ছিল এ ম্যাগাজিনের মাধ্যমে বাংলাদেশের পপ আর্টিস্টদের তুলে ধরা। যে কমিকগুলো ম্যাগাজিনে দেওয়া হয়, এগুলো আর্টিস্টাররা নিজেরাই ডিজাইন করেন। বাংলা ও ইংরেজি দুভাবেই এগুলো ছাপানো হয়, যেন বাংলাদেশের শিল্পীদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্থান করে দেওয়া সম্ভব হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'কসপ্লে আয়োজন করার পেছনে অন্যান্য কারণ থাকলেও আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সিরিজগুলোতে অভিনয় করা সে অভিনেতাদের একদিন আমাদের দেশের কসপ্লে প্রতিযোগিতায় নিয়ে আসা। আমাদের দেশের কসপ্লে আয়োজন একদিন বিশ্বের অন্য দেশের মতো বিশাল আকারে অনুষ্ঠিত হবে। যে কসপ্লেয়ারদের মধ্যে প্রতিভা আছে তাদেরকে বিশ্বের অন্য দেশে প্রতিযোগিতায় সুযোগ করে দেওয়া নিয়েও আমরা ভাবছি। হয়তো একদিন অন্যান্য দেশগুলো আমাদের দেশকে এ পপ কালচারের মধ্য দিয়েই চিনবে।'
কসপ্লেয়ারদের বেশিরভাগ তাদের পছন্দের চরিত্রে এতটাই ডুবে যান যে, তাদের চিন্তার জগৎ থেকে বাস্তব জগৎ সবটাতেই সে চরিত্র প্রভাব ফেলে। চরিত্রগুলোর মতো করে একেকজন নিজেদের সাজিয়ে তোলেন, কথা বলেন এবং অঙ্গভঙ্গি করেন। কসপ্লেয়ারদের একত্রে দেখলে মনে হবে এ যেন এক ভিন্ন জগৎ!
[ফিচারে ব্যবহৃত ছবি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ফেইসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত]