জুলাই ১৮: প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা যেদিন জাতির ইতিহাসে তাদের নাম খোদাই করে দেয়
মোহাম্মদ আবু দাউদের ফোনের লক স্ক্রিনে নাম, বয়স, ঠিকানা, জরুরি নম্বর-এর মতো প্রাথমিক জরুরি তথ্যের একটি তালিকা এখনও রয়ে গেছে। এই তালিকা বাংলাদেশে জুলাই বিপ্লবের স্মারক হিসেবে রয়ে গেছে কারণ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দাউদের মতো হাজার হাজার তরুণ আন্দোলনকারী, যারা নিজেদের জীবন বাজি রেখে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল, তারা নিজেদের নাম-ঠিকানা সহজে শনাক্ত করার জন্য এমন পন্থা বেছে নিয়েছিল।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে গত ১৮ জুলাই ছিল ভয়াবহ্তার মুখোমুখি হওয়ার এবং সাহসিকতার দিন, যা একদিকে বিরতিহীন উত্তেজনা এবং অন্যদিকে ভয়হীন প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে স্মরণ করা যায়।
সেদিন সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ছিল। পুলিশ এবং ছাত্রলীগের সদস্যদের সঙ্গে সংঘর্ষ আর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলছিল চারপাশে। সাউন্ড গ্রেনেড বিস্ফোরণের শব্দে বাতাস বারবার ভারী হয়ে যাচ্ছিল, কাঁদানে গ্যাসের যন্ত্রনাদায়ক ধোঁয়ার পাশাপাশি এবং পুরোটা সময় চারিদিকে বিরাজ করছিল সহিংসতার ভয়।
সর্বত্র ছিল স্প্লিন্টার, রাবার বুলেট এবং রক্তপাতের ছড়াছড়ি। দাউদ এবং সাথের আন্দোলনকারীরা দ্রুত পালানোর ও সহায়তা প্রদানের মুহূর্তগুলোর মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলেন, অস্থায়ী চিকিৎসা ক্যাম্প তৈরি করছিলেন এবং পানি, খাবার এবং প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম সরবরাহ করা স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে সাহায্য নিচ্ছিলেন। তাদের এই তীব্র প্রতিবাদের মুখে সরকার সারাদেশে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট জারি করেছিল।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে, শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্র রাজনীতির দীর্ঘদিন ধরে সম্পর্ক ছিল। কোনো রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, আন্তর্জাতিক তদারককারী কিংবা গোয়েন্দা সংস্থা– কখনও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের গুরুত্ব দেয়নি। তারা সাধারণত রাজনৈতিকভাবে অপ্রাসঙ্গিক হিসেবে পরিচিত ছিল– যতদিন না ১৮ জুলাই, ২০২৪ আসে। সেদিন তারা সাহসিকতার সাথে রাস্তায় নেমে এসেছিল, দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় রচনা করে, যা রক্ত দিয়ে লেখা হয়েছে।
শেখ হাসিনার সরকার পতনের কিছু দিন পর আমার কথা হয়েছিল, কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা মাহফুজ আলমের সাথে। আমি জানতে চেয়েছিলাম, 'তিনি কখন বুঝতে পেরেছিলেন সরকারের পতন হবে?' মাহফুজ এক মুহূর্তের জন্যও দেরি না করে উত্তর দিয়েছিলেন, "যেদিন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে এসে আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছে।" তিনি তার উত্তরের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, "তাদের (প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী) অংশগ্রহণ আন্দোলনকে শহুরে অভিজাতদের সাথে যুক্ত করেছিল, যা আন্দোলনকে একটি গণআন্দোলনে পরিণত করার পথ তৈরি করেছিল।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও হলগুলো ১৭ জুলাই বাধ্যতামূলকভাবে খালি করার পর, আন্দোলনকারীদের মধ্যে সবচেয়ে আশাবাদীদেরও মনে হয়েছিল– আন্দোলন দমে গেছে। কিন্তু তারা জানতেন না, এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শহরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়বে আর এটির নেতৃত্ব দেবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
এর মধ্যে, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের (দুটি ক্যাম্পাস পরস্পরের থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দূরে অবস্থিত) যৌথ বাহিনী রামপুরা-বাড্ডা এলাকায় প্রতিরোধের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। তারা এক নজিরবিহীন সাহসিকতার সাথে লড়াই করেছিল এবং অন্যান্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে নিজ নিজ ক্যাম্পাস থেকে রাস্তায় নেমে আসতে অনুপ্রাণিত করেছিল।
মাঠে নেমেছিল ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন
১৫ জুলাই শেখ হাসিনার করা "রাজাকার" মন্তব্য এবং চট্টগ্রামের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের সহিংস পদক্ষেপের পর আন্দোলনটি বড় ধরনের গুরুত্ব পায়।
আন্দোলনে গভীরভাবে জড়িত থাকা দাউদ সেসব কথা স্মরণ করে বলেন, "সেদিন এনএসইউ, ইউআইইউ, ব্র্যাক এবং অন্যান্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা নতুন বাজার রাস্তা অবরোধ করে এবং প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে প্রতিবাদ জানায়।" সেদিন রাতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ ফেসবুক গ্রুপগুলোতে তীব্র আলোচনা শেষে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ছাত্ররা আন্দোলনে যোগ দেবে এবং পরের দিন সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে জড়ো হবে।
দাউদ বলেন, "আমাদের রেজিস্ট্রার আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি আমাদের বলেছিলেন, 'তোমাদের যা কিছু দরকার, আমরা তোমাদের সাথে আছি। তোমরা ন্যায্য দাবির জন্য লড়াই করছ এবং আমরা তোমাদের পাশে আছি।'" শিক্ষার্থীরা সারাদিন শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ জানায় এবং সন্ধ্যার দিকে আলাদা হয়ে যায়। ১৭ জুলাই তারা একটু বিশ্রাম নেয়। কিন্তু পরের দিন পরিস্থিতি সহিংস মোড় নেয়।
১৮ জুলাই সকাল সাড়ে ৯টার দিকে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের গেটে জড়ো হতে শুরু করলে পুলিশ সকাল ১০টার মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হয়। তারা শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে ফেরাতে কাঁদানে গ্যাস ও ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে। শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢুকে গেলে পুলিশ গেটের বাইরে সামনে স্প্লিন্টার, রাবার বুলেট এবং সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে শুরু করে।
দাউদ স্মরণ করে বলেন, "আমাদের অনেক বন্ধু আহত হয়েছিল এবং একজন স্প্লিন্টারের আঘাতে তাঁর দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল।"
সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ ছাত্ররা পুলিশকে পিছু হটাতে সক্ষম হয়, তাদের দুটি দলে বিভক্ত হতে বাধ্য করে– একটি হাতিরঝিলের দিকে এবং অন্যটি কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির দিকে (অন্য একটি নিকটবর্তী বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান)। কিছু পুলিশ কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির ভেতরে আটকা পড়ে কারণ শিক্ষার্থীরা তাদের ইট ছুড়ে মারেছিল। পাল্টা জবাবে পুলিশও তাদের দিকে স্প্লিন্টার ফায়ার করে।
গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঝুঁকি কমানোর জন্য শিক্ষার্থীরা সরাসরি সংঘর্ষ এড়িয়ে গিয়ে পিকেটিং করে। তারা পুলিশদের বাক্সবন্দী করে রেখেছিল এবং পুলিশের গোলাবারুদ ফুরিয়ে গেলে শিক্ষার্থীরা সামনে এগিয়ে যায়। ততক্ষণে, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের আরও শিক্ষার্থীরা এই লড়াইয়ে যোগ দেয়।
সংঘর্ষের সময় এক পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হন। প্রচণ্ড উত্তেজনা থাকা সত্ত্বেও ছাত্ররা তাকে মরতে দিতে পারেনি। তাদের মধ্যে কয়েকজন তাকে বিক্ষুব্ধ জনতার হাত থেকে রক্ষা করে, আঘাত নিজেদের ওপরে নেয়। আহত পুলিশ অফিসারকে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, পথে তাকে রক্ষা করার জন্য মানববন্ধন তৈরি করা হয়। হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সুবিধার অভাব স্পষ্ট হলে তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে আদ-দিন হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
এদিকে দ্রুত খবর ছড়িয়ে পড়ে, ইম্পেরিয়াল কলেজের ছাত্র জিল্লুর শেখ হাতিরঝিলের রাস্তায় পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন। এই সংবাদ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের আলোড়ন ছড়িয়ে দেয় এবং তাদের দৃঢ় সংকল্পকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
যখন উত্তেজনা চরমে পৌঁছায় তখন, প্রাথমিকভাবে বন্ধ থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট অবশেষে খুলে দেওয়া হয়। ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও সংহতি জানিয়ে সেখানে উপস্থিত হন। একটি মেডিক্যাল টিম দ্রুত আহত ছাত্রদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়।
দাউদ জিল্লুরের কথা স্মরণ করে বিষণ্ণ কণ্ঠে বলেন, "জিল্লুরকে প্রথমে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল টিমের কাছে আনা হয়েছিল। কিন্তু সে ইতোমধ্যেই মারা গিয়েছিল। ওর মাথায় গুলি লেগেছিল।"
শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ দলে ভাগ হয়ে কাজ শুরু করে। কিছু শিক্ষার্থী মেডিক্যাল টিমকে সহায়তা করেন, কিছু শিক্ষার্থী অক্সিজেন সিলিন্ডার ও অন্যান্য সরঞ্জাম সংগ্রহ করেন আর কিছু শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে পুলিশকে গেটের কাছাকাছি আসতে বাধা দেয়।
দাউদ বলেন, "যখন আমরা ওপরে হেলিকপ্টার দেখতে পেলাম, তখন আমাদের ভয়ের শেষ ছিল না। আমরা ভেবেছিলাম, হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হবে এবং তখন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তবে দ্রুতই পরিষ্কার হয়ে যায়, হেলিকপ্টারটি কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির ভেতরে আটকা পড়া পুলিশ কর্মকর্তাদের সরানোর জন্য এসেছে।"
স্যালাইন এবং পানি সরবরাহ শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় উল্লেখযোগ্য সমর্থন দিলেও, অধিকাংশ সাহায্য স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে আসে। রিকশাচালক থেকে শুরু করে দোকানদার পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ খাবার, পানি, মাস্ক এবং অন্যান্য জরুরি সামগ্রী নিয়ে আন্দোলনকারীদের কাছে পৌঁছে দেয়। পুরো দিন ধরে প্রতিবাদ চলতে থাকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তারক্ষীরা তীব্র কাঁদানে গ্যাসের মধ্যেই সাহসিকতার সাথে শিক্ষার্থীদের সাথে দাঁড়িয়ে থাকে।
ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ
শিক্ষার্থীরা হামলার জন্য প্রস্তুত থাকলেও কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনার কারণে তারা বিচলিত হয়ে পড়ে।
ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী তানভীর হোসেন নোবেল স্মরণ করে বলেন, "মূল পরিকল্পনাটি ছিল সহজ। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হাতিরঝিল রোডে অবস্থান নেবে, আর ইস্ট ওয়েস্টের শিক্ষার্থীরা রামপুরা-বনশ্রী চৌরাস্তা পুলিশ বক্সের কাছে অবরোধ করবে যাতে পুলিশ দুই দিক থেকে প্রবেশ করতে না পারে।"
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইতোমধ্যেই বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা সংঘাতের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল। এমনকি কিছু শিক্ষার্থী লাঠি এবং বাঁশ নিয়ে এসেছিল। তবে পরিকল্পনা অনুযায়ী কিছুই হলো না। ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আসতে দেরি করে। অথচ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ১০ টার আগেই বড় সংখ্যায় উপস্থিত হয়েছিল।
যখন খবর ছড়িয়ে পড়ে, পুলিশ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে জড়ো হচ্ছে এবং ছাত্রলীগ ও পুলিশের হামলার গুজবে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধেক শিক্ষার্থী ব্র্যাকের দিকে মিছিল নিয়ে সহায়তার জন্য যান।
ব্র্যাকে পৌঁছানোর পর শিক্ষার্থীদের ওপর টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করা হয়, যার ফলে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। কিছু শিক্ষার্থী ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে আশ্রয় নেয়, অন্যরা ফিরে আসে ইস্ট ওয়েস্টে, যেখানে হামলার খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
মূল অবরোধ পরিকল্পনা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে। তবুও, ইস্ট ওয়েস্টের শিক্ষার্থীরা দ্রুত বনশ্রী আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ, খিলগাঁও আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ, ইম্পেরিয়াল কলেজ এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সাথে যুক্ত হয়ে তাদের সংখ্যা বাড়িয়ে নেয়।
ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা আফতাবনগরের প্রধান গেট দখল করে নেয়। এদিকে পুলিশ ব্র্যাক এবং রামপুরা টিভি সেন্টারের কাছে অবস্থান নেয়। যদিও ব্র্যাকের গেট খোলা ছিল, ইস্ট ওয়েস্টের গেট তখনও বন্ধ ছিল। নিজেদের অবস্থানে দৃঢ় থাকতে, কিছু শিক্ষার্থী তালা ভেঙে ফেলেন এবং প্রথমে মেয়েদের সুরক্ষিত করার জন্য ভেতরে পাঠান।
পুলিশের সাথে সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করলে, টিয়ার গ্যাস ও স্প্লিন্টার গ্রেনেডের আঘাতে আহতদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টার চিকিৎসা দিতে শুরু করে।
বাড্ডা ও রামপুরার ছাত্রলীগের সদস্যরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার পরিকল্পনার করছে– এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতির মোকাবিলা, আফতাবনগরের প্রবেশপথগুলো অবরুদ্ধ করার জন্য দুটি দলের ব্যবস্থা করা হয়। এদিকে, স্প্লিন্টার ও টিয়ার গ্যাসের আঘাতে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন।
একজন ছাত্র, যিনি আবু সায়েদের মতো দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি কাঁদানে গ্যাসের শেলের আঘাতে পায়ে গুরুতরভাবে আঘাত পান। আহত শিক্ষার্থীদের দ্রুত নাগরিক ও ফারাজী হাসপাতালসহ পার্শ্ববর্তী হাসপাতালে পাঠানো হয়।
জিল্লুরের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর উত্তেজনা তীব্রভাবে বাড়ে এবং আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়। ততক্ষণে, শিক্ষার্থীরা রামপুরা পুলিশ বক্সকে কিছু না করলেও জিল্লুরের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর এটি তাদের ক্ষোভের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
নোবেল জানান, "বাহিরের লোকদেরও অংশগ্রহণ ছিল। কয়েকজন মধ্যবয়সী পুরুষকেও ভীরের মধ্যে দেখা গিয়েছিল।"
হঠাৎ করেই পুলিশ বক্সের ভেতর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। "আমরা দেখতে পাইনি, কে আগুন লাগাল এবং কেউ আমাদের পক্ষ থেকে দায় স্বীকার করেনি," নোবেল বলেন। পুলিশ প্রতিশোধ হিসেবে ইউ-লুপ ওভারপাস থেকে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়, যা তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। বিশৃঙ্খলার মধ্যে, শিক্ষার্থীরা দ্রুত আহতদের সাহায্য করার দিকে মনোনিবেশ করেন।
ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে একটি মেডিক্যাল টিম আহতদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য গঠিত হয়। দুপুরের দিকে, আফতাবনগরের স্থানীয় বাসিন্দারা বড় সংখ্যায় এসে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম যেমন মেডিকেল ইকুইপমেন্ট, খাবার, এবং পানি নিয়ে আসেন। এই সময়ে, উত্তেজনা বাড়তে থাকে এবং শিক্ষার্থীরা বাড্ডা পুলিশ আউটপোস্টে আক্রমণ করে।
সংঘাত চলাকালে, একজন পুলিশ কর্মকর্তা ক্ষুব্ধ জনতার কাছে ধরা পড়েন এবং তাকে গুরুতরভাবে মারধর করা হয়। কিছু শিক্ষার্থী তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে এগিয়ে আসেন এবং তাকে আরও ক্ষতি থেকে রক্ষা করে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের জরুরি মেডিক্যাল ক্যাম্পে নিয়ে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরও নিশ্চিত করেন, ঐ পুলিশ কর্মকর্তা যথাযথ চিকিৎসা পেয়েছে।
যখন সংঘর্ষ চলছিল তখন একটি হেলিকপ্টার আকাশে উড়ছিল এবং ইস্ট ওয়েস্ট ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে রেখেছিল। পুলিশ কর্মকর্তারা হেলিকপ্টার থেকে নেমে আসতে পারে, এই ভয়ে শিক্ষার্থীরা ছাদে সংগঠিত হয়ে সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধ করার পরিকল্পনা করেন। তবে, হেলিকপ্টারটি অবশেষে কানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে চলে যায় কোনো ঘটনা সৃষ্টি হওয়া ছাড়াই।
বিকেল ৪টার দিকে নোবেল নিজে আহত হন। চিকিৎসা নিয়ে তিনি আবার রামপুরা টিভি সেন্টারের দিকে রওনা দেন। তিনি সেখানে দেখতে পান, আন্দোলনকারীরা বিটিভি ভবনের গেট ভেঙে ফেলেছে। তবে তখনও কোনো আগুন লাগানো হয়নি। গুজব ছড়িয়ে পড়ে, সেনাবাহিনীর এপিসি (আর্মড পার্সোনেল ক্যারিয়ার) ক্যন্টনমেন্ট থেকে বের হয়েছে এবং অনেকের বিশ্বাস ছিল, তারা উত্তেজনাকর পরিস্থিতির কারণে রামপুরার দিকে আসবে।
"অনেক শিক্ষার্থী আহত এবং উত্তেজনা তীব্র হওয়ায় আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, কর্মসূচি প্রত্যাহার করার সময় এসেছে," বলেন নোবেল। বিকেল ৫টার দিকে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রক্টর আনিসুর রহমানসহ শিক্ষকরা তাদের বাড়ি যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন এবং বলেন, "তোমরা অনেক কিছু করে ফেলেছ। কিন্তু সন্ধ্যা হলে পরিস্থিতি আরও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। আমরা তোমাদের সমর্থন করি, কিন্তু তোমাদের বিপদে ফেলতে পারি না।"
শিক্ষার্থীরা দিনভর ঘটনার পর ক্লান্ত হয়ে বাড়ি যাওয়া শুরু করে। পরে ঐ সন্ধ্যায় খবর আসে, একটি দল পিছনে থেকে গেছে এবং প্রতিবেদন থেকে নিশ্চিত হয়, বিটিভি ভবনে আগুন ধরানো হয়েছে।
নোবেল বলেন, "আমরা কোনো আগুন লাগাইনি; আমাদের সেই সক্ষমতা ছিল না। কিন্তু আমরা পুলিশের মোকাবিলা করেছি। আমরা তাদের সহজে জিততে দেইনি।"