বন বিদ্যালয়: কেন কংক্রিটের জঙ্গল ছেড়ে সত্যিকারের জঙ্গলমুখী এশিয়ার কিছু দেশের শিক্ষাব্যবস্থা?
শহুরে জীবনের নিরাবেগ রুক্ষতা কাঁহাতক আর ভালো লাগে? প্রাপ্তবয়স্করাই যেখানে শহরের ইট-পাথরের জঞ্জাল আর যান্ত্রিকতায় হাঁসফাঁস করতে থাকে, সেখানে ছোট কচিকাচাদের কথা ভেবে দেখুন তো!
এখানে না আছে শিশুর খেলার মাঠ, না আছে প্রকৃতির প্রেমে পড়বার মতো পর্যাপ্ত সবুজ। নিজেদের শরীরের চেয়ে ভারি ব্যাগ কাঁধে চেপে, রোজকার যানজট ঠেলে তাদেরকে স্কুলে যেতে হয়। সেখান থেকে নানা কোচিং ক্লাসের ভোগান্তি শেষে, আবারো একইভাবে ফিরতে হয় বাসায়। শরীরজুড়ে সঙ্গী করে রাজ্যের ক্লান্তি, অবসাদ।
এভাবে হারিয়ে যায় তাদের শৈশব-কৈশোর। বিকাশের আগেই লোপ পেতে থাকে তাদের সূক্ষ্ম আবেগ-অনুভূতি-মানবিকতাবোধ। একেকজন পরিণত হয় 'একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার উপযোগী' যন্ত্রমানবে!
তবে চিরন্তন বাস্তবতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাতে শুরু করেছে আমাদের এই এশিয়া মহাদেশেরই কয়েকটি দেশ। কংক্রিটের জঞ্জল থেকে মুক্ত করে, স্কুলগুলোকে তারা নিয়ে যাচ্ছে সত্যিকারের জঙ্গলে। প্রকৃতির সংস্পর্শে এসে কোমলমতি শিশুদের সামনে উন্মুক্ত হচ্ছে সম্ভাবনার অফুরন্ত সম্ভার।
এমনই এক দৃশ্যের দেখা পাওয়া যায় হংকংয়ের পূর্বদিকের সবুজ-শ্যামল এলাকা সাই কুংয়ে। নিয়ন-হলুদ স্ট্রাইপের ভেস্ট আর রেইন-বুট পরে তারা ছুটে বেড়াচ্ছে বৃক্ষ আচ্ছাদিত একটি ঢালে। বন্ধ নেই তাদের মুখও। মনের আনন্দে গেয়ে চলেছে ইংরেজিতে শেখা প্রকৃতি-প্রেমের গান : "আই লাভ দ্য মাউন্টেইনস, আই লাভ দ্য সান সো ব্রাইট।"
এভাবে ফার আর ম্যাপল গাছের আশ্রয়ে, প্রকৃতির পরম নির্ভরতায়, শিশু ও তাদের শিক্ষকেরা এক্সপেরিমেন্ট করছেন এক নতুন ধরনের পাঠব্যবস্থার। এশিয়া মহাদেশে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকা এই স্টাইলের নাম 'ফরেস্ট স্কুল', বাংলায় যাকে বলতে পারি 'বন বিদ্যালয়'।
অবশ্য এই ধারণা কিন্তু একেবারে হাল আমলের নয়। সেই ১৯৫০-র দশকেই ইউরোপের দেশ ডেনমার্কে প্রথম শুরু হয় ফরেস্ট এডুকেশনের পথচলা। সেখানে শিশুদেরকে আউটডোরে, মূলত কোনো একটি বনভূমিতে নিয়ে গিয়ে পাঠদান করা হতো। সেই পাঠদানের পদ্ধতিও ছিল কিছুটা ভিন্ন। খেলাধুলা আর শরীরচর্চার মাধ্যমে। তারপর ধীরে ধীরে এই পদ্ধতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে ইউরোপে, তারপর ইউরোপের সীমানা পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে, এবং এশিয়া মহাদেশেও।
বলা যেতে পারে, বর্তমানে এশিয়া মহাদেশেই এই পদ্ধতির রয়েছে সবচেয়ে বেশি সমাদর। এখানে বন বিদ্যালয়ে পাঠদানকে মনে করা হয় প্রকৃতির সঙ্গে শিশুদের সংযোগ স্থাপনের, এবং তাদের মানসিক বিকাশের অনেক বেশি স্বাধীন একটি পদ্ধতি, যেখানে শিশুরা নিজে থেকেই নিতে পারে নেতৃত্ব ও চালকের আসন।
"এটি আমার ছেলেকে বাইরের জগৎ সম্পর্কে আরো বেশি জানতে এবং সবসময় কৌতূহলী হয়ে থাকতে সাহায্য করবে," মিস ট্যাং নামের এক মা জানান। তার চার বছরের ছেলেটি তখন 'সায়েন্স ওয়ার্কশপ'-এর অংশ হিসেবে গাছের নিচে কাদার সঙ্গে পানি মেশাচ্ছে।
সপ্তাহে দুইদিন ক্লাস বা সেশন চলে এই বন বিদ্যালয়ের। ২০১৭ সালে এর কার্যক্রম শুরু করে মালভার্ন কলেজ প্রি-স্কুল, যা কিনা যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি স্কুলের হংকং শাখা।
তবে এশিয়ায় বন বিদ্যালয়ের পাঠদানকে যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হচ্ছে, ডেনমার্কে শুরুর দিকে কিন্তু একই ধরনের উদ্দেশ্য নিয়ে এর প্রবর্তন হয়নি। বরং সেটি ছিল অন্য এক ঘটনার ফলাফল।
১৯৫০ ও '৬০-এর দশকে ডেনমার্কের নারীরা দলবেঁধে যোগ দিতে থাকেন কর্মক্ষেত্রে। কিন্তু কাজে তো আর বাচ্চা সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবেন না তারা। তাই দিকে দিকে খোঁজ পড়ে যায়, কই তারা রেখে যাবেন তাদের সন্তানদের। কিন্তু ডেনমার্কে তখন যথেষ্ট পরিমাণে চাইল্ডকেয়ার ফ্যাসিলিটি ছিল না। তাই তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষকদের হাত ধরে আগমন ঘটে এক বিকল্প ব্যবস্থার। তারা তিন থেকে চার বছর বয়সী শিশুদেরকে ঘরের বাইরে, জঙ্গলে বসে পাঠদান করতে থাকেন।
অল্প সময়ের মধ্যেই এ ধরনের আউটডোর ক্লাস ডেনমার্কের সাংস্কৃতিক প্রথার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়। আর সেখান থেকে এটি যুক্তরাজ্যে বিস্তৃত হয় ১৯৯০-র দশকে, এবং চলতি শতকের শূন্য দশকে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়।
কনসেপ্টটি এশিয়া মহাদেশে পা রাখার পর স্বভাবতই ভিন্নধর্মী পরিবেশ, সংস্কৃতি ও শিক্ষা প্রেক্ষাপটে এর কিছু অভিযোজনের প্রয়োজন হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটি ঠিকই নিজের প্রকৃত নির্যাসটাকে অক্ষুণ্ণ রেখে ছড়িয়ে পড়েছে হংকং, সিঙ্গাপুর, জাপান ও কোরিয়ার মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ নানা জায়গায়।
"খেলতে খেলতেই সবচেয়ে ভালো শেখে শিশুরা," জানান ক্লেয়ার জোনস। তিনি মালভার্ন কলেজের বন বিদ্যালয়ের শিক্ষক, যদিও এসেছেন মূলত যুক্তরাজ্য থেকে।
জোনস বন বিদ্যালয়ের মূল মডেলের সঙ্গে স্থানীয় নানা উপাদানের মেলবন্ধন ঘটান। যেমন হংকংয়ে বন বিদ্যালয়কে কার্যকর করে তুলতে সেখানে তিনি মিশিয়েছেন হংকংয়ের বহুভাষী প্রভাব এবং প্রাকৃতিক পরিবেশকে।
বন বিদ্যালয়ের সেশনগুলোতে শিশুরা পায় স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের সুযোগ। তারা হয়তো জঙ্গলে বসে আছে, আর তাদের চারপাশ দিয়ে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে নানা প্রজাতির পশু-পাখি। তখন তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, কোনটার কী নাম। কোনো শিশু জবাব দেয় ইংরেজিতে, কেউ বা আবার মান্দারিনে। এভাবে সেশনে উপস্থিত সব শিশুরই জানা হয়ে যায়, কোন ভাষায় কোন পশু-পাখির কী নাম।
হংকংয়ের এই বন বিদ্যালয়ে জঙ্গলের পাশাপাশি সমুদ্রসৈকতেও সেশন চলে। একবার তেমন একটি সৈকতে আয়োজন করা হয় স্ক্যাভেঞ্জার হান্টের। বিভিন্ন ঝুকিপূর্ণ এলাকায় লাল পতাকা ওড়ানোর মাধ্যমে শিশুদেরকে বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত করা হয় যে কীভাবে প্রতিকূল পরিবেশে বিপদ এড়িয়েও লক্ষ্যে অভীষ্ট থাকা যায়।
দুঃখজনক ব্যাপার হলো, বন বিদ্যালয়ের কনসেপ্টকে এখনো সাদরে গ্রহণ করেনি হংকংয়ের পাবলিক স্কুলগুলো। তবে তারপরও, স্থানীয় অভিভাবকের দিনদিন এ ধরনের শিক্ষা পদ্ধতির দিকেই বেশি আকৃষ্ট ও উৎসাহী হয়ে উঠছেন বলে জানান মালভার্ন কলেজ প্রি-স্কুলের প্রিন্সিপাল জ্যাকুলিন ম্যাকনাল্টি।
"বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানকে চার দেয়ালের বাইরে নিয়ে আসতে চায়," তিনি বলেন। সঙ্গে আরো যোগ করেন যে, আউটডোরে প্রকৃতি ও পরিবেশও অতিরিক্ত শিক্ষকের ভূমিকা পালন করে।
ম্যাকনাল্টির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত পর্যবেক্ষণ, বন বিদ্যালয় শিশুদের শারীরিক ফিটনেস থেকে শুরু করে সার্বিক ভালো থাকাকে ত্বরান্বিত করে। "এর মাধ্যমে শিশুদের মনে আত্মবিশ্বাসও সঞ্চারিত হয়। তারা সমস্যা সমাধানের দক্ষতা অর্জন করে। যেমন একবার সৈকতে ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকতে দেখে তারা নিজেরাই চেয়েছিল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে।"
বিভিন্ন গবেষণার ফলাফলেও সমর্থন মিলেছে এসব দাবির। যেমন একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, ঘরের বাইরে কাটানো সময় প্রি-স্কুল শিশুদের কোনো কাজে মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। এদিকে উন্মুক্ত পরিবেশে খেলাধুলা তাদেরকে উৎসাহী করে শারীরিক কাজকর্ম ও কল্পনানির্ভর নানা খেলা উদ্ভাবনে।
আরেকটি গবেষণায় বলা হয়, খেলার মাঠের সঙ্গে যদি বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদানও যুক্ত হয়, যেমন ঘাস, গাছ, গাছের গুঁড়ি ও শিকড়-বাকড়, তাতে করে কী ধরনের খেলা খেলা যায় তা নিয়ে শিশুদের মন আরো বেশি কল্পনাপ্রবণ হয়ে ওঠে এবং নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিবাদের মাত্রা কমায়।
গ্রিসের ইউনিভার্সিটি অব আয়োনিয়ার আরেকটি সাম্প্রতিক গবেষণা মটে, গাছ বেয়ে ওঠানামা শিশুদের শারীরিক শক্তিমত্তা ও সামঞ্জস্য বাড়িয়ে তোলে।
কিন্তু বন বিদ্যালয়ের সমালোচকও কম নয়। তেমনই একজন মনে করেন, বিশ্বব্যাপী যে হারে এ ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম বাড়ছে, তা অদূর ভবিষ্যতে সমস্যা বয়ে আনতে পারে। কেননা তিনি মনে করেন, চারিদিকে এত এত বন বিদ্যালয় গড়ে ওঠার ফলে এটি তার প্রকৃত দর্শন থেকে পথ হারাবে। প্রকৃতির সঙ্গে শিশুদের সংযোগ স্থাপনই যে প্রধানতম বিষয়, তা ভুলে যাবে লোকে। তাই তিনি মনে করেন, ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় বন বিভাগ চালুর ক্ষেত্রে প্রতিটি অঞ্চলের সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতার কথা মাথায় রাখতে হবে, এবং সে অনুযায়ীই পরিকল্পনা সাজাতে হবে।
সিঙ্গাপুরের একটি বন বিদ্যালয়ের শিক্ষক ড্যারেন কোয়েকের মতে, একদম শুরুর দিককার একটি চ্যালেঞ্জ ছিল সিঙ্গাপুরিয়ান অভিভাবকদেরকে এ ধরনের শিক্ষা পদ্ধতির ব্যাপারে বোঝানো। কেননা তারা চার দেয়ালে বন্দি নির্দিষ্ট গঠনতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার উপরই বেশি আস্থাশীল।
"সাংস্কৃতিকভাবেই, অ্যাকাডেমিক ব্যাপারে আমাদের ফোকাস অনেক বেশি। তাই আমরা যখন যাত্রা শুরু করলাম, অনেককে অনেক কিছু ব্যাখ্যা করতে হয়েছে। তাদেরকে এটা বোঝাতে গিয়ে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে যে কোনো স্পষ্ট রুটিন ও সিলেবাস ছাড়াই কীভাবে শিক্ষা ব্যবস্থাকে চালিয়ে নেওয়া যাবে," কোয়েক জানান।
২০১৬ সালে কোয়েক ফরেস্ট স্কুল সিঙ্গাপুর প্রতিষ্ঠা করেন। তার এই স্কুল কার্যক্রম পরিচালনা করে লাশ রেইনফরেস্ট আচ্ছাদিত গ্রামের পার্কগুলোতে। সেখানে শিশুরা স্থানীয় গাছগাছালি ও পশুপাখিদের ভিড়ে খেলাধুলা করে, নতুন নতুন জিনিস শেখে।
অ্যাকাডেমিক দিক দিয়ে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে সফল দেশগুলোর একটি সিঙ্গাপুর। নিয়মিতই তারা গ্লোবাল এডুকেশনাল পারফরম্যান্স র্যাংকিংয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে। কিন্তু কোয়েকের বিশ্বাস, বন বিদ্যালয়ের শিক্ষা প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো বেশি সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে। যেমন ধরুন, প্রকৃতির সঙ্গে বাচ্চাদের মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ করে দেওয়ার মাধ্যমে। কিন্তু সিঙ্গাপুরের মতো গরম ও আর্দ্র অঞ্চলে তা একেবারে সহজ ব্যাপারও নয়।
"নাতিশীতোষ্ণ দেশগুলোর মানুষ দুপুরবেলা ঘরের বাইরে গিয়ে দলবেঁধে আফটারনুন ন্যাপ নিতে পারে। কিন্তু আমরা যদি সিঙ্গাপুরে তা করতে যাই, তাহলে কেবল মশাদের মহাভোজেরই ব্যবস্থা করব, এবং নিজেদেরকে গরমে সিদ্ধ করে ফেলব। এই রকম গরম আবহাওয়ায় সিঙ্গাপুরের পশুরাও দুপুরবেলা ছায়ায় বিশ্রাম নেয়," কোয়েক বলেন।
তাই কোয়েকের বন বিদ্যালয়ের সেশনগুলো পরিচালনা করতে হয় ভোরবেলা, যখন সূর্য সবে উঠছে; অথবা বিকেলের শেষভাগে, যখন সূর্য অস্তাচলে।
"যখন খুব বেশি গরম পড়ে, তখন শিশুরা গাছের নিচে ও জঙ্গলের ছায়ায় আশ্রয় নেয়। গরমের সময়ে তারা জঙ্গলের ভেজা অঞ্চলগুলোতে ঢুকতেই বেশি পছন্দ করে। আমাদের এই গরম আবহাওয়ায় দৌড়াদৌড়ি বা নড়াচড়ার চেয়ে এক জায়গায় স্থির থেকে প্রকৃতিকে উপভোগ করার প্রবণতাই বেশি।"
বন বিদ্যালয়ের কনসেপ্ট হংকং ও সিঙ্গাপুরে তুলনামূলক নতুন একটি ট্রেন্ড হলেও, এশিয়ার অন্য কিছু অংশে এটি আরো অনেক প্রাচীন। লৌকিক ঐতিহ্যের অংশও বলা চলে।
ছয় থেকে ১২ বছর বয়সীদের জন্য জাপানে ফরেস্ট এডুকেশন বাধ্যতামূলক এক শতকেরও বেশি সময় ধরে। বনে গিয়ে শিক্ষার্থীরা কাঠের বিভিন্ন শিল্প সম্পর্কে হাতে-কলমে শেখে, গাছপালা পরিমাপ থেকে শুরু করে উদ্ভিদবিদ্যার উচ্চতর জ্ঞানলাভ করে, এবং নিজেরাও অংশ নেয় জঙ্গলে গিয়ে বৃক্ষরোপণে। ইনডোর ক্লাসে তারা যেসব বিষয়ের তত্ত্বীয় অংশ শেখে, প্রকৃতি ও পরিবেশের সান্নিধ্যে এসে তারা সেগুলোরই ব্যবহারিক রূপের সঙ্গে পরিচিত হয়।
তাছাড়া জাপানে শিক্ষার্থীদের বনে গিয়ে জ্ঞানার্জনের সঙ্গে গভীর সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় তাৎপর্যেরও যোগসূত্র রয়েছে। কেননা যুগ যুগ ধরে দেশটির মঠ, মন্দির ও উপাসনালয়গুলোকে জঙ্গলের মাঝেই নির্মাণ করা হতো।
১৯৯০-র দশকে দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষাবিদরা জাপানের বন শিক্ষা কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন, এবং এ প্রথাকে নিজেদের দেশেও আমদানির সিদ্ধান্ত নেন। বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ায় ৭০০-র বেশি 'বিদ্যালয় বন' রয়েছে, অর্থাৎ স্কুলের পাশে বা কাছেই কৃত্রিমভাবে বনাঞ্চল গড়ে তোলা হয়েছে, যেন শিক্ষার্থীরা সেগুলোকে আউটডোর ক্লাসরুম হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
স্কুলের নিকটবর্তী এসব বনাঞ্চল ছাড়াও, ২০০৮ সালে কোরিয়ার ফরেস্ট সার্ভিস প্রথম বন বিদ্যালয় স্থাপন করে। সেই থেকে কনসেপ্টটি তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে দেশটিতে। ২০১৭ সালে কোরিয়ান সরকার ঘোষণা দেয়, ইউরোপিয়ান বন বিদ্যালয়গুলোর আদলে তারা দেশজুড়ে ৪০০-র বেশি আউটডোর স্পেসের ব্যবস্থা করবে ফরেস্ট কিন্ডারগার্টেনের জন্য। আশা করা যাচ্ছে, ২০২৩ নাগাদ সেগুলো আলোর মুখ দেখবে, এবং কোরিয়ার বর্তমান বন-কেন্দ্রিক মডেল থেকে বেরিয়ে এসে আরো বেশি প্রকৃতি-কেন্দ্রিক হয়ে উঠবে।
চীন অবশ্য বন বিদ্যালয়ের কনসেপ্টে এখনো অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। সে দেশের ফরেস্ট স্কুল টিচার ইনস্টিটিউট অ্যান্ড নেচার কিন পকেট ফরেস্ট স্কুলসের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি জন লোমিনো জানান, ২০১৭ সালে তার দুই মাসের কনসালটেন্সি প্রোগ্রামের পর থেকেই চীনা অভিভাবকদের মাঝে বন বিদ্যালয় নিয়ে উন্মাদনা ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করেছে।
"একটি প্রাইভেট স্কুল আমার পরামর্শ নিয়েছিল। এখন তারা একজন কৃষকের কাছ থেকে ৩০০ একরের বনভূমি ভাড়া নিয়েছে, এবং শিশুদেরকে সপ্তাহে অন্তত দুইবার সেখানে নিয়ে যায়। তাদের লক্ষ্য হলো প্রকৃতির ব্যাপারে শিক্ষার্থীরা যেন অনেক ধরনের অভিজ্ঞতা লাভ করে," লোমিনো বলেন।
"এই স্কুলের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করে আমি নিশ্চিত হয়েছি যে অনেক চীনা পরিবারই তাদের সন্তানদের জন্য এমন কোনো সুযোগের সন্ধানে রয়েছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হলো অ্যাকাডেমিক শিক্ষার উপর ক্রমবর্ধমান ফোকাস, যার কারণে সামগ্রিক শিক্ষার বিষয়টি ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। অথচ আউটডোরে, প্রকৃতি-নির্ভর শিক্ষার মাধ্যমেই শিক্ষার্থীরা সামগ্রিক জ্ঞান লাভ করতে পারবে।"
সিঙ্গাপুরের মতো, হংকংও বৈশ্বিক শিক্ষা মানের মাপকাঠিতে একদম সামনের সারিতে থাকে। অধিকাংশ বাবা-মা চায় তাদের সন্তান যেন প্রথাগত শিক্ষার মাধ্যমে জীবনে সফলতার চূড়ায় আরোহণ করতে পারে। তাই প্রথাগত শিক্ষার উপরই তারা বেশি গুরুত্বারোপ করে। আবার যেসব বাবা-মা বন বিদ্যালয়ে আস্থা রাখছেন, তারাও অনেক সময় চেষ্টা করে তাদের সন্তান যেন এ ধরনের শিক্ষায়ও ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়। কিন্তু তাদের এ ধরনের সৎ উদ্দেশ্যের ফলে বন শিক্ষার সম্ভাবনা অঙ্কুরে বিনষ্ট হতে পারে বলে আশঙ্কা অনেক শিক্ষাবিদের।
উদাহরণস্বরূপ, সাই কুংয়ের একটি সেশনে দেখা যায়, বাচ্চাদের সঙ্গে আসা বাবা-মায়েরা চেষ্টা করছে তাদের সন্তানকে সাহায্য করার। তারা সন্তানের হাত ধরে টাস্ক সম্পন্ন করিয়ে দিতে চাইছে, পশু-পাখির সন্ধান করছে, এমনকি শিক্ষকের প্রশ্নের জবাবও পেছন থেকে চিৎকার করে বলে দিচ্ছে।
"তাই এখন আসলে বাবা-মায়েদের শিক্ষা দেওয়াও জরুরি," জোনস বলেন। তাদের প্রিন্সিপালও বারবারই বলেন যেন শিশুরা নিজেদের সমস্যার সমাধান নিজেরাই করতে শেখে, অন্য কেউ তাদের হাতে ধরিয়ে সব সমাধান করে না দেয়।
শিশুরা যদি এভাবে নিজেদের সমস্যার সমাধান নিজেরাই করতে শেখে, তাহলেই জীবনের এক পর্যায়ে গিয়ে সুফল মিলবে বন শিক্ষা কার্যক্রমের। বন বিদ্যালয়ের পক্ষপাতী অনেকে যেমন বলেন, এ ধরনের শিক্ষার মাধ্যমে গভীর, দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল পাওয়া যাবে, এবং এর বদৌলতে শিশুরা বর্তমান সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সমস্যা, যেমন জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশের ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কেও আরো একান্তভাবে জানতে ও বুঝতে পারবে।
"জলবায়ু পরিবর্তন বা এ ধরনের সমস্যার ব্যাপারে যথেষ্ট বিজ্ঞান ও অ্যাকাডেমিক শিক্ষাই রয়েছে। কিন্তু প্রকৃতি ও পৃথিবীর সঙ্গে ঐকান্তিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে, তেমন অভিজ্ঞতানির্ভর শিক্ষা শিশুরা খুব কমই পায়," বলেন সিঙ্গাপুরের শিক্ষক কোয়েক। "কিন্তু যে শিশুরা জঙ্গলে লম্বা সময় কাটাতে পারবে, মাটির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলবে, ভবিষ্যতে তারাই এগিয়ে আসবে এগুলোর সংরক্ষণে।"
পরিবেশ-সচেতন স্কুলগুলোর পদাঙ্ক অনুসরণ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শিক্ষা কারিকুলামে সত্যি সত্যিই জলবায়ু পরিবর্তন সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন শিক্ষাবিদরা।
তাছাড়া কোভিড-১৯ মহামারির কারণে লকডাউন ও দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকার ফলে বিশ্বব্যাপী আলোচনা শুরু হয়েছে শিশুদের শরীরচর্চা ও বাইরে গিয়ে খেলার প্রয়োজনীয়তা নিয়েও।
হংকংয়ে যখন করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হয়, জোনস তখন ভিডিও ক্লাসের উপর নির্ভর করতে শুরু করেন। কিন্তু সেখানেও তিনি বন বিদ্যালয়ের আবহ ধরে রাখার চেষ্টা করেন। যেমন তিনি নিজের ছাদের বাগানে আগুন জ্বালিয়ে শিক্ষার্থীদের বলেন, তারাও যেন অন্য কোনো এক্সপেরিমেন্টের সাজেশন দেয়।
তবুও, পুনরায় আউটডোরে ক্লাস শুরু হওয়ার পর জোনস খেয়াল করেন যে মাঝের সময়টুকু শিক্ষার্থীদের মনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে।
"তারা [শিশুরা] অনেক বেশি সময় ঘরের মধ্যে কাটিয়েছে। তাই আবার ক্লাস শুরু হওয়ার পর তাদের মধ্যে নানা ধরনের পরিবর্তন এসেছে। কেউ কেউ তো বালু স্পর্শের অনুভূতিকেও ঘৃণা করেছে, কারণ এর সঙ্গে তারা অভ্যস্ত নয়। আমি মাঝে মাঝে এটি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছি। প্রকৃতির সঙ্গে তাদের যে যোগাযোগ তৈরির চেষ্টা আমি করছিলাম, তা প্রায়ই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছিল," জোনস বলেন।
জোনসের সঙ্গে যখন এই প্রতিবেদকের কথা হচ্ছিল, তখন তার শিক্ষার্থীরা মেতে ছিল সৈকতে বসে নিজ নিজ বালতিতে সমুদ্রের পানি অথবা বালু ভর্তি করতে। জোনস যখন দেখতে পেলেন সবার কাজ সম্পন্ন, তিনি হুইসেল বাজালেন। সেই শব্দ পেয়ে সবাই এগিয়ে এল তার কাছে। জোনস শিশুদের কাছে জানতে চাইলেন, এরপর তারা কী করতে আগ্রহী। শিশুরা সমস্বরে জানাল, তারা ফুলগাছ লাগাতে চায়। সেটিই ঠিক হলো, কেননা প্রতিবার শিশুরাই সিদ্ধান্ত নেয় তারা কী শিখতে আগ্রহী।
"পুঁথিগত বিদ্যা তো অবশ্যই জরুরি। কিন্তু তার পাশাপাশি এসব দক্ষতা ও জ্ঞানও শিশুদের প্রয়োজন," খোলা হাওয়ায় ক্লাস নিতে নিতে জোনস বলেন। "এগুলো হলো আজীবনের দক্ষতা।"
- সূত্র: বিবিসি ফিউচার