কলারওয়ালীর মৃত্যু আর বাঘের জন্য আমাদের ভালোবাসার গভীরতা
ভারতের বাঘের এক তৃতীয়াংশেরই বাস সেন্ট্রাল ইন্ডিয়ান ফরেস্টে। এ সংখ্যা এক হাজারের বেশি। এ কারণে বেশিরভাগ মানুষ নামই শোনেনি এমন কোনো বনে বয়সের কারণে একটি বাঘের মৃত্যু হলে সে খবর যদি আপনার নজরে না আসে, অবাক হওয়ার কিছু নেই বোধহয়।
আসলে, আমাদের মনোযোগ ধরে রাখতে পারার ক্ষমতা যেভাবে কমছে প্রতিনিয়ত, আর প্রতি মুহূর্তে রাজনীতি আর শোবিজের মুহুর্মুহু সংবাদের ভীড়ে আমরা কলারওয়ালির মৃত্যুর সংবাদ পেলেই বরং তা অবাক করা বিষয় হতো।
সে যাই হোক, কলারওয়ালী সাধারণ কোনো বাঘ ছিল না। সে ছিল বনের রানি, সুপার-মম, সেলেব্রিটি আর কনজার্ভেশন আইকন। ভারতের মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের ১০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বন পেঞ্চ টাইগার রিজার্ভে বাস ছিল তার।
সমসাময়িক সময়ের যে কোনো বাঘের চেয়ে বিস্ময়ের স্বাক্ষর রেখেছে সে । পেঞ্চের রানি তার দুই সঙ্গীর সঙ্গে জন্ম দিয়েছে ২৯টি বাঘ শাবকের, এরমধ্যে ২০টিরই বেশি বর্তমানে প্রাপ্তবয়স্ক বাঘ।
ছোট একটি হিসাব করা যাক। প্রতিটি বাঘ শাবক মোটামুটি দুই বছর পর্যন্ত মায়ের সঙ্গে থাকে। একই বয়সে অর্থাৎ দুই বছরের মধ্যে একটি বাঘিনী প্রজননক্ষম হয়। অর্থাৎ, মৃত্যুর সময় কলারওয়ালীর বয়স ছিল ১৮ বছরের মতো। পেঞ্চে বর্তমানে ৪৫টি বাঘ আছে; এই বাঘিনীই জন্ম দিয়েছে এই জনসংখ্যার অর্ধেক বাঘের।
রিজার্ভের প্রথম রেডিও-কলারড বাঘ হওয়ায় তার নাম দেওয়া হয়েছিল কলারওয়ালী। পেঞ্চ টাইগার রিজার্ভের স্টার গার্ডিয়ান ছিল কলারওয়ালী। তাই তো তার মৃত্যুতে শোকাহত বন বিভাগের কর্মকর্তা, জীববিজ্ঞানী, ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার, সিটিজেন সায়েন্টিস্ট, সাংবাদিক, শিল্পীসহ সবাই। ২০২২ সালের ১৭ জানুয়ারি মারা যায় কলারওয়ালী।
এই মৃত্যু আমাদের জন্য কী বার্তা বহন করে? বাংলাদেশের বাঘ সংরক্ষণের সঙ্গে এর সম্পর্কই বা কী? নিঃসন্দেহে দেশের সংরক্ষণ খাতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়া বন্যপ্রাণী বাঘ।
উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের বনগুলোতে বাস করা ২৮টি মাংসাশী প্রাণীর ১৪টি প্রাণী (এরমধ্যে আছে ভাল্লুক, চিতাবাঘ, মেঘলা চিতা ও ঢোল) নিয়েই কোনো গবেষণা হয়নি, আর বাকিদের ব্যাপারেও খুব কম জানি আমরা। সেদিকে বাঘের জন্য আছে দুটি ১০ বছর মেয়াদী কনজার্ভেশন অ্যাকশন প্ল্যান।
আমাদের অঙ্গীকার নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু, এরপরই আসে সেই জরুরি প্রশ্নগুলো। আমরা আমাদের বাঘদের কতোটুকু জানি?
আমাদের সুন্দরবনে কি কলারওয়ালীর মতো কোনো আইকনিক বাঘ আছে? আমাদের জীবনে বাঘ কতোটুকু জুড়ে আছে?
সহজ যুক্তি দিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায়। সুন্দরবনের বিস্তৃত অঞ্চল ভারতের সেন্টার ফরেস্টের চেয়ে আলাদা। সুন্দরবন অবশ্যই আলাদা।
বাঘকে ভালোবাসাও একটি কঠিন কাজ। দেশে এটি পেরেছে এমন মানুষের সংখ্যাও দশ পেরোয়নি। তবে, ম্যানগ্রোভের সেলিব্রিটি বাঘের প্রসঙ্গে ভারতের সুন্দরবনের দিকে তাকানো যাক।
১০ হাজার বর্গ কিলোমিটারের এ বনের ৪০ শতাংশই ভারতে। সেখানে বাঘদের রেডিও কলার পরানো হয়েছে, নামও দেওয়া হয়েছে। আমাদের সুন্দরবনে বাঘদের রেডিও কলার পরানো হয়েছিল এক দশক আগে, তা শেষও হয় এক বিতর্কের মধ্যে।
গত দুই বছরে প্রায় আধা ডজন বাঘের খবর এসেছে গণমাধ্যমে। দিনশেষে, পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে বাঘের হামলা না হওয়ায় আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি।
কিন্তু সুন্দরবনে বাঘেরা ঠিকঠাক আছে এর বৈজ্ঞানিক প্রমাণ কোথায়? আমাদের পার্বত্য অঞ্চলের বাঘদের জানার প্রচেষ্টা কেনো এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে?
বাংলাদেশে বাঘ সংরক্ষণের অবৈজ্ঞানিক দিকে তাকানো যাক। দেশের জাতীয় প্রাণীর সাথে কতোটুকু পরিচিত দেশের সাধারণ নাগরিকরা?
আমরা আমাদের ক্রিকেটারদের টাইগার ডাকি, জাতীয় দলের লোগোতেও আছে প্রাণীটি। কিন্তু, বাঘ সংরক্ষণ নিয়ে কি আমরা কোনো ক্রিকেটারকে কথা বলতে দেখেছি?
ইসলামিক রিপাবলিক হওয়া সত্ত্বেও ইরানের জাতীয় ফুটবল দলের জার্সিতে জায়গা পেয়েছে এশিয়াটিক চিতা। বিড়াল গোত্রীয় প্রাণীদের মধ্যে মহাবিপন্ন তালিকার আরেকটি প্রাণী চিতা, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শুধু ইরানেই এখনো টিকে আছে প্রাণীটি।
শেষ কবে আমাদের জাতীয় দলের জার্সিতে বাঘের মুখ দেখেছি আমরা? ক্রীড়াবিদরা প্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে কথা বলছে সবখানেই বেশ সাধারণ একটি চিত্র। কিন্তু এখনো আমাদের মধ্যে সংরক্ষণ নিয়ে ইনফ্লুয়েন্সারদের কাজে লাগানোর প্রবণতা নেই।
এর পরিবর্তে আমরা দেখেছি আমাদের এক ক্রিকেটার লাকি চার্ম হিসেবে বাঘের দাঁতের পেন্ডেন্ট পরেছে, জাতীয় দৈনিকেও তা প্রকাশিত হয়েছে। বাঘের শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে তৈরি পণ্যের বিক্রি, বাণিজ্য ও প্রসার বিশ্বজুড়ে অবৈধ।
এক সময় আমাদের ব্যাংক নোটের ওয়াটারমার্ক ছিল বাঘ। এই অবদান আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের। এই বৈজ্ঞানিক আর সৃষ্টিশীল উদ্যোগের শুরুটা করেন তিনি।
কিন্তু, বর্তমানে আমাদের কোনো নোটেই আর বাঘ দেখা যায় না, শুধু ১০০টাকার একটি স্মারক নোট বাদে।
যেসব দেশ কোনো বিপন্ন প্রাণীর আবাসস্থল, সেখানকার ব্যাংক নোটে সে প্রাণীর ছবি থাকার ইতিবাচক প্রভাব অনেক। নেপালের দিকে তাকাতে পারি আমরা, বিজ্ঞান দিয়েই প্রমাণ করেছে দেশটি।
নেপালের টেরাই আর্ক ল্যান্ডস্কেপে আছে বিরল এশিয়ান অ্যান্টেলপ বা ব্ল্যাকবাক। ঔপনিবেশিক আমলে বর্তমানে বাংলাদেশের ভূমিতেও প্রাণীটির দেখা মিলতো।
ব্ল্যাকবাকের সুরক্ষার পদক্ষেপ হিসেবে নেপালের ১০ রূপির নোটে প্রাণীটির ছবি রাখা হয়েছে। সেখানে প্রাণীটির বিলুপ্তি ঠেকাতে এটি অসাধারণ ভূমিকা রেখছে, গত বছর 'ম্যামাল রিসার্চ' জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা এ কথা বলছে।
কয়েক মাস আগে একটি ফেসবুক মিম ভাইরাল হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের বাঘের ভাস্কর্যের কিছু ছবি ছিল সেখানে। সবগুলোই বিকৃত, আর দেখতে বাঘের ধারেকাছেও না।
বাঘের ভাস্কর্য দেখে ক্যারিকেচার মনে হচ্ছিল, রাজকীয় প্রাণীটির আসল অবস্থা তুলে ধরার চেয়ে জনসাধারণের মধ্যে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়। এই মজার বাইরে তাকালে, মিমটি কিন্তু বিপজ্জনক এক সংকেত।
বলুন তো, বাংলাদেশের কোথায় বাঘের ঠিকঠাক ভাস্কর্য আছে? নিশ্চিতভাবেই আমাদের দেশে অসাধারণ ভাস্কর আছে। তাহলে, এসব ভাস্কর্য বানাতে কেন তাদের কাছে যাওয়া হয়নি?
আমাদের জাতীয় দলের প্রতীক বাঘকে যদি এমন অবহেলার সাথে উপস্থাপন করা হয়, অন্য ২৭টি মাংসাশী প্রাণীর অবস্থা কেমন? আমরা আমাদের প্রকৃতি থেকে কতোটা বিচ্ছিন্ন?
তো, আমরা আমাদের বাঘের সঙ্গে মনস্তাস্তিকভাবে কতোটা কাছাকাছি? আমরা কতোটুকু ভালোবাসি তাদের? 'ইয়ার অফ দু টাইগারে' বাঘ রক্ষায় আমরা কী সিদ্ধান্ত নিয়েছি? কলারওয়ালীর মৃত্যু আর কীভাবে ভারত এ ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছে, কীভাবে বিশ্বজুড়ে বাঘ সমাদৃত হয়, তা আমাকে ভাবিয়ে তোলে।
মূল লেখা: Collarwali's demise and the depth of our love for tigers