এক আমের দামই ২৫ হাজার টাকা!
সাদা ট্যাঙ্ক টপ পরে জাপানে নিজের খামারে একটি গ্রিনহাউজের ভেতরে পাকা আম সংগ্রহ করছিলেন হিরোইয়ুকি নাকাগাওয়া। পরিপক্ক ও রসালো এই আমগুলো প্যাকিং করে ডেলিভারির জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। বাইরে তাপমাত্রা মাইনাস আট ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেও, জাপানের হোক্কাইডো দ্বীপের অটোফুকে শহরে তার খামারের গ্রিনহাউজের ভেতরে তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ব্লুমবার্গ সূত্রে জানা গেছে, নাকাগাওয়া তার খামারে উৎপাদন করেন বিশ্বের সবচেয়ে দামি আম; প্রতিটি আমের মূল্য বর্তমানে ২৩০ ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২৫ হাজার টাকা)!
২০১১ সাল থেকে জাপানের তুষারময় তোকাচি অঞ্চলে আম উৎপাদন করছেন নাকাগাওয়া। কিন্তু শুরুতে কোনোদিন ভাবেননি যে টেকসই কৃষি নিয়ে তার করা একটি এক্সপেরিমেন্ট থেকে একদিন বিশ্বের সবচেয়ে দামি আমের ফলন হবে।
"শুরুতে কেউই আমার কথায় গুরুত্ব দেয়নি", বলেন ৬২ বছর বয়সী নাকাগাওয়া। এই পেশায় আসার আগে একটি পেট্রোলিয়াম কোম্পানি চালাতেন তিনি। "এখানে হোক্কাইডোতে আমি প্রকৃতি থেকেই প্রাকৃতিক কিছু সৃষ্টি করতে চেয়েছিলাম", যোগ করেন নাকাগাওয়া।
তেলের ব্যবসায়ে মূল্যের উর্ধ্বগতি দেখে এই ব্যবসার বাইরে কিছু করার ভাবনা আসে তার মাথায়। এরপরেই তিনি আমের আবাদ শুরু করেন। মিয়াজাকির দক্ষিণের একটি অঞ্চলের একজন আম চাষীর নির্দেশনায় তিনি এই আবাদে নামেন। ওই কৃষক দাবি করেছিলেন, শীতের মৌসুমেও ফল জন্মানো সম্ভব। এরপরেই নাকাগাওয়া তার খামার গড়ে তোলেন এবং 'নোরাওয়ার্কস জাপান' নামে তার স্টার্টআপ উদ্যোগ শুরু করেন। কয়েক বছর পর তিনি তার আমের ব্র্যান্ডকে 'হাকুগিন নো তাইয়ো' নামে ট্রেডমার্ক করিয়ে নেন। ইংরেজিতে এই নামের অর্থ দাঁড়ায় 'সান ইন দ্য স্নো'।
হোক্কাইডো দ্বীপ যে দুটি জিনিসের জন্য বিখ্যাত- তুষার এবং অনসেন হট স্প্রিং (প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত উষ্ণ পানি); নাকাগাওয়া এই দুটিকে কাজে লাগিয়েই বাজিমাত করেছেন। শীতকালে তিনি বরফ সংগ্রহ করে জমিয়ে রাখেন এবং গরমকালে সেগুলো তার গ্রিনহাউজকে ঠান্ডা রাখতে ব্যবহার করেন, ফলে আমগাছে মুকুল দেরিতে আসে। তারপর শীতকালে তিনি প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত উষ্ণ পানি ব্যবহার করেন তার গ্রিনহাউজকে উষ্ণ রাখতে এবং মৌসুমে প্রায় ৫০০০ আম উৎপাদন করেন।
এই প্রক্রিয়ার ফলে শীতকালে আমগুলো পাকতে শুরু করে। আর শীতে পোকামাকড়ের উৎপাত কম থাকায় আম ভালো রাখতে কীটনাশক ব্যবহার করতে হয় না। হোক্কাইডোর কম আর্দ্রতাসম্পন্ন জলবায়ুর কারণে মোল্ড-রিমুভিং কেমিক্যালেরও খুব বেশি দরকার পড়ে না। সেই সঙ্গে শীতকালে চাষীদের হাতে কাজও কম থাকে, তাই শীতে আম পাকলে জাপানে কর্মী স্বল্পতার সময়টায়ও কাজ করার জন্য কর্মী পাওয়া যায়।
আর এই টেকসই উপায়ে আমের ফলন হওয়ায় আমগুলোর স্বাদও বহুগুণ বেড়ে যায় বলে দাবি করেন নাকাগাওয়া। তিনি দাবি করেন, তার উৎপাদিত আমগুলো সাধারণ আমের চেয়ে অনেক মিষ্টি এবং সুগার কন্টেন্ট প্রায় ১৫ ডিগ্রি ব্রিক্স। সেই সাথে আমগুলোর গঠনবিন্যাস একেবারে মাখনের মসৃণ।
আমগুলোর উৎপাদনের যে অভিনব প্রক্রিয়া তা ক্রেতা ও খুচরা বিক্রেতাদের আকৃষ্ট করেছে। ২০১৪ সালে ইসেতান নামক একটি ডিপার্টমেন্ট স্টোর টোকিওর শিনজুকুতে তাদের দোকানে নাকাগাওয়ার উৎপাদিত একটি আম প্রদর্শন করে, যেটি পরে প্রায় ৪০০ ডলারে বিক্রি হয়। একটি আমের এত দাম হওয়ায় স্বভাবতই তা খবরের শিরোনামে উঠে আসে। আস্তে আস্তে আমটির আরও চাহিদা তৈরি হয় এবং এটি পাওয়াই কঠিন হয়ে পড়ে। যেসব অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে ক্রেতারা এই আমটি কিনতে পারবেন, প্রায় সব জায়গায়ই বড় বড় লাল অক্ষরে 'সোল্ড আউট' বা বিক্রি হয়ে গেছে লেখা ভেসে ওঠে।
নাকাগাওয়ার ক্লায়েন্টদের মধ্যে আছেন ২০২২ সালে এশিয়ার সেরা নারী শেফ নাৎসুকো শোজি, যিনি তার ম্যাঙ্গো ফ্লাওয়ার কেকে এই আমটি ব্যবহার করেন। জাপানের বাইরেও তার ক্রেতা আছে এবং হাই-এন্ড রিটেইলারদের কাছে তিনি এই আম পাঠান।
সেই থেকে নাকাগাওয়া শীতকালে ফল উৎপাদনে অপ্রত্যাশিত লাভ খুঁজে পেয়েছেন। "যেহেতু আমরা কীটনাশক ব্যবহার করি না, তাই লুপিসিয়া নামক একটি চা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ম্যাঙ্গো টি বানাতে আমাদের আমগাছের পাতা কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
কিন্তু এখনও পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন নাকাগাওয়া। তিনি এই একই পদ্ধতিতে অন্যান্য গ্রীষ্মমন্ডলীয় পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে তোকাচিকে শীতকালে ফল উৎপাদনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চান এবং এর মাধ্যমে স্থানীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে চান। এখন তিনি এ পদ্ধতিতে পিচ ফল উৎপাদনের কথা ভাবছেন।
"আমি আম পছন্দ করি, কিন্তু পিচ আরও বেশি পছন্দ করি", বলেন নাকাগাওয়া।