কর্মস্থলের পরিবেশ কতটা অসহনীয় হয়ে পড়লে চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়!
আজকের দিনে এমন চাকরি পাওয়া খুবই কঠিন, যেখানে কোম্পানি একজন কর্মীর কাজের যথাযথ তারিফ করবে, ভালো বেতন দেবে, আবার তাকে তার প্রাপ্য সম্মানও দেবে।
ইতঃপূর্বে কর্মস্থলের পরিবেশ মনঃপুত না হওয়া সত্ত্বেও দাঁতে দাঁত চেপে কাজে লেগে ছিল অনেকে। কিন্তু করোনা মহামারির সময় আমেরিকাজুড়ে অনেক কর্মীরই ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে। তারা ভেবেছে, 'অনেক হয়েছে আর না!' তাই তো দিকে দিকে চাকরি ছাড়ার একটা হিড়িক পড়ে গেছে, যাকে বলা হচ্ছে 'দ্য গ্রেট রেজিগনেশন'।
বিজনেস ইনসাইডারের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ২০২১ সালে আমেরিকায় সব মিলিয়ে ৩ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ চাকরি ছেড়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, ঠিক কী কারণে একসঙ্গে এত মানুষ চাকরিকে বিদায় বলল? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে হদিস মিলেছে অবিশ্বাস্য সব ঘটনার, যেগুলো মার্কিন কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করেছে চাকরিজীবনে পরিবর্তন আনতে। এই লেখায় তুলে ধরা হচ্ছে সেরকমই কিছু ঘটনার বয়ান।
১. "আমি চাকরি ছাড়লাম, যখন আমার সুপারিনটেন্ডেন্ট আমার অধীনস্থ সকল শিক্ষকের বিরুদ্ধে তাদের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার নম্বর নিয়ে মিথ্যাচারের অভিযোগ আনল। শিক্ষার্থীদের নাকি 'অনেক বেশি' নম্বর দেওয়া হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেই চাইছিলেন না, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পক্ষেও পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া সম্ভব।"
২. "আমার মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষ হতে আমি কাজে ফিরি। তবে দিনে দুইবার বুকের দুধ পাম্প করতাম। একবার কাজের মাঝে বিরতি নিয়ে, আরেকবার ৩০ মিনিটের লাঞ্চ ব্রেকে। কিন্তু ওই সময়গুলোতেও আমার বস বারবার আমাকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করতেন আমি ঠিকঠাক কাজ করছি কি না। তাই আমাকে ল্যাপটপ আর ফোন নিয়েই ঢুকতে হত পাম্প ক্লজেটে। এমনকি দরজার বাইরে দাঁড়িয়েও তিনি আমাকে নানা প্রশ্ন করতেন। একবার তো তিনি আমাকে এ-ও জিজ্ঞেস করে বসলেন, আমার পাম্প করতে 'অপেক্ষাকৃত বেশি সময়' লাগছে কি না। এদিকে আমার দুধের সাপ্লাই কমতে শুরু করেছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম, বাচ্চাকে না খাইয়ে রাখা কিংবা বসের সব চাহিদা মেটানোতে কোনো লাভই হবে না। তাই আমি দুই সপ্তাহ বাদেই চাকরি ছেড়ে দিই।"
৩. "আমি একজন রিটেইল ওয়ার্কার। আমার আগের স্টোরের ম্যানেজার একবার আমাকে বলেন, আমার ওজন কমানো দরকার। আমি একটা প্লাস-সাইজের মেয়ে, এবং তাকে একবার বলেছিলাম কীভাবে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে বিমানের সিটবেল্ট বাঁধা নিয়ে আমাকে ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল। তিনি তখন আমাকে বলেন, আমার উচিত ডায়েট করতে শুরু করা। তারপর একবার যখন আমি তাকে বললাম আমার দাঁত তুলে ফেলতে হয়েছে এবং নির্দিষ্ট কিছু খাবার আমি খেতে পারছি না, তিনি আমাকে বললেন, 'বেশ, এবার তুমি ডায়েট করতে পারবে।' আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না তিনি আমাকে এমন কিছু বলতে পারেন। এরপর থেকেই আমি নতুন চাকরি খোঁজা আরম্ভ করি।"
৪. "আমি একবার আমাদের কোম্পানির একজন স্টেকহোল্ডারের দ্বারা যৌন হেনস্তার শিকার হই। অথচ ঘটনাটি যেদিন ঘটে, সেদিন বিকেলে আমি যখন ছুটি নিই এবং আর কখনো ওই স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে কাজ না করার কথা জানাই, আমার বস আমাকে বলেন আমার এমন প্রতিক্রিয়ার অর্থ নাকি আমি চাকরিটাকে খুবই স্ট্রেসফুল মনে করছি এবং আমার থেরাপি নেওয়া দরকার। এর কয়েকমাস পর যখন আমি চাকরি ছেড়ে দিলাম, আমার বস আমাকে বললেন থেকে যেতে এবং তার সঙ্গে একটা অ্যাফেয়ারে জড়াতে। আমি তখন এইচআরের কাছে তার নামে অভিযোগ করি।"
৫. "আমি তিন বছর ধরে একটা কোম্পানিতে ছিলাম, এবং একা হাতেই গোটা একটা ডিপার্টমেন্ট সামলাতাম। কিন্তু আমার সৎ ছেলের অ্যাপয়েন্টমেন্ট উপলক্ষ্যে আমি যখন অগ্রিম দুই সপ্তাহের ছুটির আবেদন করলাম, আমাকে বলা হলো, 'দেখো, ও তো তোমার নিজের সন্তান না। ওর বাবার বরং উচিত ওর দেখভাল করা।' আমি তৎক্ষণাৎ বুঝে গেলাম, এই কোম্পানিতে আমার মেয়াদ ফুরিয়েছে।"
৬. "আমাকে যে চাকরি ছাড়তে হবে তা আমি বুঝে গিয়েছিলাম এক সহকর্মী আমাকে ছুরি হাতে হুমকি দেওয়ার পাশাপাশি 'নিগ্রো' বলে গালি দিলে। আমি আমার ম্যানেজারকে ব্যাপারটি জানালেও তিনি ওই সহকর্মীরই পক্ষ নেন।"
৭. "মহামারির প্রায় দুই বছর হতে চলেছে। একদিকে শিশুদেরকে অনলাইনে পাঠদান করতে হচ্ছে, অন্যদিকে স্কুলও আংশিক খোলা রাখছে হচ্ছে। স্কুলের সব স্টাফের উপর দিয়েই তাই অনেক ধকল যাচ্ছিল। কিন্তু তারপরও, প্রতি সপ্তাহেই আমাদের প্রিন্সিপাল স্টাফ ও শিক্ষার্থীদের পারফরম্যান্স আরও ভালো করার তাগাদা দিতে থাকেন। আমাদের উপর এত বেশি পেপারওয়ার্ক চাপিয়ে দেওয়া হয় যে আমরা শিশুদের পাঠদানের উপরই মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। শেষমেশ আমাদের অনেক স্টাফ স্কুল ছেড়ে চলে যায় কিংবা তাদের পাবলিক ব্রেকডাউন হয়। কিন্তু তখন স্কুল ম্যানেজমেন্ট একটি মিটিং ডেকে বলল, 'মানসিক স্বাস্থ্য কোনো অজুহাত হতে পারে না' এবং 'আমাদের সবার উচিৎ আবেগিক প্রতিক্রিয়াগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা।' এরপর আমাদের একটা নির্দেশনা দেওয়া হলো যে আমরা আর কোনো সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে বা কাজের চাপ নিয়ে অভিযোগ জানাতে পারব না। এমন পরিস্থিতিতে আমার পক্ষে আর কাজ চালিয়ে যাওয় সম্ভব ছিল না।"
৮. "কয়েক বছর আগের কথা। আমার তখন ১৮ বছর বয়স। আমি একটা আইসক্রিম শপে কাজ করতাম। সেখানে কাজ শুরুর পর বেশিদিন হয়নি, এরই মধ্যে আমাকে একদিন একটা শিফটে একদম একা দায়িত্বে দেওয়া হলো। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত ছিল। এদিকে, আমি সেদিন আমার মোবাইলটাও সঙ্গে না রেখে আমার ব্যাগে রেখেছিলাম। কারণ আমি ভেবেছিলাম, কাজ চলাকালীন আমার তো সঙ্গে মোবাইল রাখা জরুরি না। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পর যখন আমি ফোন চেক করতে গেলাম, দেখলাম ডজনখানেক টেক্সট জমে আছে। আমার ম্যানেজার আমাকে লিখে পাঠিয়েছেন কী কী কাজ করতে হবে আমাকে। প্রথমে আমি ভাবলাম, কাজগুলো সারাদিনে শেষ করতে হবে আমাকে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। আমার পুরো শিফটজুড়েই ম্যানেজার আমাকে এরকম একের পর এক নির্দেশনা দিয়ে গেলেন। এরপর যখন শপে কোনো ভিড় ছিল না, তখন আমিও একটু বিশ্রাম নিতে লাগলাম। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি আমাকে টেক্সট দিলেন, 'তোমাকে সবসময় ব্যস্ত দেখাতে হবে। টেবিল, ফ্রিজ সবকিছু মুছতে থাকো।' গোটা ঘটনায় আমি খুবই থতমত খেয়ে গেলাম। পরের শিফটে যখন আমার সঙ্গে একজন কো-ওয়ার্কার ছিল, তার সঙ্গে আমি এ ব্যাপারে কথা বললাম। সে জানাল, 'হ্যা, আমাদের ম্যানেজার এমনই করে। ব্যাপারটা খুবই বিরক্তিকর।' এরপরও আমি কিছুদিন ওই শপে কাজ করেছি, কেননা আমার টাকার দরকার ছিল। কিন্তু খুব বেশিদিন আমি সেখানে টিকতে পারিনি।"
৯. "আমি একটি ছোট ল' ফার্মে কাজ করি, এবং এখানকার মেইন বসের মতো কৃপণ আর কেউ হতেই পারে না। কিছুদিন আগে তিনি আমাকে বললেন, আমার বেতন কমিয়ে দেওয়া হবে, কেননা আমি সপ্তাহে পুরো ৪০ ঘণ্টা কাজ করি না, এবং আমাকে গতানুগতিক বেতন দেওয়া তার সাধ্যে কুলাচ্ছে না। এর দুই সপ্তাহ পরই দেখলাম, ২৫ হাজার ডলারের একটি রোলেক্স ঘড়ি পরে তিনি শো-অফ করছেন। আমি তো দেখে পুরো থ! যা-ই হোক, এখন তিনি ছুটিতে আছেন। যখন ফিরবেন, আমাকে আর এই ফার্মে তিনি দেখতে পাবেন না!"
১০. এক শুক্রবার আমার ডাক্তারের অফিস থেকে বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে আমাকে কল দেওয়া হলো। একটা বায়োপসি করেছিলাম আমি, সেটার ভিত্তিতে আমার পরবর্তী অ্যাপয়েন্টমেন্টের ডেট এগিয়ে আনা হয়েছে। আমি জানতাম এর একটাই অর্থ হতে পারে: আমি ক্যান্সারে আক্রান্ত। আমি তখন নার্সের কাছে রীতিমতো অনুনয়-বিনয় করতে লাগলাম যেন আমাকে টেস্টের রেজাল্ট জানান। হ্যাঁ, আসলেই আমার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। আমি আমার বসকে ফোন দিয়ে সব জানালাম, আর বললাম ৫টার শিফটে আমি জয়েন করতে পারব না, মানসিকভাবে থিতু হতে আমার কিছুটা সময় লাগবে। জবাবে তিনি আমাকে বললেন, একটু সময় নিয়ে সাড়ে ৫টা থেকে কাজে জয়েন করতে। আমি সেদিন কাজে যাই, কাজ করিও বটে। কিন্তু জানিয়ে দিই উইকেন্ডের বাকি সময়টা আমি আর কাজে যাচ্ছি না। এরপরই আমি বুঝে যাই, চিকিৎসা শেষে আমার আর ওই চাকরিতে ফিরে যাওয়া হচ্ছে না। অথচ বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, আমার ওই বস নিজেও কিন্তু একজন ক্যান্সার সার্ভাইভার!"
- সূত্র: বাজফিড