মেট্রোরেল যেভাবে উত্তরা ও মিরপুরবাসীর জীবন বদলে দিয়েছে!
পেশায় ঠিকাদার শরীফ মাহবুবুর রহমান থাকেন উত্তরার হাউজ বিল্ডিং এলাকায়। কাজের জন্য তাকে ঘন ঘন মতিঝিল ভ্রমণ করতে হয়।
মেট্রোরেল চালু হওয়ার আগে উত্তরা থেকে মতিঝিল যেতে প্রায় চার ঘণ্টা লেগে যেত শরীফের। যাতায়াতের জন্য পুরো একটি দিন নষ্ট হয়ে যেত। এখন বাড়ি থেকে বিআরটিসি বাস বা লেগুনার মাধ্যমে উত্তরা উত্তর স্টেশনে পৌঁছাতে তার ২০ মিনিট লাগে। সেখান থেকে মতিঝিল ৩০ মিনিটের পথ।
শরীফ স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে বললেন, 'এখন যে বাড়তি সময়টুকু পাই, তাতে আমি কেনাকাটা করতে যেতে পারি, আমার বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যেতে পারি। আমার ব্যবসায়ও বেশি সময় দিতে পারি।'
২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় মেট্রোরেল উদ্বোধন করেন। ওই বছর দিয়াবাড়ি-আগারগাঁও রুট চালু হয়। ২০২৩ সালের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত দ্বিতীয় ধাপের উদ্বোধন করেন।
সদা যানজটের শহর ঢাকায় উত্তরা-মতিঝিল রুট অনেক নগরবাসীর জীবনকে সহজ করে দিয়েছে। মিরপুর-আগারগাঁও-ফার্মগেট-মতিঝিল রুটেও যানজট কমেছে।
কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ২.৩ লক্ষ থেকে ২.৪ লক্ষ যাত্রী মেট্রো ব্যবহার করছেন। মেট্রোর ছয়টি বগির মধ্যে একটি শুধু নারী যাত্রীদের জন্য বরাদ্দ।
বাস মালিকরা যাত্রী হারানোর অভিযোগ করলেও দিয়াবাড়িতে রেস্টুরেন্ট ব্যবসার পাশাপাশি ভবন নির্মাণ দ্রুত বাড়ছে।
রিয়াদুল জান্নাত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মেডিকেল অফিসার। মেট্রো চালু হওয়ার আগে তিনি কর্মস্থলে পৌঁছাতে রাইড-শেয়ারিং বাইক ব্যবহার করতেন। মিরপুর-১০ থেকে আসতে তার এক ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যেত।
তিনি বলেন, 'প্রতিদিন যাতায়াতের জন্য আমার প্রায় ৪০০ টাকা খরচ হয়ে যেত। এখন তা নেমে এসেছে ১০০ টাকায়।'
রিয়াদুল বললেন, বাইক চালানো ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। 'ধুলোবালিতে ভরপুর এবং খুব অস্বস্তিকর। বাইক থেকে নামার পর আমার সারা শরীর ব্যথা করত।'
এখন মিরপুর-১০ থেকে বিএসএমএমইউতে পৌঁছাতে তার সময় লাগে মাত্র ১৫ মিনিট। সকালে এখন ঘর থেকে বের হওয়ার আগে আরামদায়ক গোসল করার সময় পান তিনি।
আবদুল মাজেদের মতো মিরপুরবাসীরাও মেট্রোরেল চালু হওয়ায় উচ্ছ্বসিত। ৩০ বছর বয়সী এই যুবক মিরপুর-১-এর ডেল্টা হাসপাতালে কাজ করেন, থাকেন মিরপুর-১৪-তে।
গত কয়েকদিন ধরে মাজেদ বিএসএমএমইউতে চিকিৎসার জন্য মিরপুর-১০ থেকে শাহবাগে যাতায়াত করছেন। আগে যা এক ঘণ্টার যাত্রা ছিল, এখন তা কমে প্রায় ১৫ মিনিটে পৌঁছেছে।
তিনি বলেন, 'দুই মাস আগে র্যাপিড পাস কিনেছি, তাই টিকিট কিনতে আমাকে লাইনে দাঁড়াতে হয় না। আগে কোথাও যাওয়ার আগে আমাকে কমপক্ষে দুই ঘণ্টা হাতে রাখতে হতো, যা এখন ৪০ মিনিটেই সম্ভব।'
ব্যবসা বাড়ছে দিয়াবাড়িতে
স্থানীয়রা জানান, কয়েক বছর আগেও তুরাগ থানার দিয়াবাড়ি ছিল প্রত্যন্ত এলাকা। বলতে গেলে নির্জন ছিল এই এলাকার প্রায় পুরোটা। দিনের বেলায়ও লোকে এখানে আসার আগে দুবার ভাবত। যোগাযোগব্যবস্থা ছিল দুর্বল। ডাকাতি ও ছিনতাই ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।
মেট্রোরেল নির্মাণের পর দিয়াবাড়িতে নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন আসতে শুরু করল। একসময় যা ছিল আধা-গ্রামীণ এলাকা, তা এখন পর্যটকদের আকর্ষণের স্থানে পরিণত হয়েছে। উত্তরা উত্তর স্টেশনের পাশে সারি সারি খাবারের দোকান ও রেস্তোরাঁ তৈরি হয়েছে।
ওই এলাকার বাসিন্দা কাবুল হোসেন বলেন, যাত্রীবোঝাই ট্রেনগুলো সব সময়ই আসছে-যাচ্ছে। তিনি জানান, উত্তরা উত্তর স্টেশনে শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহজুড়েই প্রচণ্ড ভিড় থাকে। শনিবার লোকের সংখ্যা বাড়ে, যার ফলে স্টেশনটিতে বেশ ভিড় হয়। স্টেশনের আশপাশের এলাকা রাত ৮টা পর্যন্ত মানুষের আনাগোনায় মুখরিত থাকে।
কাবুল আরও বলেন, 'শুক্রবার ট্রেন চললে কত লোক আসত আল্লাহই জানেন!'
স্টেশনের কাছে আবাসিক ভবন নির্মাণের পাশাপাশি বাণিজ্যিক অবকাঠামো নির্মাণের কাজও পুরোদমে চলছে। মেট্রোরেলের কারণে দিয়াবাড়িতে বসবাসের আগ্রহ দেখাচ্ছেন আরও মানুষ।
দিয়াবাড়ির সূর্য দীঘল বাড়ি রেস্টুরেন্টের কর্মচারী মনির হোসেন স্টেশনের পাশে খদ্দেরের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। টঙ্গীতে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। মনিরের মনে পড়ে, ছোটবেলায় মাঝে মাঝে নৌকা নিয়ে তিনি দিয়াবাড়ি আসতেন খালাকে দেখতে।
তিনি বলেন, জায়গাটি মূলত ঝিল ছিল। এর চারপাশে বোরো ধানের চাষ হতো। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এলাকাটি অধিগ্রহণ করে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে প্লট হিসেবে বিক্রি করে। এর বেশ কয়েক বছর পর আসে মেট্রোরেল প্রকল্প।
মনির বলেন, 'শনিবারে বিক্রি এত বেশি হয় যে আমাদের কাছে ঈদের মতো মনে হয়।'
তিনি জানান, দোতলা সূর্য দীঘল বাড়ি রেস্টুরেন্টের মাসিক ভাড়া এখন ৯৫ হাজার টাকা। তবে শহরের অন্যান্য এলাকার তুলনায় ওই এলাকায় বাড়ি ভাড়া এখনও কম।
গত ১৫ বছরে দিয়াবাড়িতে জমির দাম বহুগুণ বেড়েছে। ২০০৫ বা ২০০৭ সালে যখন রাজউক এলাকাটি অধিগ্রহণ করে তখন, প্রতি কাঠা জমি বিক্রি হয়েছিল ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকায়। এখন এই এলাকায় প্রতি কাঠা জমির দাম প্রায় ১.৫ কোটি থেকে ২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
বাস ব্যবসায় লোকসান
মিরপুর-১২ মিরপুরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাস স্টপ। এটি সাধারণত বাস ও যাত্রীতে পরিপূর্ণ থাকে। তবে গত বুধবার বিকেলে সেখানে গিয়ে মাত্র কয়েকজন লোক দেখা গেল।
মিরপুর-আগারগাঁও-ফার্মগেট-মতিঝিল রুটে যানজট অনেকটাই কমিয়েছে মেট্রোরেল। উত্তরা উত্তর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল রুটের নিচের রাস্তাগুলোতেও যানজটের চাপ বেশ কমেছে।
বিকাশ বাসের চালক মোহাম্মদ শামীম বলেন, 'মেট্রোরেলের কারণে আমাদের লোকসান হচ্ছে। এখন প্রতিদিন [প্রতি ট্রিপে] মাত্র ২৫-৩০ জন যাত্রী বাসে চড়েন।'
বিকাশের রুট ছিল মূলত মিরপুর-১২ থেকে মতিঝিল পর্যন্ত। মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হওয়ায় রুট বদলে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত যেতে বাধ্য হয়েছে বাস কোম্পানিটি।
বিহঙ্গ ও মিরপুর সুপার লিংক লিমিটেডসহ অন্যান্য বাসও দীর্ঘক্ষণ পল্লবী বাসস্ট্যান্ডে যাত্রীদের অপেক্ষায় ছিল।
আরেক চালক মোহাম্মদ নাদিম নামে বলেন, আগে তারা পল্লবী থেকে মতিঝিল সিঙ্গেল ট্রিপে ২ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা আয় করতে পারতেন। এখন তারা সর্বোচ্চ ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা আয় করতে পারেন।