আজিমপুর কবরস্থানের ল্যান্ডস্কেপিং: যোগ হয়েছে ফুল-ফলের গাছ, কাচের দেয়াল, আলো...
দুই বছর আগেও আজিমপুর থেকে নিউমার্কেটের দিকে যাওয়া রাস্তাটি অন্ধকারাচ্ছন্ন ও ভীতিকর মনে হতো। অথচ আজিমপুর কবরস্থানের পাশের সড়কটি এখন অভিজাত অনুভূতি দেয়। কারণ কবরস্থানটি এখন হয়ে উঠেছে দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ এক সবুজের সমারোহ।
সংস্কার করা কবরস্থান ও পুনঃনির্মিত মেয়র হানিফ মসজিদটি ২০২০ সালে সকলের প্রবেশের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। স্থপতি রফিক আজম এই প্রকল্পের নকশা করেন। আর কাজটি সম্পন্ন করে শাতত্ব আর্কিটেকচার।
১৮০৭ সালে ৩৪ একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত হয় কবরস্থানটি। এটিতে ৩,৯০০ টিরও বেশি স্থায়ী কবর এবং অনেকগুলো অস্থায়ী কবর আছে। যেগুলো দুই বছর পর পুনরায় ব্যবহার করা হয়। পুরনো অবকাঠামোর বেশিরভাগ ইটের প্রাচীরই ছিল শ্যাওলা আচ্ছাদিত। কিছু জায়গা ছিল ভাঙ্গা। ফলে কবরস্থানের ভেতরের অংশ অন্ধকার, জলাবদ্ধ এবং ছায়াময় বলে মনে হতো।
২০১৫ সালে কবরস্থান সংলগ্ন মেয়র হানিফ মসজিদ পুনঃনির্মাণের উদ্যোগ নেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন।
স্থপতি রফিক আজম বলেন, ২০১৫ সালে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর সাঈদ খোকন আমাকে তার কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে পুরান ঢাকায় স্থপতিদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন। দীর্ঘ আলোচনার পর শহরের অন্যতম পুরনো কবরস্থান 'আজিমপুর কবরস্থান' সংলগ্ন মসজিদের নতুন নকশা নিয়ে আমরা একমত হই।
তিনি উল্লেখ করেন, একটি বিশাল কবরস্থানকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রাখা ঢাকার মতো জনবহুল শহরের জন্য একধরনের অপচয়। তাই সিটিস্কেপের জন্য সঠিক পরিকল্পনা থাকা জরুরি।
রফিক আজম বলেন, আমরা জায়গাটিকে একটি বাগান, একটি সবুজ স্থান হিসেবে ডিজাইন করতে চেয়েছি। যা মৃত এবং জীবিত উভয়ের জন্যই কাজ করবে। এটি মৃতদের জন্য কেবল 'স্টোররুম' নয়, বরং একটি পবিত্র স্থানও। যেখানে মানুষ তাদের প্রিয়জনের সাথে দেখা করতে যাবে।
কবরস্থানের ল্যান্ডস্কেপিং
যে কোনো স্থানের ল্যান্ডস্কেপিং ডিজাইনে প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট উভয় উপাদানই অন্তর্ভুক্ত থাকে। একটি পার্কে যেমন গাছপালা, সবুজ লন এবং জলাশয় থাকা উচিত; তেমনি দর্শকের জন্য বসার ব্যবস্থা এবং অন্যান্য পাবলিক সুবিধাও থাকা উচিত।
তবে প্রাকৃতিক উপাদানের তুলনায় মনুষ্যসৃষ্ট উপাদানের ডিজাইন নির্দিষ্ট স্থানের উদ্দেশ্য এবং বিদ্যমান সংস্কৃতি অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হয়।
ডিজাইনের অংশ হিসেবে স্থপতি রফিক কবরস্থানটির দেড় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যজুড়ে একটি হাঁটার জায়গা সংস্কার করেন। যেটি এর আগে ভেঙে গিয়েছিল। তারা এটি মেরামত করে ওয়াকওয়ের ওপর একটি ধাতব ওভারহেড র্যাম্প যুক্ত করেন। এটি ওয়াকওয়ের ওপর ছায়া ফেলে এবং বৃষ্টি কিংবা রোদে দর্শনার্থীরা সুরক্ষা পায়। দৃষ্টিনন্দন বাগানটিও তারা উপভোগ করতে পারেন।
কবরস্থানের চারপাশের আগের কংক্রিটের দেয়াল সরিয়ে সেখানে স্বচ্ছ কাচের দেয়াল বসানো হয়েছে। পথচারীদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য একাধিক এন্ট্রি পয়েন্ট যুক্ত করা হয়েছে।
স্থপতি রফিক বলেন, কবরস্থানে প্রচুর মেহগনি গাছ ছিল। আমার কাছে এগুলোর এখানে থাকার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়নি। আমরা চেয়েছিলাম বিভিন্ন ফুলের গাছ থাকুক, যেগুলোতে বিভিন্ন ঋতুতে সারাবছর ফুল ফোটে। অথবা ফল দেয় এমন গাছ লাগানো হোক। যাতে পাখি ফল খেতে আসে এবং সেগুলোর কিচিরমিচির শব্দ শোনা যায়। কারণ আমি মনে করি আপনি যদি প্রকৃতির সঙ্গে বসবাস করতে চান তাহলে ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইন করার জন্য একটি বাস্তুতন্ত্রের প্রয়োজন।
৩৪ এক জমিতে প্রায় ২৬,০০০ কবর আছে, যেগুলো প্রায় বিক্ষিপ্ত। প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, স্থপতিদের আরো ১২ থেকে ১৫ হাজার কবরের ব্যবস্থা করতে হতো।
রফিক আজম বলেন, কিন্তু মানুষ এসব বিষয়ে খুবই সংবেদনশীল। তাই কবরগুলোকে একটু সরিয়ে সোজা সারিতে আনা বা কলাম তৈরি করতে পারিনি আমরা। স্থায়ী কবরের এলাকায় আমাদের কাজ করার অনুমতিই দেওয়া হয়নি। তাই বিদ্যমান কবরগুলো যথাস্থানে রেখেই কাজ করতে হয়েছে।
বর্তমানে একটি কবরস্থান ৮ ফুট বাই ৪ ফুট। কিন্তু অনেকেই আছেন যারা এই নিয়ম মানতে গিয়ে বিরক্ত হয়েছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতা কিংবা তাদের পিতামতার কবরের জন্য ১৫ ফুট পর্যন্ত জমি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাদের পরিবারের সদস্য কিংবা সমর্থকরা জমি ছাড়তে নারাজ ছিল।
রফিক আজম বলেন, স্থাপত্য কেবল কোনো কিছু তৈরি করা নয়। বরং পরিবেশ থেকে পাওয়া উপাদান নেওয়া এবং তারপর সেটি প্রতিফলিত করার বিষয়ও। যেমন একটি উঠোন সম্পর্কে চিন্তা করুন। যেখানে কোনো কিছুই তৈরি করা হয় না। এটি প্রকৃতি থেকে সূর্যের আলো এবং বাতাস গ্রহণ করে। কখনো কখনো নারীরা সেখানে বসে চুল আঁচড়ায়, কখনো গরু দিয়ে ধান মাড়ায়। কীভাবে কোনো কিছুকে আমরা ব্যবহার কবর, কীভাবে আমাদের জীবনের অন্তর্ভুক্ত কবর সেটি আমাদের উপরই নির্ভর করে।
তিনি আরো বলেন, ল্যান্ডস্কেপিং এর অর্থই হলো অর্থহীন জমিতে উদ্দেশ্য যোগ করা। একই জমিতে চাইলে আমরা জঙ্গল, খেলার মাঠ, পার্ক কিংবা আকাশচুম্বী দালানও তৈরি করতে পারি। আর সে উদ্দেশ্য অনুযায়ী উপাদান এবং পরিকল্পনাতেও পরিবর্তন হয়।