বাংলার প্রথম বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্স দ্বারকানাথ, তার হাত ধরেই খেলাপি ঋণের শুরু!
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বাংলাদেশে ব্যাংক জালিয়াতি, ঋণ খেলাপি লাভ করেছে নতুন মাত্রা। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক পরিচালকদের যোগসাজশে জনতার আমানত হরিলুঠের কথা অনেকবারই উঠে এসেছে গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনামে। অতীতে অর্থশাস্ত্রবিদেরাও বলেছেন, পর্যাপ্ত নজরদারির অভাব এবং রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতায় পছন্দের ব্যক্তিকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বোর্ড সদস্য করায় অবাধে বেড়েছে খেলাপি ঋণ। দুর্বল হয়েছে দেশের আর্থিক খাত, সেখানে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে দুর্নীতির চর্চা।
কিন্তু, বাঙালি জাতির ইতিহাসে ব্যাংক হরিলুঠের ঘটনা শুধু আধুনিক সময়ের নয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকারের আমলে অবিভক্ত বাংলাতেও স্থানীয় পুঁজিপতিদের প্রতিষ্ঠিত প্রথম ব্যাংকটি হয়েছিল লুণ্ঠনের শিকার। যারা এটি রক্ষা ও পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন লুঠের হোতাও ছিলেন তারাই। ইউনিয়ন ব্যাংকের সে ইতিহাস প্রবঞ্চণার, শুধু আমানত লুঠেই নয় বরং যারা এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগকারী ও অংশীদার ছিলেন তাদের সিংহভাগ সম্পদের উৎস ছিল নিষ্ঠুর নীল চাষ। সময়টাও ছিল উপনিবেশিক শোষণ অর্থনীতির।
নব্য জমিদার, ব্রিটিশ ও দেশি বেনিয়া শ্রেণির হাতে গড়া এই ব্যাংকের লেনদেনে ব্যাপক অনিয়ম সেকালেও ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। আর করবেই বা না কেন, এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে যে জড়িয়ে আছে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের নাম। ইংরেজ ঘনিষ্ঠ এ ধনকুবেরই হলেন বাংলা সাহিত্যের প্রাণপুরুষ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা।
তৎকালীন তথ্যসূত্র নির্ভর ইউনিয়ন ব্যাংকের ইতিহাস নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছেন অর্থনীতিবিদ, মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক, লেখক, প্রকাশক মাইকেল কিডরন।
তিনি ১৮২৯ সনে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড শুরু করা ইউনিয়ন ব্যাংকের দুর্নীতির সূচনা গোড়া থেকেই তুলে ধরেছেন।
কিডরনের ভাষায় "১৮৩০ থেকে ১৮৪৭ পর্যন্ত কলকাতার সবচেয়ে বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম ছিল ইউনিয়ন ব্যাংক। যৌথ মূলধনী এ কোম্পানিতে ছিলেন ভারতীয় ও ইউরোপীয় কয়েকশ' বিনিয়োগকারী। কলকাতায় বেনিয়া শ্রেণির আর্থিক ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির প্রতীক হয়ে ওঠে এই প্রতিষ্ঠানটি। ব্যবসায়ী শ্রেণির জন্য মূলধন যোগান, ঋণ বৃদ্ধি, এক্সচেঞ্জ ব্যাংকিং, ব্যাংক নোট ইস্যুকরণ এবং কৃষিজাত পণ্যের মূল্যকে নিয়ন্ত্রণ করাই ছিল এটি প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য। … ইউনিয়ন ব্যাংক উভয় জাতির ব্যবসায়ীদের জন্যই সমান ব্যবসার সুযোগ দেয়। উভয় জাতির মানুষই ব্যাংকটির পরিচালনা ও ভাগ্য নির্ধারণে জড়িত ছিল।"
"তবে কলকাতার অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতই ইউনিয়ন ব্যাংকের প্রধান সমস্যা হয়ে ওঠে 'নীল' এর মতো একক রপ্তানি পণ্যের কারবারে অধিক নির্ভরশীলতা। দ্বিতীয়ত, সে সময়ের কোম্পানি বাহাদুর সরকার ব্যাংকটিকে আনুষ্ঠানিক সহযোগিতা দানসহ নজরদারি নিশ্চিত করে নিয়ন্ত্রক ভূমিকা রাখার আগ্রহ দেখায়নি। তৃতীয়ত, ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা নিজেদের ব্যবসা নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতেন। তারা ব্যাংক পরিচালনার জন্য অন্য যারা সময় দিতে পারতেন তাদের ওপর নির্ভর করেন। কিন্তু, এসব ব্যক্তি ছিলেন অদূরদর্শী ও চারিত্রিক ত্রুটির অধিকারী।"
অথচ ১৮২৯ সালে যখন দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং তার সহযোগী ম্যাকিনটশ আন্ড কোম্পানির অংশীদাররা নতুন ব্যাংকের সূচনা করেন; তখন তারা স্থানীয় বণিক সম্প্রদায়ের মধ্যে বিপুল সাড়া ফেলেছিলেন। ওই সময়ে কলকাতার একমাত্র ব্যাংক ছিল আধা-সরকারি ব্যাংক অব বেঙ্গল। ব্যাংকটি তার মূলধন প্রধানত সরকারি বন্ড ক্রয়েই ব্যয় করতো। কলকাতায় তিনটি বেসরকারি এজেন্সি হাউজ কিছুমাত্রায় বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলেও ১৮৩০-৩৩ সালের অর্থনৈতিক সংকটের প্রারম্ভে আমানতকারীরা অর্থ প্রত্যাহার করায় তারা ঋণ ব্যবসা বড় পরিসরে চালিয়ে যাওয়ার অবস্থায় ছিল না। ফলে স্থানীয় ও বিদেশি উভয় শ্রেণির বণিক সম্প্রদায়ের মধ্যে নতুন তহবিল উৎসের চাহিদা তৈরি হয়। দ্বারকানাথ ও ইউনিয়ন ব্যাংকের অন্যান্য প্রতিষ্ঠাতারা যা বেশ ভালো করেই বুঝেছিলেন।
এখানে দ্বারকানাথ সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয়।
সেকালের ভারতবর্ষের প্রথম সারির শিল্পপতি দ্বারকানাথের জন্ম ১৭৯৪ সালে। রামমণি ঠাকুরের ঘরে জন্ম নিলেও তাকে দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন তার কাকা রামলোচন। কারণ কোনো পুত্র সন্তান ছিল না তার। রামলোচন ও তার স্ত্রী অলোকা দেবীর ঘরেই বেড়ে উঠতে থাকেন দ্বারকানাথ। ১৮০৪ সালের দিকে চিৎপুর রোডের শেরবোর্ন সাহেবের স্কুলে ভর্তি করানো হয় তাকে; সেখানেই তার শিক্ষার হাতেখড়ি। এরপর ১৮১৫ সালে সফলভাবে আইন ব্যবসায় শুরু করার আগে, ব্রিটিশ আইনজীবীর রবার্ট গুটলার ফারগুসনের অধীনে শিক্ষানবিশ হিসেবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, কলকাতা সুপ্রিম কোর্ট, সদর ও জেলা আদালতের যাবতীয় আইন ও কার্যপ্রণালী বিষয়ে অধ্যয়ন সম্পন্ন করেন দ্বারকানাথ।
এরই মধ্যে দত্তক পিতা রামলোচনের মৃত্যু হলে মাত্র ষোল বছর বয়সে তার সকল সম্পত্তির উত্তরাধিকার হন তিনি। সেই সম্পত্তির মধ্যে ছিল, কলকাতার বাড়ি-জমিজমা ও মফস্বলের জমিদারি। সমস্ত সম্পত্তি থেকে বছরে আয় আসতো ৩০ হাজার টাকা।
তবে, দ্বারকানাথকে পেয়ে বসেছিল সম্পদ বাড়ানোর নেশা। ফলে একে একে জমাদারি কিনতে শুরু করেন তিনি। ১৮৩০'এর দশকে তিনি বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী ও পাবনা জেলার জমিদারি কিনেছিলেন নিলামে। তার অনেক জমিদারিতে অংশীদার থাকলেও বহরমপুর, পাণ্ডুয়া, কালীগ্রাম ও শাহজাদপুরে চারটি বড় জমিদারির মালিক ছিলেন তিনি একাই। বিশ্লেষকদের মতে, দ্বারকানাথ ঠাকুরের জমিদারি পরিচালনার একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল। তিনি জমিদারিকে সামন্ততন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে মূলধনের সৃষ্টিশীল প্রসার হিসেবে বিবেচনা করতেন।
মূলধনের সৃষ্টিশীল প্রসারের ধারণাকে তিনি কেবল জমিদারিতেই নয়, অন্যান্য ব্যবসায়েও কাজে লাগিয়েছিলেন। তাইতো অল্প সময়ের মাঝেই তিনি বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছিলেন জাহাজ ব্যবসা, রপ্তানি বাণিজ্য, বীমা, ব্যাংকিং, কয়লা খনি, নীলচাষ, লবণ চাষ, আফিম চাষসহ শহরের গৃহায়ণ প্রকল্প ব্যবসায়ে।
তার সমস্ত ব্যবসায়ের মধ্যে ব্যাংকিং ব্যবসা বাংলার অর্থনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ১৮২৯ সালে যখন ভারতবর্ষে ইউনিয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন দ্বারকানাথও সেখানে শেয়ার কিনে অংশীদার হয়েছিলেন। তবে, ব্যাংক পরিচালনার মূল কর্তৃত্ব তিনি নিজের হাতেই রেখেছিলেন। একসময় নিজের আস্থাভাজন ও ঘনিষ্ঠজন রমানাথ ঠাকুরকে বানিয়েছিলেন ব্যাংকের কোষাধ্যক্ষ। ব্যাংকের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ থাকার সময়ে তার মালিকানায় ছিল ৭০০ শেয়ার।
ইউনিয়ন ব্যাংকের জন্ম ও প্রথম সংকট:
যৌথ মূলধনী এ ব্যাংকের মোট পুঁজি নির্ধারণ করা হয় ৫০ লাখ রুপি। মোট শেয়ার সংখ্যা দুই হাজার, যার প্রতিটির দর ছিল আড়াই হাজার রুপি। প্রতিষ্ঠাকালীন চুক্তি অনুসারে—ব্যাংকের হিসাবনিকাশ নিয়ে প্রকাশ্য আলোচনা-সমালোচনা করা হবে, থাকবে অংশীদারদের নিয়মিত বৈঠক এবং একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ কতটি শেয়ার মালিকানায় থাকবে সুনির্দিষ্ট সীমা। লক্ষ্যমাত্রার পুঁজির মধ্যে যখন ১২ লাখ রুপি সংগ্রহ হয় তখন ব্যাংকটি তার কার্যক্রম শুরু করে।
কিন্তু, ব্যাংক যাত্রা শুরুর সময়েই দেখা দেয় প্রথম সংকট। দ্বারকানাথ ছিলেন কোম্পানি রাজের সবচেয়ে অনুগত ব্যবসা সহযোগী। কিডরন বলছেন, ব্যাংকের অন্য পরিচালকরা ব্রিটিশ বণিকদের 'প্রিন্স'খ্যাত দ্বারকানাথের ঋণের অনুরোধ ফেরাতে পারছিলেন না। তিনি নিজে তদবির করে জন পালমার অ্যান্ড কোম্পানিকে ছয় লাখ রুপি ঋণ দেন। এই ঋণ ছিল ব্যাংকটির মোট সম্পদের অর্ধেক। ফলে ১৮৩০ সালের জানুয়ারিতে জন পালমার অ্যান্ড কোম্পানি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে ইউনিয়ন ব্যাংক শুরুতেই প্রায় দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হয়েছিল।
ব্যাংকের পতন ঠেকাতে তখন হস্তক্ষেপ করলেন এর তৎকালীন সচিব উইলিয়াম কার। তিনি নীল ব্যবসায়ীদের কারখানা ও স্থায়ী সম্পত্তি (ভূমি) জামানত হিসেবে নেওয়ার সতর্ক সিদ্ধান্ত নেন। ব্যাংকের ঘোষণাপত্রে এভাবে স্থায়ী সম্পদ জামানত নেওয়ার নীতি না থাকলেও; কোনো নীলকর এজেন্সি তার ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে ব্যাংক এসব সম্পত্তি দখলের সুযোগ পেল। কিন্তু, উইলিয়াম সাহেবের এই সিদ্ধান্তও ছিল অশুভ। ফলে ১৮৩০-৩৩ পর্যন্ত বাণিজ্যিক সংকটের সময় ব্যাংকটি তার শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারেনি। এসময় ২,৫০০ রুপিতে নির্ধারিত প্রকৃতমূল্যের শেয়ার প্রায় অর্ধেক দামে বিকিকিনি হয়েছে। তবে ১৮৩৩ সনের জুলাই মাস নাগাদ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে। এসময় প্রদত্ত লভ্যাংশে বেড়ে ৬ থেকে ৮ শতাংশ হয়।
জালিয়াতি ও ভুল সিদ্ধান্ত:
তবে সংকট সামনে আরো ছিল। ১৮৩০ এর দশকের শেষদিকে দ্বারকানাথের বুদ্ধিতে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ তিনটি ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথম সিদ্ধান্ত ছিল, ব্যাংকের মূলধন ১৫ লাখ থেকে ৬ গুণ বাড়িয়ে এক কোটি রুপি করার সিদ্ধান্ত। এরপর তারা বড় পরিসরে এক্সচেঞ্জ বিল (হুন্ডি) ব্যবসায় জড়িত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তৃতীয় সিদ্ধান্তটি ছিল, নীল ব্যবসায় বড় অংকের ঋণ সরবরাহের। সেকালে এক্সচেঞ্জ বিল বা হুন্ডি ব্যবসায় ছিল বৈধ। অথচ এ ব্যবসায় নামাতে যত বিশাল পুঁজির দরকার ছিল, তা না থাকায় ব্যাংক পড়ে তারল্য সংকটে। তার ওপর নীল ব্যবসায় দেওয়া ঋণ, খেলাপি হতে থাকায় ব্যাংকের সম্পদ প্রায় নিঃশেষিত হয়ে ওঠে।
নীল চাষে দ্বারকানাথ নিজে যেমন জড়িত ছিলেন, তেমনি ছিলেন এই নীলকর সাহেবদের বড় পৃষ্ঠপোষক, অর্থ-সংস্থানকারী। বিলেতে নীলসহ কৃষিপণ্য আমদানি-রপ্তানির হুন্ডি বিল কেনাবেচায় তিনি শুরু থেকেই ইউনিয়ন ব্যাংককে সম্পৃক্ত করার উদ্দেশ্য স্থির করেছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন কিডরন।
"সে সময়ে কোলকাতার এজেন্সি হাউজগুলো এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মিলেমিশে এই ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করতো। দ্বারকানাথ ছিলেন নীলকুঠি মালিকদেরই প্রতিনিধি। বিল কেনাবেচায় নতুন প্রতিযোগী আসলে তাতে নীলকুঠিগুলোই লাভবান হবে, আর দ্বারকানাথ সেজন্যই এ সিদ্ধান্ত নেন। আসলে বিল কেনাবেচার চেয়ে এই সুবিধা তৈরিই ছিল তার প্রধান উদ্দেশ্য।"
তবে ব্যাংকের যেসব অংশীদার বিল ব্যবসায় জড়িত ছিলেন, তারা এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা শুরু করলেন। অবস্থা বেগতিক বুঝে নতুন কৌশল নিলেন দ্বারকানাথ ও তার সহযোগীরা। তারা বিল কেনাবেচার ব্যবসায় আসার প্রস্তাব সরাসরি না দিয়ে, বরং ব্যাংকের পুঁজি বৃদ্ধির প্রতি গুরুত্ব দিলেন। ফলে যারা বিরোধিতা করেছিলেন তারাও ব্যাংককে বিল বিকিকিনিতে নামার সিদ্ধান্ত দিতে বাধ্য হন। তবে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণকে কৌশলে প্রভাবিত করা হয়েছিল, এমন অভিযোগ রয়েছে।
"এভাবে ১৫ লাখ থেকে ১৮৩৬ সন নাগাদ পুঁজি উন্নীত হয় ২১ লাখ ৬০ হাজার রুপিতে। ১৮৩৭ সালে তা আরো বেড়ে হয় ৩২ লাখ, ১৮৩৮ সনে হয় ৮০ লাখ এবং ১৮৩৯ নাগাদ তা এক কোটি রুপিতে পৌঁছে যায়।"
ওই সময়ে ব্যাংক অব ইন্ডিয়া নামে লন্ডনে একটি যৌথ মূলধনী কোম্পানি গঠনের তোড়জোর শুরু হয়। ব্যাংকটি ভারতে এসে ইউনিয়ন ব্যাংকের ব্যবসা দখল করে নেবে এমন হুমকির কথা যুক্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল। অথচ ওই ব্যাংকটির উদ্যোক্তারা ছিলেন দ্বারকানাথেরই পুরোনো বন্ধুবান্ধব ও প্রভাবশালী ব্রিটিশ ব্যবসায়ী উইলিয়াম লিটল অব রিকার্ডস, লিটল অ্যান্ড কোম্পানি, আয়েনাস ম্যাকিনটোশ ও জন ক্যাম্পবেল।
তারা ৫০ লাখ পাউন্ড-স্টার্লিং মূলধন নিয়ে ব্যবসায় নামার প্রচারণা চালান। যার কার্যালয়গুলো থাকবে ভারতে ইংরেজদের প্রধান তিনটি প্রেসিডেন্সির রাজধানীতে। এমন প্রচারও ছিল যে, এটি আধা-সরকারি ব্যাংক অব বেঙ্গলকে অধিগ্রহণ করবে। সরকারি রাজস্ব সংগ্রহ করবে, কাগজের নোট ইস্যু করবে এবং সরকারের সকল বিদেশি আয় সংগ্রহ করবে। এছাড়া, তারা বেসরকারি এক্সচেঞ্জ ও ডিসকাউন্ট বিলের লেনদেনেও নামবে।
এই হুমকি সঙ্গতকারণেই ইউনিয়ন ব্যাংকের গড়রাজি অংশীদারদের রাজি করাতে বড় ভূমিকা পালন করেছিল।
কলকাতার বণিক সম্প্রদায়ের পাশাপাশি স্থানীয় পত্রিকাগুলো এই উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনাকে হুমকি হিসেবে দেখে এর বিরোধিতায় নামে। বিরোধিতা আসে ভারতবর্ষের কোম্পানি সরকারের পক্ষ থেকেও।
সে সময়ের প্রভাবশালী বেঙ্গল হরকরা পত্রিকার সম্পাদক ১৮৩৭ সালের ১১ এপ্রিল তার পত্রিকায় যুক্তি দিয়ে লিখলেন যে, লন্ডন থেকে নিয়ন্ত্রিত ব্যাংক অব ইন্ডিয়া স্থানীয় উদ্যোগ ইউনিয়ন ব্যাংকের চেয়ে ভালো ব্যবসা করতে পারবে না। তাদেরকেও কৃষি বাণিজ্যে বিনিয়োগ করতেই হবে, সেটা নীল হোক না অন্য কোনো কৃষিজাত পণ্য। তাই ব্যাংক দুটির মধ্যে একমাত্র ব্যবধান হবে, ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার থাকবে সরকারি অনুমোদনের চার্টার, যা ইউনিয়ন ব্যাংকের নেই।
জাতীয়বাদী সুরে সম্পাদক মহাশয় আরো লিখলেন, 'ভারতে বিদেশি দক্ষতা বা পুঁজির দরকার নেই। চাই শুধু ব্রিটেনে বাঁধামুক্ত রপ্তানির সুবিধা। এতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সৃষ্ট স্থানীয় পুঁজির দৈন্যতা যেমন দূর হবে, তেমনি যুদ্ধখরচের পরিবর্তে ভারতের নিজস্ব উন্নয়নে তা ব্যয় করা যাবে। স্থানীয় অভিজাতদের সম্মান ও উচ্চ বেতনের চাকরির সুযোগ বাড়বে।'
তবে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রতিযোগিতার হুমকি দেওয়া ব্যাংক অব ইন্ডিয়া কখনোই প্রস্তাবনা পর্যায় থেকে বাস্তবে রুপ নেয়নি। কেন এর উদ্যোক্তারা পিছু হটলেন, কী উদ্দেশ্য তারা ব্যাংক অব ইন্ডিয়া গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, আজো তা ইতিহাসের অমীমাংসিত প্রশ্ন।
১৮৩৭ সনে স্কটিশ বংশদ্ভূত উপনিবেশিক প্রশাসক ও কূটনীতিক জন ক্রফর্ড তার লেখা এক প্যামফ্লেটে ব্রিটিশ ভারতে বাণিজ্য উপযোগী সম্পদ, আর্থিক খাত ও বাণিজ্যিক খাতের উন্নয়নে কিছু সুপারিশ তুলে ধরেন। সেখানে তিনি নীল উৎপাদন ও হুন্ডি বিল ব্যবসা থেকে বাণিজ্যিক লেনদেনকে আলাদা করার প্রতি গুরুত্ব দেন। এবং কোলকাতার যেসব নীলকুঠি ও এজেন্সি হাউজ একইসাথে এই তিন ব্যবসা করছে তাদের তিনি সুবিধাবাদী 'ধূর্ত শেয়াল' বলে উল্লেখ করেন।
ক্রফর্ডের মতে, এরা ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের মধ্যস্বত্বভোগী হলেও তাদের জিম্মায় রাখা অর্থ অনুমানের ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদি খাতে খাটিয়ে অহেতুক ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে।
উপনিবেশিক এই দৃষ্টিভঙ্গি নিঃসন্দেহে স্থানীয় পুঁজিপতিদের ব্যবসায়িক দক্ষতা ও সফলতাকে খাটো করে। তবে একথাও সত্য যে, এই তিনটি খাতকে আলাদা রাখার গুরুত্ব এবং তা না হলে জালিয়াতির যে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে, সেটা তিনি ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন।
ক্রফর্ড আরও যুক্তি দেখান যে, ইংল্যান্ডে বিল লেনদেনের কাজ পেশাজীবী দক্ষ দালালেরা করে, কিন্তু ভারতে এমন কোনো শ্রেণির পেশাজীবী নেই। ফলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই ব্যবসাকে সুবিধা ও বৈধতা দানের বিষয়টিও ভারতে অনুপস্থিত। এজন্য ব্রিটেন ও ভারতের মধ্যে বিল বাণিজ্যে তিনি আলাদা একটি এক্সচেঞ্জ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব রাখেন।
তখন সুচতুর দ্বারকানাথ ক্রফোর্ড সাহেবের সাথে সুর মিলিয়ে বললেন, বিল বিনিময় ব্যবসাকে এজেন্সির হাত থেকে দূরে রাখতে তিনি অনেক আগে থেকে ইউনিয়ন ব্যাংককে এতে সম্পৃক্ত করার কথা ভাবছিলেন। তিনি আরও যুক্তি দিলেন, সরকার নির্ধারিত অগ্রিম মূল্যের খোঁজখবর রাখায় ইউনিয়ন ব্যাংক এই ব্যবসায় নামলে তাতে রপ্তানিকারকেরাই লাভবান হবেন।
অচিরেই তার বিল ব্যবসায়ের আরেক সমর্থক হিসেবে পেলেন অ্যাটর্নি থিওডোর ডিকেন্সকে। তিনি দ্বারকানাথকে সমর্থন করেই মত দিলেন যে, কলকাতায় এ ব্যবসা করার মতো যথেষ্ট পুঁজি রয়েছে। 'তাছাড়া আমরা যদি ইংল্যান্ডের সাথে এ ব্যবসা না করি, তাহলে বাধ্য হয়েই আরও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসায়ে নামতে হবে।'
বেঙ্গল হরকরা পত্রিকার সম্পাদক মহাশয় ব্যাংকের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক বিল ব্যবসার বিপক্ষে যুক্তি দিয়ে এবং বিল বিনিময় হাউজগুলোর পক্ষ নিয়ে লিখলেন, আনুষ্ঠানিক এক্সচেঞ্জ ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বিলের বিনিময় মূল্য কমে যাবে। এজেন্সিগুলোতে হুন্ডি বিল বেচাকেনা করে ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা রুপি ও পাউন্ডের মূল্যভেদে ৮ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত তাৎক্ষণিক লাভ করেছেন। মূল্য কমলে তারা ভারতে বিনিয়োগের উৎসাহ হারাবেন।
'ক্রফর্ড সাহেবের প্রস্তাবিত পরিক্কল্পনায় বিল বিনিময় মূল্য স্বর্ণমান অনুসারে ধরা হলে, তাৎক্ষণিক উৎপাদন ও মুনাফায় বিশ্বাসী ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা কী এদেশে টাকা পাঠাতে চাইবেন? তাছাড়া, ভারতে তারা দ্রুত লাভের আশায় বিনিয়োগ করে, মূলসহ লাভ বিলেতে ফেরত নিয়ে যান। তাই স্থানীয় পুঁজিই ভারতে উন্নতি সাধনের একমাত্র উপায়।'
এনিয়ে ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালক বোর্ড সদস্যরাও দুই শিবিরে অবস্থান নেন। তবে জুলাইয়ে যখন হুন্ডি ব্যবসায় নামার সিদ্ধান্ত ভোটে তোলা হলো, তখন দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রভাবেই তা ৪৬২-৬৩ ভোটের বিশাল ব্যবধানে পাস হয়ে যায়।
বিল ব্যবসায় নেমে বছরে মোট পুঁজির তিন-ভাগের একভাগ নিবেশ করে সামান্য লাভ করছিল ইউনিয়ন ব্যাংক। এটি ক্রয় ও বিক্রয়ের মধ্যকার সামান্য মূল্য ব্যবধানই ছিল ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা। তবে এই বিনিময় ব্যবসা আপাতদৃষ্টিতে নিরাপদ মনে হলেও ছিল ঝুঁকিতে ভরা। যেমন কলকাতায় কেনা বিলগুলোর মেয়াদ ছিল ১০ মাস মেয়াদি। কেনার সময় অনেক বিলেই থাকতো নীল রপ্তানির ইতিবাচক মূল্য, তবে এই মূল্য যখন-তখন কমে যাওয়ার বিপদ লেগেই থাকতো। অনেক সময় বিল বিক্রিকারী নীলকুঠিগুলো ১০ মাস পর তাদের প্রতিশ্রুত পণ্য চালান দিতেও ব্যর্থ হতো। তখন হুন্ডি ব্যবসায় ইউনিয়ন ব্যাংকের লন্ডন অংশীদার গ্লেন অ্যান্ড কোম্পানি এসব বিল প্রত্যাখ্যান করতো।
অর্থনীতিবিদ মাইকেল কিডরন বলছেন, ব্যবসায় ভালোমন্দ সময় থাকেই। নীল আমদানি-রপ্তানি কেন্দ্রিক এই বিল বাণিজ্যেও তা ছিল। ইউনিয়ন ব্যাংকের যথেষ্ট মূলধন থাকলে তারা এক বছর লোকসান দিয়ে অন্যবছর লাভ করতেই পারতো। কিন্তু তা ছিল না। শুধুমাত্র দ্বারকানাথ নিজের ও তার সহযোগীদের নীল ব্যবসায় পুঁজির উৎস বাড়াতেই ইউনিয়ন ব্যাংককে এই ব্যবসায় নামান।
দ্বারকানাথ ও তার সমর্থকদের বিল ব্যবসার এই অতি-উৎসাহ ব্যাংকের অন্যান্য মালিকদের ক্ষোভের জন্ম দেয়। তারা সরাসরি এ ব্যবসার বিরোধীতা শুরু করেন। একজন অংশীদার এও বলেন যে, কিছু নির্দিষ্ট ব্যবসায়িক হাউজের মাধ্যমে ব্যাংক পরিচালনা করা হচ্ছে।
তিনি দ্বারকানাথের নাম না উল্লেখ করলেও অভিযোগ করে বলেন, 'একজন ব্যক্তি, সে ইউরোপীয় না ভারতীয়, তা আমি বলতে চাই না। কিন্তু তিনি এত বেশি শেয়ারের মালিক যে তিনি সহজেই যেকোনো ভোটে জিতে যান।
ব্যাংকে দ্বারকানাথের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ:
কিরডন বলছেন, এই অভিযোগ সর্বাঙ্গে সত্য। কারণ ১৮৩৪ সালের পর থেকে মাত্র ছয়টি এজেন্সি হাউজ; কার, টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি, ককরেল অ্যান্ড কোম্পানি, গিলমোর অ্যান্ড কোম্পানি, হ্যামিলটন অ্যান্ড কোম্পানি, ফার্গুসন ব্রাদার্স এবং উইলিয়াম স্ট্রম থেকে ইচ্ছেমতো প্রতিনিধিদের পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছিল।
এভাবে ১৮৪৪ সাল পর্যন্ত ব্যাংকের নীতিমালা সম্পূর্ণ নিজ আয়ত্তে রাখেন দ্বারকানাথ। এই নিয়ন্ত্রণ শুধু তার সবচেয়ে বেশি শেয়ার মালিকানার কারণেই নয় বরং বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনসহ তার ওপর নির্ভরশীল ব্যবসায়ী সবাইকে শেয়ার মালিকানা দিয়ে ধরে রেখেছিলেন। নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে বড় নজির হলো এ. এইচ. সিম নামক এক আমলার ঘটনা।
সিম ছিলেন একজন হিসাবরক্ষক। ১৮৩৮ সনে কাজে সামান্য কিছু ভুল ধরা পড়ায় তাকে বহিস্কার করা হয়। পরে দ্বারকানাথ নিয়ন্ত্রিত শেয়ারহোল্ডারদের ভোটে তাকে চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ১৮৩৯ সালের মে মাসে ভারতীয় কেরানিদের একজন দ্বারকানাথকে জানান, সিম ব্যাংক হিসাব জালিয়াতি করে এক লাখ ২০ হাজার ৬০০ রুপি আত্মসাৎ করেছেন। এই ঘটনা জানা মাত্রই অন্যান্য প্রভাবশালী পরিচালক উইলিয়াম কার, লংভিল ক্লার্ক এবং চেয়ারম্যান জেমস কুলেনের সাথে পরামর্শ করে দ্বারকানাথ বিষয়টি গোপন রাখার শর্তে নিজে সেই অর্থ পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেন। তবে বিষয়টি গোপন থাকেনি এবং আমানতকারীদের আতঙ্কিত মনোভাব দুর করতে নিজের পকেট থেকেই তা দ্বারকানাথ শোধ করে দেন।
এই ঘটনার পর ব্যাংকের অসন্তুষ্ট শেয়ারহোল্ডাররা দ্বারকানাথের ক্ষমতা সীমিত করতে একটি বিশেষ সভা আহবান করেন। কিন্তু, ৪০ শতাংশ ভোটের অধিকারী ৩০ শতাংশ শেয়ারহোল্ডার ছিলেন কলকাতার বাইরের বাসিন্দা। তাদের পরিবর্তে তাদের প্রতিনিধিরা এই সভায় যোগ দিয়ে ভোট দিলে ব্যাংকে ক্ষমতার ভারসাম্যই পাল্টে যাবে দ্বারকানাথ তা ভালই বুঝেছিলেন। তাই নিজের পক্ষের সবাইকে নিয়ে আরেকটি ভোটের মাধ্যমে বিশেষ সভায় প্রতিনিধি গ্রহণকে বড় ব্যবধানে বাতিল করে দেন।
দ্বারকানাথকে ঠেকাতে এবার ক্ষুদ্ধ ওইসব অংশীদার তার বন্ধু জর্জ জেমস গর্ডনকে লক্ষ্যবস্তু বানালেন। ১৮৪০ সালে জেমস ইয়াং এর জায়গায় গর্ডনকে ব্যাংক সচিব নিয়োগ দেন দ্বারকানাথ। লন্ডনের পুঁজিবাজারে ১৮৩০-৩৩ সনের ধসে সর্বস্ব হারিয়ে রিক্ত হস্তে ভারতে আসেন এই গর্ডন। আর্থিক ক্ষতি থেকে বাঁচতে তার দরকার ছিল উচ্চ বেতনের চাকরি। দ্বারকানাথ তাকে চাকরি তো দিলেনই, তার ওপর আবার এক বোর্ড সভা ডেকে বেতন ১৬শ থেকে বাড়িয়ে আড়াই হাজার রুপি ধার্য করলেন। এখানেও দ্বারকানাথের প্রভাবের মুখে বড় ভোটের ব্যবধানে হেরে যান বিদ্রোহী অংশীদাররা।
এদিকে ১৮৪০ সনের বোর্ড সভায় নীল চাষকারী কুঠিগুলোকে অসীম ঋণদানের লক্ষ্যে একটি বিশেষ ঋণ শ্রেণীকরণ চালু করা হয়। শেয়ারহোল্ডারদের সাথে কোনোপ্রকার আলোচনা ছাড়াই এরপর পরিচালকরা অবাধে ঋণ দেওয়া শুরু করলেন। নীলকুঠির বার্ষিক উৎপাদন থেকে ঋণ পরিশোধের শর্ত ছিল। এজন্য তাদের নীল কারখানা, প্রক্রিয়াকরণ যন্ত্রপাতি এবং জমি জামানত রাখা হলো।
তবে নীল চাষের এজেন্সিগুলো তাদের চাহিদামতো ঋণ নিয়ে সুবিধামতো পরিশোধের সুযোগ পেতো। এই ঋণ উদ্যোগ ছিল ইউনিয়ন ব্যাংকের চুক্তির বরখেলাপ। কারণ, সেখানে চার মাস কিস্তি না দিলেই জামানত বাজেয়াপ্তের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সেই বিধি এড়াতে নীল উৎপাদকদের প্রতি তিন মাস অন্তর সুদ দিয়ে ঋণ নবায়নের সুযোগ দেওয়া হয়।
১৮৪২ সালের বাণিজ্যিক সংকটের সময় ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে এভাবে ঋণ নেওয়া বেশকিছু বড় নীল উৎপাদক ফার্ম দেউলিয়া হয়ে গেলে, ইউনিয়ন ব্যাংকও বিপুল লোকসান দেয়। এই লোকসানের ব্যাখ্যা চেয়ে কোম্পানি সচিবকে ডেকে পাঠান শেয়ারহোল্ডাররা। সচিব গর্ডন লোকসানের কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। এক বছর ধরে তিনি এই মিথ্যা বিবৃতি দিয়ে গেছেন।
তবে ১৮৪৩ সালে লোকসানের গোমড় ফাঁস হয়ে যায়। এসময় ব্যাংকের একটি কমিটি জেমস গর্ডনের সহযোগিতায় বা অবহেলায় গিলমোর কোম্পানিকে দেওয়া ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৬৬৩ রুপি সম্পূর্ণ লোকসান হওয়ার অভিযোগ তোলেন।
১৮৪০ সালে দুই লাখ ৭১ হাজার ৯৫ রুপি একটি কয়লা খনি ক্রয়ের জন্য ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় গিলমোর। কিন্তু তারা কয়লা খনিটি ক্রয়ে ব্যর্থ হলে সেটি ভিন্ন মালিকানায় চলে যায়।
সঙ্গতকারণেই এবার ঋণচুক্তি অনুসারে কোম্পানির সম্পদ ইউনিয়ন ব্যাংকের অধিগ্রহণ করার কথা। কিন্তু, গর্ডন কোনো এক অজ্ঞাতকারণে সেই চুক্তিপত্র গিলমোর অ্যান্ড কোম্পানির একজন সদস্য উইলিয়াম এস. স্মিথকে দিয়ে দেন। স্মিথ আবার সেই চুক্তিপত্র কয়লা খনি কেনা এজেন্সিটিকে দিয়ে দেন। ফলে ব্যাংকের হাতে কোনো আইনি জামানতই আর থাকে না।
আলোচিত লোকসানের বাকি অর্থ নীল, তামা এবং চিনি ব্যবসায়ে গিলমোর অ্যান্ড কোম্পানিকেই ঋণ দেন গর্ডন। এসময় ব্যাংক শুধু এসব পণ্যের জাল মূল্যই নির্ধারণ করেনি বরং খেলাপি হওয়ার পরও ঋণগ্রহীতাকে গুদাম থেকে পণ্য সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ দেয়।
ইউনিয়ন ব্যাংকে জড়িত একদল ছোট ব্যবসায়ী পরিচালনা কাঠামো সংস্কারের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেন। তাদের চেষ্টা সফল হলে হয়তো ১৮৪৭ সালের সংকটের পরও ব্যাংকটি টিকে থাকতো। কিন্তু দ্বারকানাথ ও কয়েকজন শীর্ষ অ্যাটর্নি বড় বাণিজ্যিক কিছু হাউজের সাথে মিলিতভাবে সেই চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেন।
দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্য......