ডিবিএল গ্রুপ: কর্মীদের হয়ে মূল্যস্ফীতি মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে প্রতিষ্ঠান
শ্রমিকদের কাছে ন্যায্যমূল্যে নিত্যপণ্য বিক্রির দোকানের নাম 'বন্ধন' রাখে কোম্পানিটি। ২০০৮ সালে দেশের একটি শীর্ষ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক – ডিবিএল গ্রুপ এটি চালু করে। পরে তাদের দেখাদেখি আরও অনেক প্রতিষ্ঠানও গ্রহণ করে এই আইডিয়া।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ৩৬৮ ধরনের পণ্য পাওয়া যায় এই দোকানে। যারমধ্যে রয়েছে খাদ্যপণ্য, ভোজ্যতেল, টয়লেট্রিজ, ঘরবাড়ি পরিচ্ছন্ন রাখার সরঞ্জাম, চা, কোমল পানীয় থেকে শুরু করে নানান সামগ্রী। কর্মীদের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো- এই দোকান থেকে কেনাকাটায় ভালো মূল্যছাড় পান তারা।
কিন্তু, কীভাবে এই উদ্যোগ শিল্পগোষ্ঠীটির সমৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করেছে, আর কেনইবা তার দরকার হয়েছিল? অন্যান্য অনেক সাফল্যের কাহিনির মতোই – এক্ষেত্রেও একটি সংকট মূল প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। সঠিক সিদ্ধান্তই যে সংকটকে পরিণত করে সুযোগে।
২০০৭-০৮ অর্থবছরে দুই অঙ্কের মূল্যস্ফীতির মতো প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়েছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি। এতে দেশের তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাতের শ্রমিকদের জীবিকানির্বাহ কঠিন হয়ে পড়ে।
নতুন কোনো ওয়েজ বোর্ড বা মজুরি কাঠামোও অচিরেই ঘোষণার সম্ভাবনা ছিল না। এই সংকটকালে সাহসী এক পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ডিবিএল গ্রুপ এবং নিজেদের কর্মীদের জন্য ১৫ শতাংশ বিশেষ বেতন বৃদ্ধি বাস্তবায়ন করে।
এতে ওই শিল্প এলাকার অন্যান্য কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ ছড়িয়ে পরে। তারা নিজ নিজ কারখানা মালিকদের কাছে একইভাবে মজুরি বৃদ্ধির দাবি তোলে।
ফলে আসন্ন বড় ধরনের গোলযোগের উদ্বেগ দেখা দেয় সংশ্লিষ্ট শিল্পে, এবং এরকম পদক্ষেপ না নিতে কারখানাগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
প্রতিক্রিয়া হিসাবে, ১৫ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি বাস্তবায়নকারী ডিবিএলের ব্যবস্থাপকগণ, একটি নতুন কৌশল গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন – যা কেবল শিল্প অস্থিরতা রোধ করবে না বরং শ্রমিকরা যেসব আর্থিক প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ছে – তারও সমাধান করবে।
এভাবেই চালু হয় 'বন্ধন' নামের সেই যুগান্তকারী সমাধান, যেখানে মজুরি বৃদ্ধির পরিবর্তে ৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকিতে কারখানা কর্তৃপক্ষ দোকানটিতে নিত্যসামগ্রী বিক্রি করে।
এই উদ্যোগটি সফল হওয়ায়, তাদের দেখাদেখি আরও ১০০টির বেশি কারখানা কর্তৃপক্ষ ন্যায্যমুল্যের দোকান চালু করে। ফলে শ্রমিকদের জন্যও সুলভমূল্যে নিত্যপণ্য পাওয়া সহজ হয়েছে।
এক্ষেত্রে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা রাখা প্রতিষ্ঠান ডিবিএল গ্রুপ, নিজেদের ব্যবসায়ীক কার্যক্রম পরিচালনায় – এমনই বিভিন্ন রূপান্তরমূলক উদ্যোগের মাধ্যমে টেকসইতাকে ধরে রাখছে।
যেমন প্রতিষ্ঠানটি লক্ষ করে যে, মাত্র ৩০ শতাংশ পোশাক শ্রমিক মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে সন্তান জন্মদানের পর কর্মস্থলে ফিরে আসে। কারখানায় শিশুদের স্তন্যদানের কোনো আলাদা ব্যবস্থা না থাকাই যার অন্যতম কারণ। কারখানায় এই সুবিধাসহ যেন ডে-কেয়ার সেন্টারও থাকে – তা নিশ্চিত করেন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ।
এতে সন্তুষ্ট দক্ষ কর্মীরা তাদের কারখানা ছেড়ে অন্যত্র যায়নি খুব একটা। যেমন স্তন্যদানকারী মায়েদের চাকরি ছাড়ার হার প্রায় অর্ধেক কমেছে।
এই উদ্যোগে অনুপ্রাণিত হয়ে, ইউনিসেফ, বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) এবং বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) –- ১,৩০,০০০ নারী শ্রমিকের কর্ম-পরিবেশের উন্নতি করতে এবং তাদের উন্নত পুষ্টি পরিষেবা দিতে একটি প্রকল্প শুরু করে। .
এই উদ্যোগের আওতায় আরও রয়েছে ৮,০০০ শিশুর জন্য ডে-কেয়ার সেবা।
শুরুতে ৮০টি কারখানায় চালু হয় এই প্রকল্প, যা পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের ৪ হাজারের এর বেশি কারখানায় সম্প্রসারিত হয়েছে।
সুতা উৎপাদনে উন্নত প্রযুক্তি, পরিবেশসম্মতভাবে বস্ত্র প্রক্রিয়াকরণ, সম্পদ-সাশ্রয়ী প্রযুক্তি, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার এবং ক্ষতিকর রাসায়নিকের নিঃসরণ শূন্য রাখার অঙ্গীকারসহ নানান পদক্ষেপও নিয়েছে ডিবিএল গ্রুপ।
এছাড়া, নিজ সংগঠনে নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলার দিকেও মনোযোগ দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। টেকসইতার প্রতিবেদনও প্রকাশ করছে তারা।
টেকসইতার প্রতিবেদন হলো– এমন এক ধরনের নন-ফাইন্যান্সিয়াল (আর্থিক নয়) তথ্যপ্রকাশ – যেখানে পরিবেশগত, সামাজিক ও সুশাসনের নানান মানদণ্ডে কোনও কোম্পানি টেকসইতার লক্ষ্য অর্জনে কতটুকু অগ্রগতি করছে, তা প্রকাশ করে।
লিঙ্গ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিতে, মহিলা সুপারভাইজারদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের একটি কর্মসূচিও বাস্তবায়ন করেছে তারা।
পারিবারিক মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান- ডিবিএল গ্রুপ ১৯৯১ সালে যাত্রা শুরু করে। কোম্পানির ওয়েবসাইট অনুসারে, তাদের প্রথম কোম্পানির নাম ছিল দুলাল ব্রাদার্স লিমিটেড (ডিবিএল)।
গ্রুপের ব্যবস্থাপনাপনা পরিচালক এম এ জব্বারের ভাই দুলালকে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে দখলদার পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করেছিল।
সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন খাতে সম্প্রসারিত এক শিল্পগোষ্ঠীতে রূপ নেয় ডিবিএল। পোশাক, টেক্সটাইল, টেক্সটাইল পেইন্টিং, ওয়াশিং, গার্মেন্টস এক্সেসরিজ, সিরামিক টাইলস, ফার্মাসিউটিক্যালস, ড্রেজিং, খুচরা ও ডিজিটাল ট্রান্সফর্মেশন সেবাসহ আরও নানান খাতে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে বলে ওয়েবসাইটে উল্লেখ রয়েছে।
বর্তমানে গ্রুপটি ২৪টি শিল্প ইউনিট পরিচালনা করছে, যাতে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার জনের। গতবছর তারা ৮৭০ মিলিয়ন ডলারের আকর্ষনীয় বার্ষিক টার্নওভার অর্জন করে।
ডিবিএলের টেকসইতা অর্জনের বিভিন্ন উদ্যোগের স্বীকৃতি হিসেবে সম্প্রতি এম এ জব্বারকে ২০২৩ সালের লোকাল এসডিজি পাইওনিয়ার সম্মাননা দিয়েছে জাতিসংঘের গ্লোবাল কমপ্যাক্ট। মূলত যারা জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে অগ্রণী অবদান রাখছেন তাদের এই তালিকায় রাখা হয়।
গত ছয় বছর ধরে স্থানীয় এসডিজি পথপ্রদর্শকদের এই সম্মাননা দিয়ে আসছে গ্লোবাল কমপ্যাক্ট। টানা দুইবারসহ ডিবিএল মোট তিনবার এই সম্মাননা পেয়েছে।
এবিষয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সাথে আলাপকালে এম এ জব্বার বলেন, টেকসইতাকে ব্যবসায় 'টিকে থাকা ও প্রবৃদ্ধি অর্জনের' পাথেয় বলে মনে ডিবিএল গ্রুপ। ডিবিএলের 'সাসটেইনেবিলিটি ৫.০ স্ট্র্যাটেজি'র পাঁচটি স্তম্ভ: মানুষ, (উৎপাদন) প্রক্রিয়া, পণ্য, সমাজ ও পরিবেশ। অর্থাৎ, সামাজিক ও পরিবেশগত টেকসইতাকে সমন্বয়ের সার্বিক এক উদ্যোগ।
তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, সামাজিক ও পরিবেশগত টেকসইতার অর্জনে আমরা যেসব উদ্যোগ নেই – তা যেন অন্যান্য শিল্পের জন্যও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়, আমরা সে চেষ্টাই করি।
২০২৩ সালকে আত্ম-উন্নয়ন ও রূপান্তরের বছর হিসেবে নির্ধারণ করেছে ডিবিএল। এরই অংশ হিসেবে, ৫ হাজার কর্মকর্তাকে বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ ও সনদ গ্রহণের সুযোগ দিচ্ছে।
'একইসঙ্গে, গ্রুপের ভবিষ্যৎ প্রধান নির্বাহী খুঁজে বের করতে আমাদের একটি ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি প্রোগ্রাম রয়েছে' বলেও জানান তিনি।