বঙ্গবাজার: হকার্স মার্কেট থেকে শুরু, পরে যেভাবে তৈরি পোশাকের সর্ববৃহৎ বিক্রয়কেন্দ্র
নিতান্তই এক হকার্স মার্কেট
১৯৬৮ সালের ১ মে চালু হয় কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন। তার আগ পর্যন্ত ঢাকার প্রধান রেলওয়ে স্টেশন ছিল গুলিস্তানের পার্শ্ববর্তী ফুলবাড়িয়ায়।
১৯৬৫ সালের দিকে এই স্টেশনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে একটি বাজার। মূলত হকাররা মাথায় পণ্যের বোঝা চাপিয়ে রোজ এখানে আসতেন বিক্রি করতে। তারা বিক্রি করতেন বিভিন্ন মুখরোচক খাবার, পানীয়, শো-পিস এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি।
এভাবেই খুব সাদাসিধেভাবে গড়ে ওঠে বঙ্গবাজার, নিতান্তই একটি 'হকার্স মার্কেট' হিসেবে। তখন কেউই বোধহয় আঁচ করতে পারেনি, এই বঙ্গবাজারই একসময় হয়ে উঠবে দেশের সবচেয়ে বড় তৈরি পোশাকের পাইকারি ও খুচরা বিক্রয়কেন্দ্র।
যদিও কয়েক বছর পরই পুরনো রেলওয়ে স্টেশন বন্ধ হয়ে যায়, তারপরও কিন্তু রমরমা অবস্থা জারি থাকে বঙ্গবাজারের। কেননা এটিই ছিল ওই এলাকার বেশকিছু ব্যস্ত সড়কের সংযোগস্থল।
বঙ্গবাজার যখন ডিআইটির অধীনে, তখন কুমতলব আঁটতে থাকে হকাররা। জায়গাটিকে পাকাপাকিভাবে নিজেদের দখলে নিয়ে আসার লক্ষ্যে তারা অবৈধভাবে গড়ে তুলতে থাকে অস্থায়ী টিনশেড।
১৯৭৫ সালে ঢাকা মিউনিসিপ্যাল কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় টিনশেডগুলো গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে একটি মার্কেট বিল্ডিং গড়ে তোলার।
কিন্তু সহসাই বাস্তবায়িত হয় না তাদের সেই প্রকল্প। কেননা বঙ্গবাজার যে জমির উপর গড়ে উঠেছিল, সেটির প্রকৃত মালিক ছিল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তারা রাজি হয়নি মালিকানার হাতবদল করতে।
বরং রেলওয়ে বিভাগ বঙ্গবাজারের দোকান মালিকদের সঙ্গে একটি চুক্তি করে ফেলে যে দোকান মালিকরা ফি-বছর জমির অংশ ইজারা নেবে, এবং বৈধভাবে তাদের ব্যবসা চালাবে।
এক বিরাট রদবদল
প্রায় এক দশক পরের কথা। ১৯৮৫ সালে বঙ্গবাজারের জায়গাটি আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয় ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের কাছে। এর বছর চারেক পর কর্পোরেশন সম্পন্ন করে তাদের পরিকল্পিত শপিং সেন্টারের নির্মাণকাজ।
১৯৯০ সাল নাগাদ বঙ্গবাজার পুরোপুরি রূপান্তরিত হয় দেশের তৈরি পোশাক বিক্রির অন্যতম কেন্দ্রস্থলে। ২১,২৫০ বর্গফুট জমির উপর দাঁড়িয়ে থাকা বঙ্গবাজার নিজের সঙ্গে জুড়ে নেয় পার্শ্ববর্তী আরো তিনটি মার্কেটকে।
এখনো বঙ্গবাজারের রয়েছে মোট চারটি ইউনিট। বঙ্গবাজার শপিং কমপ্লেক্স ছাড়াও এর অংশ হিসেবে রয়েছে গুলিস্তান, মহানগরি ও আদর্শ ইউনিট। সব মিলিয়ে দোকানের সংখ্যা প্রায় হাজার পাঁচেক।
মজার ব্যাপার হলো, নিচ তলায় কংক্রিটের পিলার থাকলেও, গোটা বঙ্গবাজার শপিং কমপ্লেক্সটি নির্মিত হয়েছে টিন ও কাঠ দিয়ে।
বঙ্গবাজারে পাইকারি ও খুচরাভাবে শার্ট, প্যান্ট, ট্রাউজার, জ্যাকেট, অন্তর্বাস, ফতুয়া, সোয়েটারের মতো তৈরি পোশাক তো বিক্রি হয়ই, সেইসঙ্গে আরো বিক্রি হয় সালোয়ার কামিজ, শাড়ি, জুতো।
পুরোপুরি নতুন পোশাক যেমন থাকে, তেমনই সেকেন্ড হ্যান্ড কিংবা কারখানা থেকে বাতিল হওয়া অনেক পোশাকও এখানে পাওয়া যায় খুবই সস্তা দামে। তাই তো দেশি সাধারণ ক্রেতা ও বিক্রেতা থেকে শুরু করে ভারত, নেপাল, ভুটান, ইরান এমনকি রাশিয়ার অনেক ব্যবসায়ীও এখানে থেকে পণ্য সংগ্রহ করে নিয়ে যান।
সারাবছর এখানে ব্যবসার অবস্থা আহামরি না হলেও, শীতের মৌসুমে বিক্রির বেশ তোড়জোড় দেখা যায়। আর ব্যবসার শ্রেষ্ঠ সময়টা হলো রমজান মাস। বছরের ৭০ শতাংশই বিক্রিই হয় এই এক মাসে।
অগ্নিকাণ্ড বঙ্গবাজারে নতুন ঘটনা নয়
দেশের অনেকের কাছেই হয়তো কেনাকাটার প্রিয় গন্তব্য বঙ্গবাজার। কিন্তু বিশ্বজুড়ে প্রথম এর নামডাক ছড়িয়ে পড়ে এক মর্মান্তিক কারণে।
নতুন রূপে পথচলা শুরুর মাত্র পাঁচ বছরের মাথায়, ১৯৯৫ সালে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত হয় এই মার্কেটের সিংহভাগ দোকান।
সেই সময়ে প্রায় ২,২০০ দোকান আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সর্বস্বান্ত হন হাজারো দোকানমালিক। সবমিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কয়েক কোটিতে দাঁড়ায়।
নতুন করে মার্কেট তৈরির লক্ষ্যে কর্পোরেশন নিজে দেয় ৪০ লাখ টাকা, আর সরকারের কাছ থেকে পায় এক কোটি টাকা। এছাড়াও প্রত্যেক দোকানদারের কাছ থেকে নেওয়া হয় পাঁচ হাজার টাকা করে।
তাছাড়া পাঁচ বছর আগেও, ২০১৮ সালের ২৪ জুলাই, আরেকটি অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয় পুড়ে যায় বঙ্গবাজারের গুলিস্তান ইউনিটের বেশকিছু দোকান।
নিয়মিত সতর্কতা, তবু নেওয়া হয়নি ব্যবস্থা
২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের একটি পরিদর্শক কমিটি বঙ্গবাজারের চারটি ইউনিটকেই 'মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ' হিসেবে চিহ্নিত করে।
একই বছরের ১৭ মে তারা বঙ্গবাজার কর্তৃপক্ষকে একটি নোটিশ দেয়। সেখানে মার্কেটের বিভিন্ন ত্রুটিবিচ্যুতির কথা উল্লেখ করে সেগুলো নিরসনের জন্য সুপারিশমালাও যোগ করে দেয়। বলে দেয় ৩০ দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে।
কিন্তু বলাই বাহুল্য, সেসব সুপারিশে কেউ কর্ণপাত করেনি। তাই একই বছরের ১০ ডিসেম্বর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের আরেকটি দল যায় পুনরায় বঙ্গবাজার পরিদর্শন করতে। এবার তারা মার্কেটের অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থাকেও 'মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ' হিসেবে অভিহিত করে।
২০১৮ মাসের ২৪ জুলাইয়ের অগ্নিকাণ্ডের পরও ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কয়েকবার নোটিশ দেয় মার্কেট কর্তৃপক্ষকে।
তাদের মতে, যেহেতু মার্কেটটি পুরোটাই কাঠের তৈরি, তাই আগুন লেগে জরুরি অবস্থা তৈরি হলে তা নিরসনে কেবল অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র যথেষ্ট নয়।
২০১৯ সালের ১ এপ্রিল একটি সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ বঙ্গবাজার এবং এর আশেপাশের দালানগুলোকে অগ্নি নিরাপত্তার নিরিক্ষে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু সেই সাইনবোর্ডও নামিয়ে ফেলা হয় কিছুদিন পরেই।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিনের মতে, মার্কেট কর্তৃপক্ষকে তারা সব মিলিয়ে অন্তত দশবার নোটিশ দিয়েছিলেন।
কিন্তু এতবার সতর্ক করে দেওয়ার পরও মার্কেট কর্তৃপক্ষ কিংবা দোকান মালিকরা কেউই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেননি। তারা পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলেও, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নিজেরাই এ ব্যাপারে কিছু করা থেকে বিরত থেকেছে।
বঙ্গবাজারই শুধু নয়...
এ সিদ্ধান্তে তাই পৌঁছানোই যায় যে, সামষ্টিক অবহেলার ফলেই বঙ্গবাজারে মঙ্গলবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটল।
শুধু বঙ্গবাজারই নয়, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ২০১৭ সালের এক বিবৃতি অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকার ৯৬ শতাংশ বিপণিবিতানই 'ঝুঁকিপূর্ণ'।
কিন্তু সেই থেকে গত পাঁচ বছরে সরকারের পক্ষ থেকে এমন কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ চোখে পড়েনি, যা এসব জনপরিসর ও ব্যবসায়িক কেন্দ্রকে ঝুঁকির মুখ থেকে রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।
তাই দেশজুড়ে সাম্প্রতিক সময়ে যে উপর্যুপরি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে চলেছে তা অব্যাহত থাকলে নিকট ভবিষ্যতে আমাদেরকে হয়তো আরো অনেক নতুন নতুন ট্র্যাজেডির সম্মুখীন হতে হবে।