তাপপ্রবাহে শরীর ঠান্ডা রাখতে কোন ধরনের পোশাক সবচেয়ে ভালো?
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা; আসছে একের পর এক তীব্র তাপদাহ। এমন পরিস্থিতিতে দেহ ঠান্ডা রাখতে ঠিক কোন ধরনের পোশাক পরতে হবে; সেটা জানা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আবহাওয়া বিবেচনায় বুঝেশুনে পোশাক পরলে দেহে প্রকৃত তাপমাত্রার তুলনায় প্রায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা কম অনুভব হতে পারে। এতে ফ্যান কিংবা এসির মতো যন্ত্র ব্যবহারের পরিমাণ কমবে, ফলে গ্রিন হাউজ গ্যাসের নিঃসরণও কম হবে।
তবে তাপমাত্রা বিবেচনায় যথাযথ পোশাক পরিধানের ক্ষেত্রে বেশকিছু বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। এক্ষেত্রে প্রথমত কাপড়ের রং বেশ গুরুত্বপূর্ণ। রংয়ের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষই মনে করেন যে, গরমে কালো রংয়ের কাপড় অপেক্ষা সাদা কাপড় পরাই বেশি সুবিধাজনক — কেননা সাদা রঙ সূর্যের রশ্মি প্রতিফলিত করতে পারে।
সাধারণভাবে এমন ধারণা যথাযথ হলেও ব্যক্তির পোশাক কতটুকু পাতলা কিংবা ফিট; তার ওপরও বেশকিছু বিষয় নির্ভর করে। কারণ বাইরে থেকে যে শুধু তাপ দেহের সংস্পর্শে আসে এমনটা নয়; বরং দেহ থেকেও তাপ বের হয়। দেহ থেকে বের হওয়া তাপ সাদা পোশাকে প্রতিফলিত হয়ে ত্বকে পালটা তাপ সৃষ্টি করতে পারে।
১৯৮০ সালে আরব উপদ্বীপ, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় থাকা আদিবাসী বেদুইন গোষ্ঠীর ওপর এ সম্পর্কিত একটি গবেষণা করা হয়। তারা মূলত মরুভূমিতে সাদা নয়, বরং কালো পোশাকই পরে থাকেন। কিন্তু গবেষণায় দেখা যায়, আদিবাসী সদস্যরা কালো বা সাদা যে ধরনের পোশাকই পরতেন না কেন, তাদের তাপ অনুভবের মাত্রা রংয়ের ভিন্নতার কারণে ভিন্ন না হয়ে বরং অনেকটা একই ছিল।
এর কারণ হচ্ছে কালো রঙের কাপড় সূর্য থেকে আসা তাপ যেমন শোষণ করে ঠিক তেমনি দেহ থেকে আসা তাপও শোষণ করতে পারে। ঠিক এমনটাই ঘটেছে বেদুইন আদিবাসীদের ক্ষেত্রে।
এক্ষেত্রে বেদুইনেরা কালো রঙের পোশাক পরলেও সেটা বেশ ঢিলেঢালা হয়। এতে করে বিশেষ করে যখন আশেপাশে বাতাস থাকে; তখন কাপড় ও দেহের মাঝে থাকা তাপ অনেকটা চিমনি আকারে বাইরে চলে যায়। তাই কালো কাপড় পরা সত্ত্বেও গরম কম অনুভূত হয়।
ঐ গবেষণায় বলা হয়, "কালো কাপড় যে পরিমাণ অতিরিক্ত তাপ শোষণ করে, সেটি দেহে পৌঁছানোর আগেই ঢিলেঢালা অংশ দিয়ে বাইরে চলে যায়।"
তাই দেহে আরাম অনুভূত হওয়ার ক্ষেত্রে কাপড়ের রং অপেক্ষা পোশাক ঢিলেঢালা হওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে কেউ যদি কম ঢিলেঢালা পোশাক পরতে পছন্দ করেন, সেক্ষেত্রে সাদা পোশাক পরাই উত্তম।
কাপড় কী ধরনের সুতা দিয়ে তৈরি সেটাও দেহের আরামের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। এ বিষয়ে স্টাইললিস্ট ও ফ্যাশন রাইটার হেদার নিউবার্গার বলেন, "আপনি গজ কিংবা শিফনের তৈরি কম ঢিলেঢালা পোশাক পরলে গরম বেশি লাগতে পারে।"
সাউথইস্টার্ন লুইজিয়ানা ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক রেইট অ্যালাইন বলেন, "পোশাকের ক্ষেত্রে এমন ধরনের কাপড় ব্যবহার করা উচিত যার ভেতর দিয়ে জলীয় বাষ্প চলাচল করতে পারে। যাতে করে ঘাম বের হয়ে যেতে বাধা তৈরি না হয়। তবে তুলার তৈরি কাপড়ে এটি ততটা কার্যকর হয় না।"
প্রায় সকল ধরনের কাপড়ই দেহ থেকে বের হওয়া অবলাল বিকিরণকে ধরে রাখে। এটি ঠান্ডা আবহাওয়ায় গরম থাকতে সাহায্য করে। কিন্তু গরমের দিনের জন্য এটি আদর্শ নয়। তাই গরমে বাতাস সহজে চলাচল করতে পারে এমন সব কাপড় বাছাই করা উচিত।
তবে দেহকে ঠান্ডা করতে যে ঘাম বের হয়, সেটিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কটন খুব সহজে আর্দ্রতা শোষণ করলেও দ্রুত শুকাতে পারে না। তাই দেহ ঘেমে গেলে এই কাপড় অনেকক্ষণ ভেজা অবস্থায় থাকে; যা অস্বস্তির সৃষ্টি করে। একইভাবে বাতাস চলাচলের জন্য বহুল ব্যবহৃত লিনেন কাপড়ও শুকাতে বেশ দেরি হয়। তবে মেরিনো উলের কাপড় আবার ব্যতিক্রম। কেননা এটির ভেতর দিয়ে একইসঙ্গে বাতাস চলাচল করতে পারে; ঠিক তেমনি গন্ধ ধরে না রেখে আর্দ্রতা কমিয়ে ফেলে।
অন্যদিকে নাইলন ও পলিস্টার কাপড় খুব দ্রুত শুকিয়ে গেলেও গন্ধ ধরে রাখে। গবেষণায় দেখা যায়, পলিস্টার নাইলন অপেক্ষা বেশি আর্দ্রতা শোষণ করতে পারলেও ধীরে শুকায়। নাইলন ও পলিস্টারের মতো সিনথেটিক ফাইবার ভিজে গেলে বেশ অস্বস্তির সৃষ্টি করে।
জামাকাপড় ত্বককে সূর্যের তাপ থেকে রক্ষা করে। কিন্তু নিজেকে ঠান্ডা রাখার ক্ষেত্রে দেহে কাপড়ের অংশ যত কম থাকবে তত সুবিধার। এক্ষেত্রে ত্বক ও পরিবেশের মধ্যে খুব সহজেই তাপ বিনিময় করা সম্ভব হয়। তবে এক্ষেত্রে ত্বককে অতিবেগুনী রশ্মি থেকে রক্ষা করার মতো বিষয়ও বিবেচনায় রাখতে হবে।
গরম থেকে বাঁচতে দেহে কাপড়ের অংশ কম রাখা নিশ্চয়ই কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। এক্ষেত্রে সবকিছুকে বিবেচনায় রেখে বিজ্ঞানীরা গরম আবহাওয়া উপযোগী নতুন ধরনের ফ্যাব্রিক তৈরির চেষ্টা করছেন। নাইকি কিংবা অ্যাডিডাসের মতো স্পোর্টস কোম্পানিগুলোও স্মার্ট ফ্যাব্রিক তৈরিতে মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে।
গবেষণায় এমআইটির বিজ্ঞানীরা দেখেন, দেহ থেকে তাপ কার্যকরভাবে দূরে বিকিরণের জন্য মূলত এমন ফ্যাব্রিকের প্রয়োজন যা দৃশ্যমান আলোকে বাধা প্রদান ও প্রতিফলিত করতে পারবে এবং সূর্যের আলো শোষণ করবে না। একইভাবে ঐ ফ্যাব্রিক দেহ থেকে বের হওয়া ইনফ্রারেডকে বাধা প্রদান করবে না এবং তাপকে আটকে রাখার পরিবর্তে শরীর থেকে বেরিয়ে যেতে দেবে।
এক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা দেখেন যে, নাইলন ও পলিস্টারের ফাইবারকে এক মাইক্রোমিটার ব্যাসে সূক্ষ্ম করে এবং সেগুলোকে ৩০ মাইক্রোমিটার পুরু সুতার বুননে তৈরি পোশাক গরমে বেশ আরামদায়ক হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা এমন এক ধরনের সিনথেটিক ফাইবার তৈরি করেছেন যেটি বাহ্যিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে এর গঠনে পরিবর্তন আনতে পারে। ফলে এই ফাইবারের তৈরি পোশাক পরলে ব্যক্তি বেশ আরাম অনুভূতি পাবে।
অন্যদিকে সহযোগী অধ্যাপক রেইট অ্যালাইন মনে করেন, দেহ ঠান্ডা রাখার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে ভেজা কাপড় পরা। কাপড়ের পানি শুকিয়ে যেতে প্রয়োজন হয় তাপের। ফলে দেহ থেকে বের হওয়া তাপ ভেজা কাপড় শোষণ করতে পারে, ত্বককে ঠান্ডা রাখতে পারে এবং শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে।
একটি সাদা টি-শার্ট পরলেই যে গরমে স্বস্তি পাওয়া যাবে বিষয়টি এতটা সহজ নয়। বরং বিষয়টি বেশ জটিল এবং এক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি প্রভাবক রয়েছে। উপযুক্ত ফ্যাব্রিক ব্যবহার করা, আবহাওয়া অনুযায়ী পোশাক ফিট থাকা এবং মাঝে মাঝে শরীর ভিজিয়ে রাখতে পারলে গরমে দেহ যথাসম্ভব ঠান্ডা রাখা সম্ভব হবে।