রবার্ট ডি নিরো থেকে জেরেমি স্ট্রং: মেথড অ্যাক্টিংয়ের জনপ্রিয়তা ও আবেদন কি কমে যাচ্ছে?
রবার্ট ডি নিরো তার প্রজন্মের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেতা। গতবছরও জনপ্রিয় বিনোদন ম্যাগাজিন, জিকিউ এ দাবি করেছে। এবং এই দাবিকে কোনভাবেই বিতর্কিত বলা যাবে না।
এই দাবির পিছনে কারণ হিসেবে জিকিউয়ে বলা হয়, "ডি নিরো মেথড অ্যাক্টিংকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তিনি 'ট্যাক্সি ড্রাইভার'-এর প্রস্তুতি হিসেবে নিউইয়র্কে ক্যাবের লাইসেন্স নিয়েছেন, 'গডফাদার'-এর জন্য ইতালিয়ান শিখেছেন, থেকেছেন সিসিলিতে, 'র্যাজিং বুল'-এর জন্য ৬০ পাউন্ড ওজন বাড়িয়েছেন এবং 'ট্রু কনফেশন্স'-এর জন্য শিখেছেন ল্যাটিন। হলিউডের সবচেয়ে পরিশ্রমী ব্যক্তি ছিলেন ডি নিরো।"
সহজ কথায়, চরিত্রের প্রয়োজনে যদি অভিনেতারা কাঁচা মাছ না খায়, পশুর মৃতদেহের মধ্যে না ঘুমায় ('দ্য রেভেন্যান্ট'-এ লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও), হুইলচেয়ারে বসে সেটের কর্মীদের হাতে খাবার না খায় ('মাই লেফট ফুট'-এ ড্যানিয়েল ডে-লুইস), বা ওজন কমিয়ে কাঠি না হয়ে যায় ('ডালাস বায়ারস ক্লাব'-এ ম্যাথিউ ম্যাককনয়ে), তাহলে তো তারা কসপ্লে করছে।
আর শুধু পোশাক পরে চরিত্রে প্রবেশের ভান ধরেই কেন তারা সব অর্থ, খ্যাতি ও সম্মাননা পাবেন? উপরে যেসব অভিনেতার নাম বলা হয়েছে, তাদের সকলেই এই অসাধারণ মেথড অ্যাক্টিংগুলোর জন্য অস্কার পেয়েছেন।
অস্কারের আগে প্রচারণার খাতিরে অভিনেতাদের মেথড অ্যাক্টিং নিয়ে কথা বলাটা তো একটি রীতিতেই পরিণত হয়েছে।
মেথড অ্যাক্টিংয়ের ব্যাপারটাই এমন। এ নিয়ে কথা না বললে কেউ জানতেই পারবে না কীভাবে অভিনয় করেছেন আপনি।
গত মাসে ভোগ ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে লেডি গাগা জানান 'হাউজ অব গুচি'-তে অভিনয় শুরু করার এক বছর আগেই তিনি চরিত্রে প্রবেশ করেছিলেন। প্যাট্রিজিয়া গুচির চরিত্রে অভিনয় করার জন্য তিনি পুরো নয় মাস ইতালীয় অ্যাকসেন্টে কথা বলেছেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, তার এই মেথড অ্যাক্টিং সিনেমায় তেমন কাজে আসেনি। বরং উল্টো ফলাফল এনেছে। তার ইতালীয় উচ্চারণের সঙ্গে সিনেমার বাকিদের উচ্চারণে এতোটাই তফাৎ ছিল যে মনে হচ্ছিল, সম্পূর্ণ ভিন্ন দেশ থেকে এসেছেন তারা।
এরপরও অস্কারের মনোনয়নের জন্য গাগার নাম কিন্তু জোরেশোরেই শোনা যাচ্ছে।
এদের সবার অভিনয়ের মেথড, মেথডের আড়ালের পাগলামি এবং মেথডের নামে প্রচারণাটুকু গ্রহণ করেছে গণমাধ্যম ও সাধারণ জনতা। কিন্তু সমস্যা বেধেছে জেরেমি স্ট্রংয়ের মেথড নিয়ে।
জনপ্রিয় এইচবিও শো 'সাকসেশন'-এর কেন্ডাল রয়ের ভূমিকায় অভিনয় করেন জেরেমি। সাকসেশনের তৃতীয় মৌসুম ছিল গত বছরের সবচেয়ে জনপ্রিয় টিভি সিরিজ। গড়ে ১৪ লাখ দর্শক দেখেছে এর প্রতিটি এপিসোড। অ্যামি, গোল্ডেন গ্লোবের মতো অ্যাওয়ার্ড শোগুলোতেও চলছে সাকসেশনের জয়জয়কার।
এই সিরিজে জেরেমি চরিত্র কেন্ডাল বলতে গেলে একজন সমাজচ্যুত ব্যক্তি। আর অভিনয়ের ব্যাপারে জেরেমির বোঝাপড়া বেশ তীব্র ও বাকিদের চেয়ে আলাদা। যে কারণে এই চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে জেরেমির মেথড নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি এতদিন।
কিন্তু গত মাসে নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনের প্রকাশিত একটি নিবন্ধ বদলে দিয়েছে সব। এই নিবন্ধে জেরেমির সহশিল্পীদের থেকে শুরু করে অনেকের ভাষ্য উঠে এসেছে তার মেথড অ্যাক্টিং সম্বন্ধে। জেরেমির মেথডকে 'স্বেচ্ছাচারী' ও 'লোক দেখানো তীব্রতা' বলে ঘোষণা করা হয় এই নিবন্ধে।
জেরেমির সহ-অভিনেতা ব্রায়ান কক্স এই মেথডকে একটি "আমেরিকান রোগ" হিসেবে আখ্যা দেন। সহ-অভিনেতা কিরেন কালকিন বলেন, "জেরেমির মেথড তাকে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু আমাদের করে না।"
নিউ ইয়র্কারের এই নিবন্ধ সাকসেশনের মতোই দ্রুত ভাইরাল হয়ে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জেরেমিকে দাম্ভিক, একগুঁয়ে ও আরও নানান তকমা দিতে শুরু করেন ভক্তরা।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, জেরেমি কখনোই নিজেকে মেথড অ্যাক্টর হিসেবে দাবি করেননি। ডেনিয়েল ডি লুইসের মতো শুটিং চলাকালে সবসময় চরিত্রে থাকেন না তিনি। চরিত্রে প্রবেশের ক্ষেত্রে তার দর্শন হচ্ছে, "আমি যা করছি তাতে বিশ্বাস করতে হবে আমার"। সহজ কথায়, চরিত্রের বাস্তবতাকে বিশ্বাস করেন জেরেমি।
তবে তা করতে গিয়ে তিনি যা যা করেন, তা কিছুটা হাস্যকর (অন্তত নিবন্ধে যে যে উদাহরণ দেওয়া হয়েছে, সেগুলো)। যেমন, ট্রায়াল অব শিকাগো সেভেনের শুটিংয়ে তিনি পরিচালক অ্যারন সরকিন্সকে অনুরোধ করেছিলেন তার মুখে কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে। পরিবার থেকে তার চরিত্রের বিচ্ছিন্নতাকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে সহ-অভিনেতাদের সঙ্গে মেকআপ ট্রেইলারে অবস্থান করতে অস্বীকৃতি জানান জেরেমি।
কিন্তু কেইপ ফিয়ারের জন্য ডি নিরোর দাঁত ওলটপালট করে ফেলা, বা দ্য পিয়ানিস্টে নিজের চরিত্রে প্রবেশের স্বার্থে আদ্রিয়ান ব্রডির নিজের গাড়ি-বাড়ি বিক্রি দেওয়া থেকে কোনো অংশে বেশি হাস্যকর না এটা।
নিউ ইয়র্কারের এই নিবন্ধ অভিনয়ের ব্যাপারে হলিউডের বর্তমানে ধারার প্রতি পক্ষপাত বজায় রেখেই লেখা হয়েছে। এসময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেতাদের একজন রবার্ট ডাউনি জুনিয়র, যিনি সিনেমার স্ক্রিপ্ট পড়তেই পছন্দ করেন না। ডোয়াইন জনসন, কেয়ানু রিভস বা অন্যান্য সুপারহিরো সিনেমার অভিনেতারা প্রচুর জনপ্রিয় ও ব্যবসাসফল হলেও অভিনয়ের প্রতি তাদের উদ্দীপনা ও প্রচেষ্টা মোটেও ডি নিরোদের মতো না।
তর্কসাপেক্ষে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেতা ডেনিয়েল ডি লুইস অবসর নিয়েছেন ইতোমধ্যে। ডি নিরো ও আল পাচিনো আছেন তাদের অভিনয় ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে। আধুনিক অভিনেতাদের কাছে মেথড অ্যাক্টিংকে পাগলামো মনে হওয়াটা তাই তেমন অস্বাভাবিক না।
একজন মেথড অ্যাক্টরকে সামাল দিতে পরিচালকদেরও বাড়তি পরিশ্রম করতে হয়। আধুনিক পরিচালকদের অনেকেই এই বাড়তি শ্রমটা ঘাড়ে নিতে চান না। যে কারণে এক অর্থে মেথড অ্যাক্টিংই বিরল হয়ে আসছে হলিউডে। ডিক্যাপ্রিওর দ্য রেভেন্যান্টের পর উল্লেখযোগ্য কোনো মেথড অ্যাক্টিংই দেখেনি বিশ্বের সবচেয়ে স্বনামধন্য সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিটি।
তবে জেরেমি থাকছেন। ফেসবুক, টুইটারের সমালোচনা যে তিনি গায়ে মাখবেন না সেটা বলেই দেওয়া যায়। আর সহ-অভিনেতারা যতই অভিযোগ করুক না কেন, শো রানাররা থাকছেন জেরেমির পাশেই।
সাকসেশনে নিজের চরিত্র সম্বন্ধে জেরেমি বলেছিলেন, "আমি নিজের জীবনকে যতটা গুরুত্বের সাথে নেই, তাকেও ততটা গুরুত্বের সাথেই নেই।" সাকসেশন ভক্তরা এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করবেন না। জেরেমিকে অ্যামি, গোল্ডেন গ্লোবের মতো সব ধরনের সম্মাননা জেতানো কেন্ডালকে আবার পর্দায় দেখার জন্যই অপেক্ষা করবেন তারা।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান।
অনুবাদ: কিরো আদনান আহমেদ।