কেন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে তারকাদের সংসার?
বলিউড তারকাদের বিয়ে যেন জাতীয় সংবাদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এই তো মাত্র কিছুদিন আগে ভিকি কৌশল ও ক্যাটরিনা কাইফ যখন সাত পাকে বাঁধা পড়লেন, তা নিয়ে উৎসাহ-উন্মাদনার কমতি ছিল না গসিপ ম্যাগাজিন, ট্যাবলয়েড নিউজপেপার থেকে শুরু করে মূলধারার গণমাধ্যমগুলোরও।
এমনকি এখনও পুরোপুরি রেশ কাটেনি সেই বিয়ের। কিন্তু একই সমান্তরালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে আরেকটি প্রশ্নও ঘুরেফিরে এসেছে অনেকবার — ভিক্যাটের বিয়েটা টিকবে তো? কিছুদিন পরই বিচ্ছেদের করুণ সুর বাজবে না তো তাদের আপাত স্বপ্নিল সম্পর্কে?
এসব প্রশ্নকর্তাকে নিছকই 'অপরের সুখ দেখে ঈর্ষান্বিত' বলে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। কেননা আমরা যদি একটু পেছন ফিরে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব, বলিউডসহ সামগ্রিকভাবে ভারতীয় ক্রীড়া ও বিনোদন জগতে বিবাহ-বিচ্ছেদ এখন একটা স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তাসের ঘরের মতোই ভেঙে পড়ছে তারকাদের সংসার।
এই ২০২১ সালেই যেমন ঘর ভেঙেছে সামান্থা রুথ-নাগা চৈতন্য, কীর্তি কুলহারি-সাহিল সেহগাল, হানি সিং-শালিনি সিং, নিশা রাওয়াল-করন মেহতাদের মতো তারকা দম্পতিদের। আট বছর সংসার করার পর নিজ নিজ পথ বেছে নিয়েছেন ক্রিকেটার শিখর ধাওয়ান ও তার স্ত্রী আয়েশা মুখার্জিও। তবে চলতি বছর সবচেয়ে আলোচিত বিচ্ছেদটি ছিল নিঃসন্দেহে আমির খান ও কিরণ রাওয়ের। পনেরো বছরের সম্পর্কের ইতি টেনেছেন তারা।
তাই যে কারো মনেই প্রশ্ন জাগতে বাধ্য, কেন একের পর এক বিচ্ছেদ ঘটছে তারকাদের সম্পর্কে? এ ব্যাপারে খানিকটা ধারণা দিয়েছেন সেলিব্রিটি ডিভোর্স লইয়ার ম্রুনালিনি দেশমুখ, যার মক্কেলদের তালিকায় রয়েছেন আমির খান, কারিশমা কাপুরের মতো বাঘা বাঘা সব নাম।
"অভিনেতারা রোল মডেল। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষের বোঝা উচিত যে সে অভিনেতাদের চিন্তাধারাকে নিজেদের জীবনে খাপ খাওয়াতে পারবে না," ম্রুনালিনি বলেন।
"একটা কথা বলি আপনাদের। (করোনাকালীন) লকডাউনে বিবাহিত দম্পতিদের দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা একে অন্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। ওয়ার্ক ফ্রম হোম সংস্কৃতি স্বাস্থ্যকর বৈবাহিক সমীকরণের জন্য সহায়ক নয়। সারাক্ষণ পরস্পরের সঙ্গে সময় কাটাতে হলে বিরক্তি কেবলই বাড়ে। এছাড়াও অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে ধৈর্যের অভাব, একে-অন্যের পছন্দ-অপছন্দের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পাড়া, সবকিছুতে 'আমরা'র বদলে 'আমি' জাতীয় চিন্তা করা, এবং কর্মক্ষেত্রে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া, যা অনেকসময় পরকীয়ার সূত্রপাত ঘটায়।"
এদিকে আরেক সেলিব্রিটি ডিভোর্স লইয়ার বন্দনা শাহ কাজ করেছেন মালাইকা অরোরা, রনবীর শোরের সঙ্গে। তিনি বলেন, "আমি আপনাকে শুধু দুটি উদাহরণ দেব। একটি আমার পরিচিত এক প্রযোজক-পরিচালকের স্ত্রীর, যিনি সাম্প্রতিক অতীতে সবার সামনে ভান করে গেছেন যে তাদের সম্পর্ক ঠিকঠাকই চলছে। অথচ তার স্বামী এক বছর ধরে বিদেশে রয়েছেন। স্বামীর ৫০তম জন্মদিন তারা উদযাপন করেননি, দিওয়ালিতেও দেখা করেননি। আমি যখন তাকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলাম, তিনি প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললেন। আরেকটি ঘটনা একজন অভিনেতার স্ত্রীর, যিনি অন্য মানুষদের জীবনের ব্যাপারে খুবই কৌতুহলী। এদিকে তিনি তার স্বামীর কাছ থেকে ডিভোর্সের ফাইল করেছেন, কিন্তু স্বামী তার নামে বসবাসের বাড়িটি লিখে না দেওয়ার আগে ডিভোর্স নেবেন না।"
তবে ম্রুনালিনির মতো বন্দনাও বলেন, করোনাকালীন লকডাউনে অনেক তারকা দম্পতির সম্পর্কেই চিড় ধরেছে। "আগে আপনাকে কখনোই দিনের ২৪ ঘণ্টা স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে কাটাতে হতো না। আপনি যদি ক্রমাগত আপনার স্বামী বা স্ত্রীর পাশে বসে থাকেন, আপনাদের মধ্যে এমন অনেক কথোপকথন হতে বাধ্য যেগুলো তর্ক থেকে ঝগড়া-বিবাদে রূপ নেবে। এর সঙ্গে এই ব্যাপারটিও মাথায় রাখুন যে লকডাউন এসে অনেক পরিবারেই আয়ের পথ বন্ধ করে দিয়েছে।
"বিয়ে কি এই ধারণার উপর গড়ে ওঠেনি যে প্রত্যেকে তার সঙ্গীকে একটি বিলাসী জীবন দেবে? আপনি হয়তো বলবেন যে ঝগড়াঝাঁটি তো হতেই পারে, কিন্তু আগে এরকম হলে আপনি কোনো বন্ধুর বাসা বা নিকটস্থ কফি শপে গিয়ে, অথবা সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখে নিজের স্ট্রেস কমাতে পারতেন। কিন্তু কোভিডের কারণে সেগুলো সম্ভব হয়নি।
"অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরও বাড়ি মিডিয়াম সাইজের। সবাই তো আর প্রকাণ্ড প্রাসাদে বাস করে না। কতক্ষণই বা আপনি শুধু রান্না করে আর ঘর গুছিয়েই সময় পার করবেন? একসময় কি আপনাদের মধ্যে মতের অমিল হবে না? এদিকে ঘরের কাজের মহিলারাও বড় বড় চোখ করে আপনার দিকে তাকিয়ে থাকবে, যা দম্পতিদের মধ্যকার সম্পর্ককে আরো বেশি ক্লস্ট্রোফোবিক করে তুলবে।"
সম্পর্কে টানাপোড়েন যে শুধু বলিউড ও হিন্দি টিভি সিরিয়ালের তারকাদের মধ্যেই হয়, এ কথা মানতে অবশ্য নারাজ রাভিনা ট্যান্ডন। একই মত প্রযোজক তনুজ গর্গেরও। তিনি বলেন।, "আমার মনে হয় আলাদা করে শুধু বিনোদন জগতের দিকে আঙ্গুল তোলাটা আনফেয়ার। সম্পর্কে ভাঙন সর্বত্রই হচ্ছে। পার্থক্য শুধু এটাই যে আমাদের জগতের ডিভোর্স বা সেপারেশনের ঘটনাগুলোকে বড় করে দেখা হয়, ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সংবাদ প্রচার হয়।
"আমার মতে বৈবাহিক সম্পর্কের স্থায়িত্ব কমে আসার কারণ অনেক। এর মধ্যে একটি হলো ডিভোর্সের ব্যাপারে এখন আর কোনো সোশ্যাল স্টিগমা না থাকা। ক্যারিয়ার নিয়ে সচেতনতাও বাড়ছে। এছাড়া পেশাদার সাফল্যের ফলে বাড়ছে স্বাধীনতা, আত্মবিশ্বাস ও চারিত্রিক দৃঢ়তাও। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দম্পতিদের মধ্যে পারস্পরিক আশা-আকাঙ্ক্ষার মেলবন্ধন না ঘটা। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই মত পোষণ করি যে সামাজিক বিধিনিষেধের কথা না ভেবে সকলের উচিত নিজের সুখের কথা ভাবা, এবং মন ও হৃদয়কে অনুসরণ করা।"
এদিকে ফ্যাশন ডিজাইনার অ্যানা সিং জ্যাকি শ্রফ ও অজয় দেবগনের প্রায় সকল শুটেই থাকেন, এবং হৃত্বিক রোশানের প্রাক্তন স্ত্রী সুজান খানের সঙ্গে তার একটি আর্টিফ্যাক্টের দোকান রয়েছে। তিনিও একই ধরনের কথাই বলে।
"এটি (সম্পর্কে বিচ্ছেদ) কি কেবল গ্ল্যামার জগতেই ঘটছে? না। আশেপাশে সবখানেই প্রচুর বিয়ে ভাঙছে। একটু খেয়াল করলেই আপনি অসংখ্য অসুখী দম্পতির দেখা পাবেন। আসলে আমার তো বরং এটাই মনে হয় যে সাধারণ মানুষদের চেয়ে আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে বিয়ে টেকার শতকরা হার অনেক বেশি। আমাদের অনেক বড় বড় অভিনেতাই কি দীর্ঘ, স্থায়ী বৈবাহিক সম্পর্কে রয়েছেন না?" প্রশ্ন তোলেন অ্যানা।
তবে জনপ্রিয়তা টিভি অভিনেত্রী দীপশিখা নাগপাল (কাজ করেছেন 'কিটি পার্টি', 'পেশওয়া বাজিরাও' ও 'খিচড়ি রিটার্নস'-এ) জানান, তিনি তার দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে সকল দ্বন্দ্ব মিটমাট করে আবার সম্পর্কটিকে আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন।
তিনি বলেন, "আমরা আবার ব্রেক আপ করেছি। আমি চেষ্টা করেছিলাম, কেননা আমি ভবিষ্যতে কখনো এই ভেবে আফসোস করতে চাইনি যে আমি কখনো চেষ্টাই করিনি। কিন্তু শুধু একদিক দিয়ে চেষ্টা করলে তো কোনো সম্পর্ক জোড়া লাগে না।"
এদিকে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর স্ত্রী আলিয়া আবার অন্য কথা বলেন। "নওয়াজ আর আমি মিটমাট করে নিয়েছি, কারণ আমি আমার ভুলটা বুঝতে পেরেছি। তাছাড়া আমার মনে হয় সে-ও বুঝতে পেরেছে যে আমাদেরকে তার দরকার। আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি এই অর্থে যে, একজন তারকা হিসেবে আমি তাকে বিচার করতে পারছিলাম না। কিন্তু আমি এখনো মনে করি ইন্ডাস্ট্রিতে পায়ের তলায় মাটি পাওয়ার আগে স্ট্রাগলিং অবস্থায় সে আমাদেরকে যতটা সময় দিত, এখনো আমাদের ঠিক ততটা সময়ই দেওয়া উচিত। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমরা আবার এক হয়েছি। আমাদের সন্তানদের মঙ্গলের জন্য এটি জরুরি ছিল।
নিজের অজান্তেই আলিয়ার চেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন ডার্মাটোলজিস্ট রুবি ট্যান্ডন, যার সঙ্গে তার টিভি অভিনেতা-স্বামী অমিত ট্যান্ডনের ('ক্যায়সা ইয়ে পেয়ার হ্যায়', 'দিল মিল গায়ে') সম্পর্ক ২০১৭ সালে এতটাই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল যে আরেকটু হলে বিচ্ছেদটা হয়েই যেত। তিনি বলেন, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যই বিয়ের পর নিজেকে পরিবর্তন করা প্রয়োজন।
"বৈবাহিক সম্পর্কগুলোকে বাঁচানো দরকার। মানুষ বিনা কারণেই বাস্তবতা থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকতে চায়। তারা বলে মানবজাতির অংশ হিসেবে তাদের বিবর্তন ঘটেছে, অথচ নিজেদের ঘরের ভাঙন তাদের কাছে বিবর্তন নয়। নারীরা অকারণেই পুরুষদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মেতে আছে। জগতের কাছে হয়তো আপনি পুরুষোচিত হতে পারেন, কিন্তু স্বামীর কাছে আপনার উচিত সেই নারীটিই হয়ে থাকা, যে নারীকে সে বিয়ে করেছে। একজন নারী ইতোমধ্যেই ক্ষমতাবান। কত ধরনের মানুষ ও বিষয়কেই সে প্রতিদিন সামলায় — তার মা, শাশুড়ি মা, স্বামী, বাচ্চাকাচ্চা, ঘর ও অফিসের কাজ। এরপর আবার অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিযোগিতা তাকে অহেতুক আক্রমণাত্মক করে তুলছে। আমি একসময় অনেক বেশি হাইপার ছিলাম, কিন্তু এখন নিজের সঙ্গে সন্ধি করেছি, নিজেকে নিয়ে কাজ করেছি।"
তবে রুবি আরো বলেন, "একজন পুরুষের উচিত তার স্ত্রীকে সম্মান করা। সে তার স্ত্রীকে অত্যাচার করতে, মারধোর করতে বা তার উপর চিৎকার করতে পারে না। আর সবকিছুর উপর, স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই উচিত তাদের জীবনে সকল অবাঞ্ছিত মানুষের থেকে দূরে থাকা, যারা তাদের কানে বিষ ঢালে এবং তাদের ভেতর থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়া বের করে আনে।"
সিনিয়র অভিনেত্রী আয়েশা ঝুলকা বলেন, "ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির এত এত সম্পর্কে ঝামেলা হওয়ার কথা শুনে আমি আগে কেবল অবাকই হতাম না, হতবাক হয়ে যেতাম। কিন্তু আপনি যদি আরেকটু পরিণত মানসিকতা নিয়ে চারপাশে তাকান, তাহলে বৃহত্তর বাস্তবতাটা আপনার চোখে পড়বে। টিভি বা ফিল্ম জগতের নয় এমন অগনিত পরিবারেও সম্পর্কের সমস্যা চলছে।"
নিজের সফল সম্পর্কের মন্ত্র হিসেবে আয়েশা বলেন, "ধৈর্য খুবই জরুরি বিষয়। সঙ্গ ও সাহচর্য আরেকটি বিষয় যেটির কথা মাথায় রাখার দরকার। আজকাল বিয়ে বলতে সঙ্গ ও সাহচর্য নয়, এক ঝুলি প্রত্যাশাকে বোঝা হচ্ছে।
"একসময় আমি অনেক রগচটা ও বদমেজাজি ছিলাম। কিন্তু এখন আমি শান্ত হয়েছি। অবশ্যই, আমার ও আমার স্বামীর কিছু দিন ভালো কাটে, আবার কিছু দিন খারাপ কাটে। কিন্তু আমি জীবনে শুধু একটা বিষয় নিয়েই পড়ে থাকি না। আমি অন্যান্য দিকেও মনোযোগ দিই, যেমন প্রাণিকল্যান নিয়ে কাজ করি। এভাবে অন্য বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মেতে থাকলে আপনি সেগুলো থেকে সুখ পাবেন, আর বিয়ের দুঃসময়গুলোকেও পেছনে ফেলতে পারবেন।
অভিনয় থেকে শুরু করে অন্যান্য পেশার মানুষেরা কাউন্সেলিং নেওয়ার পরও শেষমেশ সম্পর্কে ইতি টানলে তার কি খারাপ লাগে? এ প্রশ্নের জবাবে অ্যাডভোকেট ম্রুনালিনি বলেন, "অনেকেই আসলে পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে আলাদা হয়ে যায়। কিন্তু অবশ্যই, আমার খুব খারাপ লাগে যখন বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে পড়ে। তবুও আমি আমার সর্বাত্মক চেষ্টা করি।"
এরপর তিনি আরো যোগ করেন, "সঙ্গীত জগতের এক পুরুষকে আমি চিনি যিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিয়ে না করার। তিনি কেবলই স্বল্পমেয়াদি সম্পর্কে থাকবেন।"
আগামী কয়েক দশকের মধ্যে যদি বিনোদন জগতের তারকাদের মাঝে এটিই 'নিউ নরমাল'-এ পরিণত হয়, অবাক হবেন না যেন!
- সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া