ডিএসই: হারানো বন্ধুকে খুঁজে পাওয়া যায় ফেসবুকের যে গ্রুপে
এক হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর সাথে সকাল-বিকেল বেলা
কত পুরনো-নতুন পরিচিত গান গাইতাম খুলে গলা
কত এলোমেলো পথ হেঁটেছি দুজন হাত ছিল না তো হাতে
ছিল যে যার জীবনে দুটো মন ছিল জড়াজড়ি একসাথে।
কত ঝগড়া-বিবাদ, সুখের স্মৃতিতে ভরে আছে শৈশব
তোকে স্মৃতিতে স্মৃতিতে এখনও তো ভালোবাসছি অসম্ভব!
শিল্পী সায়ানের মতো হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর স্মৃতি আমাদের সবার মনেই হয়তো কড়া নাড়ে সময়ে অসময়ে। শৈশব, কৈশোরের হোক বা প্রাপ্ত বয়সেরই হোক, একদিন হৃদয়ের কাছে জায়গা পেয়েছিল যে বন্ধু তাকে হারিয়ে ফেলার শোক মনের কোণে বাজে সারাজীবন ধরেই।
ঘরে ঘরে ইন্টারনেটের এই যুগে হারানো বন্ধুর খোঁজ পাওয়া অবশ্য আগের চেয়ে বেশ খানিকটা সহজ হয়ে এসেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে যেমন পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে মুহূর্তেই সংযোগ স্থাপন করা যায় তেমনি দূর দূরান্তের যে কাউকেই খুঁজে বের করার উপায়ও পাওয়া যায়। ফেসবুকে লাখখানেক সদস্যের 'ডু সামথিং এক্সেপশনাল (ডিএসই)' গ্রুপে রয়েছে "হারানো বন্ধুর খোঁজে" নামের এক বিশেষ আয়োজন।
২০ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া কলম-বন্ধুর খোঁজ
কিছুদিন আগেই হারানো বন্ধুর খোঁজে শ্রীমঙ্গলের স্কুল শিক্ষক জহিরুল মিঠু পোস্ট করেছিলেন ফেসবুক গ্রুপ ডিএসই-তে।
হারিয়ে যাওয়া 'কলম-বন্ধু' বন্ধু মো সালাহউদ্দিন সাহেদের প্রাক্তন ঠিকানার ছবির সাথে ক্যাপশনে লিখেছিলেন, "আমি শ্রীমঙ্গলের মিঠু, ২০০১/২০০২ সালে চট্টগ্রামের পানওয়ালা পাড়ার 'সাহেদ' বুয়েটে পড়তো। থাকতো তিতুমীর হলে। সে আমার চিঠি-বন্ধু ছিল। তাকে খুঁজছি।"
পোস্ট করার কয়েকঘন্টা পরই গ্রুপের একজন সদস্য সাহেদের ফেসবুক আইডির লিংক দিয়ে সাহায্য করেন। মিঠু খুঁজে পান তার বন্ধুকে।
এতদিনের হারানো বন্ধুর খোঁজ ফেসবুক গ্রুপ থেকে এত সহজেই পেয়ে যাবেন তা আগে ভাবতে পারেননি জহিরুল মিঠু। পত্রমিতালীতে সাহেদের সাথে তার পরিচয় কলেজ জীবনে। বুয়েটের হলে সাহেদ আর শ্রীমঙ্গলে মিঠু দুজনে চিঠিতে কথা বলতেন তাদের প্রিয় বই, সিনেমা, গান আর যুগ্ম পছন্দের বিষয়গুলো নিয়ে। দেড় বছরের বন্ধুত্বে তাদের কখনো সরাসরি দেখা না হলেও কথা হতো নিয়মিতই। ধীরেধীরে কর্মজীবনের ব্যস্ততা বাড়তে থাকলে যোগাযোগে ভাটা পড়ে। এরপর হুট করেই ঠিকানা হারিয়ে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় যোগাযোগ। তবে এতবছর বিচ্ছিন্ন থেকেও মন থেকে মুছে যায়নি বন্ধুর স্মৃতি। তাই ফেসবুকে নিজের টাইমলাইনে পোস্ট করে সাহায্য চেয়েছিলেন বন্ধুকে খুঁজতে। সেখানে একজনের কমেন্ট থেকেই সন্ধান পেয়েছিলেন ডিএসই গ্রুপের।
২০ বছর পর ডিএসই গ্রুপের সাহায্যে হারানো বন্ধুকে খুঁজে পেয়ে আপ্লুত মিঠু গ্রুপে তার পোস্ট আপডেট করে জানান, "আমি আজ দুপুরে বন্ধু 'সাহেদ'কে খুঁজে পেয়েছি। কথাও হল অনেকক্ষণ! ২০ বছর সময় দীর্ঘ একবারও মনে হয়নি! মনে হয় সে আছে আগের মতই। বন্ধুরা পাল্টায় না।"
সাহেদকে খুঁজে পাওয়ার পর আরো অনুপ্রাণিত হয়ে স্কুল জীবনের আরেক বন্ধুর খোঁজ করছেন মিঠু ডিএসই গ্রুপে। এবার তার অনুসন্ধান চলছে শ্রীমঙ্গলের বাডস্ স্কুলের বন্ধু আবু হেনা মোস্তফা কামাল (মিঠু)-র জন্য।
পাকিস্তানে ফেলে আসা বন্ধুকে মেয়ের পোস্টের মাধ্যমে খুঁজে পেলেন নুরুল হক
আশির দশকে নুরুল হক থাকতেন পাকিস্তানের লাহোরে। সেখানে গার্মেন্টস সেক্টরে কাজ করার সুবাদে বন্ধুত্ব হয় গুড্ডুর সাথে। গুড্ডুর মায়ের চেহারার সাথে নুরুল হকের দেশে রেখে আসা মায়ের চেহারার ছিল অদ্ভুত মিল। একই এলাকায় থাকায় বন্ধুত্ব থেকে পারিবারিক ঘনিষ্ঠতাও হয়। দশ বছরের বেশী সময় পাকিস্তানে থাকার পর নব্বইয়ের দশকে দেশে ফিরে আসেন নুরুল হক। চিঠির মাধ্যমে বছরখানেক যোগাযোগের পর একসময় দূরত্ব সৃষ্টি হয় দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততায়। নুরুলের জীবন থেকে হারিয়ে যান গুড্ডু।
যোগাযোগ না থাকলেও সবসময় পাকিস্তানে রেখে আসা বন্ধু গুড্ডু আর তার পরিবারের গল্প শুনাতেন ছেলেমেয়েদেরকে। গতবছর লকডাউনের সময় নুরুল হকের মেয়ে সুমাইয়া হক বাবার বন্ধুকে খুঁজে বের করার পরিকল্পনা করেন।
বছর খানেক ধরেই ডিএসই গ্রুপে সদস্য হিসেবে যুক্ত ছিলেন সুমাইয়া হক। নানা সময়ে নানা পোস্ট থেকে টুকটাক তথ্য পেয়ে উপকৃত হয়েছিলেন তিনি। ডিএসই-তে অনেকের পোস্টের মাধ্যমে হারানো বন্ধুকে খুঁজে পেতেও দেখেছেন। সেই থেকে সাহস পেয়ে ভাবলেন বাবার বন্ধুকে খোঁজার চেষ্টা করে দেখবেন গ্রুপে পোস্ট করে।
"বাবার বন্ধুত্বের গল্প লিখে সাথে বন্ধুর প্রাক্তন ঠিকানা, বন্ধু ও তার পরিবারের ছবিসহ পোস্ট করেছিলাম গ্রুপে। শুরুতে খুব বেশী প্রত্যাশা ছিল না। তবে পোস্ট করার পর অনেকেই সেখানে কমেন্ট করে সাহায্য করতে চেয়েছেন। এরমধ্যে সালমান হোসেন নামের এক ভাইয়া আমাকে অনেক বেশী সাহায্য করেন। আমার সাথে কথা বলে তার এক পুলিশ বন্ধুর মাধ্যমে খোঁজ নেওয়ান পাকিস্তানের লাহোরে," বলেন সুমাইয়া।
কিছুদিনের ভেতর সালমানের মাধ্যমেই লাহোর থেকে সুমাইয়া তার বাবার বন্ধু গুড্ডুর খোঁজ পান। প্রায় ২৫ বছর পর ভিডিও কলে যেদিন দুই বন্ধুর কথা হয় সেদিন বাংলাদেশের নুরুল হক আর পাকিস্তানের গুড্ডু উভয়ের ঘরেই লেগেছিল উৎসবের আমেজ।
সুমাইয়া বলেন, "বাসার প্রতিটা লোক যেন আনন্দে ফেটে পড়ছিলাম! আর বাবার কথা কী বলবো! এত বেশি খুশি আমি তাকে খুব কম সময় দেখেছি। আসলে আমি সত্যি ভাবতে পারিনি এইভাবে ফেসবুক থেকে ২৫ বছর আগের কোন বন্ধুকে খুঁজে বের করা সম্ভব হবে।"
ডিএসই গ্রুপের প্রতি সুমাইয়া হক ও তার পরিবার কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা জানায়।
হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে ফেসবুকে খুঁজে পেলেন পুলিশের এসআই
খুলনার শাহনেওয়াজ বাপ্পীর বন্ধুদের গ্রুপের একজন ছিল মো জুয়েল খান। রঙিন কলেজ জীবনের সাথীদের সাথে দুরন্ত দিনের স্মৃতি জ্বলজ্বলে হয়ে আছে বাপ্পীর জীবনে। শিক্ষাজীবন শেষে সবাই দূরে চলে গেলেও আবার নানা মাধ্যমে যোগাযোগ হয় অনেকের সাথেই। কিন্তু ১৬ বছরেও খুঁজে পাননি বন্ধু জুয়েলকে।
ডিএসই গ্রুপে একজনের বন্ধু খুঁজে পাওয়ার পোস্ট দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের বন্ধুকে নিয়ে পোস্ট করেন বাপ্পী। সেই পোস্টে কয়েক ঘন্টার ভেতরই একজন সদস্য সৌদিআরব প্রবাসী জুয়েলের খোঁজ জানায়।
দীর্ঘ ১৬ বছর পর বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করে উচ্ছ্বসিত বাপ্পী বন্ধুর সাথে ভিডিও কলের স্ক্রিনশটসহ গ্রুপের সদস্যদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে পোস্ট করেন, '১৬ বছর পর .......... এই অনুভূতি বলে কিংবা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। ধন্যবাদ, ডিএসই। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা সবার প্রতি, যাদের আন্তরিকতায় আমাদের এই বন্ধুত্বের পুনর্জন্ম হলো।"
বাপ্পী বলেন, "সোশ্যাল মিডিয়া অনেক পাওয়ারফুল৷ আমরা একে ভালো কাজে ইউজ করে অনেককিছু করা সম্ভব।"
ডু সামথিং এক্সেপশনাল
নতুন কিছু করার প্রত্যয়ে পরিচালিত হয় স্বেচ্ছাসেবামূলক গ্রুপ 'ডু সামথিং এক্সেপশনাল (ডিএসই)'। বর্তমানে এক লাখ ১৮ হাজারের উপর সদস্য নিয়ে পরিচালিত পাবলিক গ্রুপটি মূলত একই নামের চার লাখ সদস্যের এক ক্লোজড গ্রুপের সাব-গ্রুপ হিসেবে খোলা হয়েছিল। মূল গ্রুপটি ২০১৪ সালের মার্চ মাসে আশফাকুল ইসলাম নামের এক তরুণ খুলেছিলেন 'ডেসপারেটলি সিকিং এক্সপ্লিশিট' নামে। নাম পরিবর্তন হয়ে সময়ের সাথে সাথে অনলাইন ও অফলাইনে নানা সেবামূলক কাজের সাথে যুক্ত হয় ডিএসই। গ্রুপের সদস্যরা রাস্তা চেনা থেকে শুরু করে ওষুধ খোঁজা, শারিরীক-মানসিক যেকোনো ধরনের সমস্যা জানিয়ে অনলাইনে পোস্ট করে আভিজ্ঞ ব্যক্তির সহায়তা নিতে পারেন ডিএসই-তে।
মেডিহেল্প, ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প, রক্তের শক্তি, ম্যাচমেকিং, হোক প্রতিরোধ, বর্ণ নিয়ে ইত্যাদি নানা শিরোনামে সাহায্য কার্যক্রম চলে গ্রুপে।
'হারানো বন্ধুর খোঁজে' বিভাগ নিয়ে গ্রুপের এডমিন জেবিন ইসলাম জানান, ২০১৭ সালে এক সদস্য তার বাবার ৩০ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে খুঁজতে পোস্ট করেছিলেন গ্রুপে। সেই পোস্টের মাধ্যমে পুরোনো বন্ধুকে খুঁজে পাওয়ার পর এডমিনরা এই আইডিয়াকে আরো প্রচার করে 'হারানো বন্ধুর খোঁজে' নামে আলাদা বিভাগের কাজ শুরু করেন। তখন প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে এডমিনদের পোস্টের কমেন্টের মাধ্যমে হারানো বন্ধুকে খোঁজার আহ্বান জানাতেন তারা। সদস্যরা নিজেরাও পোস্ট করে বন্ধুদের খুঁজে পাওয়ার সাহায্য চাইতেন। এভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে 'হারানো বন্ধুর খোঁজে' কার্যক্রম। এখন প্রায়ই গ্রুপে পোস্ট দিয়ে হারানো বন্ধুকে ফিরে পান অনেকেই।
২০১৪ সালে খোলা ক্লোজড ডিএসই গ্রুপটি ২০২১ সালে আগস্ট মাসে এক সদস্যের পুরোনো পোস্টে ফেসবুকের ভায়োলেশন রিপোর্ট পড়ায় বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে সচল পাবলিক ডিএসই গ্রুপটি ২০১৮ সালে খোলা হলেও এতদিন এটি খুব একটা একটিভ ছিল না।
আগের গ্রুপটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর একই নামের এই গ্রুপে পুরোনো কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন গ্রুপের এডমিনরা। বর্তমানে গ্রুপে এডমিন হিসেবে কাজ করছেন জেবিন ইসলাম, ইমন খান, কৌশিক চৌধুরী, হাসিব ফিরোজসহ আরো কয়েকজন।
অফলাইনে ডিএসই-র করা অসংখ্য সেবামূলক কাজের মধ্যে বৃদ্ধাশ্রমে সহায়তা করা, হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সেবাযত্ন করা, সামর্থ্যহীন মানুষের বিয়ের বাজার করে দেওয়া, অসহায় ব্যক্তির বন্ধক দোকান ছাড়িয়ে নতুন করে দোকান সাজিয়ে দেওয়া, পাবলিক যানবাহনে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে স্টিকার লাগানো অন্যতম।
বর্তমানে ডিএসই কাজ করছে 'মনার জন্য' ক্যাম্পেইন নিয়ে। সবার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে- স্লোগানকে সামনে রেখে তারা সামর্থ্যহীন পরিবারে শিশু খাদ্য সরবরাহ করছে।
চার লাখ সদস্যের পুরোনো ডিএসই গ্রুপ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান জেবিন ইসলাম। তবুও নতুন গ্রুপকে আরো ভালো করে সাজিয়ে স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে সেবামূলক কাজ করে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে ডিএসই।