জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র: ঐক্য না–কি বিভেদ?
ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সমস্ত দল ও শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে আগামীকাল (৩১ ডিসেম্বর) শহীদ মিনারে 'প্রক্লেমেশন অব জুলাই রেভ্যুলেশন' বা জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র কর্মসূচি পালন করতে যাচ্ছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি।
তবে ওই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করছে না বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়নের মতো বড় ছাত্র সংগঠনগুলো। এসব সংগঠনের নেতারা বলছেন, হাসিনা সরকার পতনের ৫ মাস পর এসে এ ধরনের ঘোষণা 'অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রসাঙ্গিক'— যা মূলত 'একদলীয় বয়ান' তৈরি করবে।
যদিও এক সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে ঘোষণাপত্রের ড্রাফট (খসড়া) বিভিন্ন ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হয়েছে, যারা এই গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছে। এছাড়াও বুদ্ধিজীবী, লেখক, সুশীল সমাজ, প্রবাসী সকলের মতামত নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। তারা তাদের মতামত দিচ্ছে। ঘোষণাপত্রটিকে মানুষের ভাষায় রূপান্তরের চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।
হাসনাত বলেন, "এটি হবে ব্যানার ছাড়া, সার্বজনীন। এটি জনমানুষের আকাঙ্খা থেকে এসেছে, সেখান থেকেই এই ঘোষণা হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে হবেনা।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা চাই, ১৯৭২ এর মুজিববাদী সংবিধানকে কবরস্থ ঘোষণা করা হবে। যেখান থেকে এক দফার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, ঠিক সেই জায়গা থেকে মুজিববাদী বাহাত্তরের সংবিধানের কবর রচিত হবে।"
সংগঠনটির মুখ্য সংগঠক হান্নান মাসুদ বলেন, "বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আমরা জুলাই প্রক্লেমেশন ঘোষণা করবো। সেটি সংবিধানে যুক্ত করে সেকেন্ড রিপাবলিক করার দায়িত্ব সরকার নেবে।"
৩১ ডিসেম্বরের কর্মসূচিতে কারা অংশ নেবেন জানতে চাইলে মাসুদ বলেন, যারা বিপ্লবকে সমর্থন করেছেন— তাদের উপদেষ্টা, সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, ছাত্র ও শ্রমিকসহ সবাই থাকবেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ও বর্তমানে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, "আমরা বিপ্লবের একটিমাত্র ধাপ অতিক্রম করেছি। জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র আরও আগে ঘোষণা করা প্রয়োজন ছিল। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের এই বিপ্লব যেমন ফ্যাসিস্টবিরোধী সবাইকে ধারণ করতে পেরেছিল, এই ঘোষণাপত্রও সবার আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে পারবে।"
এরমধ্যে ঘোষণাপত্রের একটি খসড়া করা হয়েছে বলে জানিয়ে সারজিস আলম বলেন, "এই বিপ্লবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল-মত, ধর্ম ও বয়সের যে মানুষেরা সরাসরি অংশ নিয়েছেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে তাদের মতামত নেওয়া হচ্ছে। এটি সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করা হচ্ছে।"
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে সারজিস বলেন, "বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বা নাগরিক কমিটি কোনো রাজনৈতিক দলে পরিণত হবে না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জুলাই বিপ্লবের সময় আমাদের ঐক্যের প্রতীক হয়ে থাকবে, এটি একটি অনন্য প্ল্যাটফর্ম; এটি কখনই রাজনৈতিক দলে রূপ নেবে না।"
তথ্যে অস্পষ্টতা
ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন নাসির দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা এখনও যেখানে দাওয়াত পাইনি, সেখানে অংশগ্রহণের প্রশ্নই নেই। আমরা মনে করি ৫ মাস পর এ ধরনের ঘোষণা অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক। গণমাধ্যম মারফত যতটুকু জেনেছি, তাতে মনে হয়েছে, এটি দলীয় স্বার্থ ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত একটি প্রচেষ্টা— যা ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ গঠনের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করবে।"
"এক কথায় এটি জুলাই আন্দোলনের স্পিরিটের সাথে সাংঘর্ষিক।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা কোনো ঘোষণাপত্রের ড্রাফট পাইনি। কিংবা এ সংক্রান্ত কোনো আলোচনাও আমাদের সাথে করা হয়নি।"
এদিকে, জাতীয় নাগরিক কমিটির কয়েকজন সদস্য দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, ৩১ ডিসেম্বর সুনির্দিষ্ট কারা দাওয়াত পাচ্ছে– সে বিষয়ে তাদের স্পষ্ট ধারণা দেওয়া হয়নি। তবে, রাজনৈতিক দলগুলোকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে— এটি তারা জেনেছেন। কিন্তু আমলাতন্ত্র, সামরিক বাহিনী কিংবা সরকারের কারা থাকবে, সেটা এখনও তারা জানেন না।
ইসলামি ছাত্রশিবিরের সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো দাওয়াত পাইনি। এমনকি, আমাদেরকে ক্লিয়ারলি কোনো কিছু জানানো হয়নি। তাছাড়া, সেদিন আমাদের বার্ষিক কেন্দ্রীয় সদস্য সম্মেলন আছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। এই অনুষ্ঠানটি সন্ধ্যা পরবর্তী সময় পর্যন্ত গড়াতে পারে।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংসদ ছাত্র ইউনিয়নের (একাংশ) সভাপতি মেঘমল্লার বসু দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা এখনও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে কোনো দাওয়াত পাইনি। আর এভাবে তো একটা অভ্যুত্থানের ৫ মাস পরে বিপ্লবের প্রক্লেমেশন ঘোষণা দেওয়া যায়না। এজন্য ন্যূনতম আলোচনা ও বোঝাপড়া দরকার ছিল অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সাথে।"
তিনি আরো বলেন, "আমরা মনে করি, এটিও আসলে ৭১ এর চেতনার মতোই একটি একদলীয় বয়ানে পরিণত হবে। যেমনটি স্বাধীনতার ঘোষণা পর মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, কিন্তু ৭২ এর সংবিধান তো মুক্তিযুদ্ধের প্রক্লেমেশন না।"
"সেটির মাধ্যমে একটি দলের চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছিল। বর্তমানেও ২০২৪ এর এই ঘোষণা শেষমেশ দলীয় বয়ানেই পরিণত হবে," যোগ করেন তিনি।