অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের জন্য হাহাকার
রংপুর সদরে অবস্থিত চেহেল গাজী শিক্ষা নিকেতন উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে দশম শ্রেণিতে ১১৭ জন শিক্ষার্থী থাকলেও গত বুধবার ক্লাসে অংশ নিয়েছে মাত্র ৪৫ জন শিক্ষার্থী। একই দিনে নবম শ্রেণির ২৫২ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ক্লাসে উপস্থিত ছিল মাত্র ১০৩ জন।
ফলস্বরূপ, কোভিড-১৯ মহামারিজনিত কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থেকে পুনরায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ১০ দিন পর, নবম ও দশম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৪২ শতাংশ এবং ৩৮ শতাংশ।
চেহেল গাজী শিক্ষা নিকেতন উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মকবুল হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, অনেক শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবার অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছে এবং শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসছে না।
তিনি বলেন, "আমরা প্রতিষ্ঠানে ফিরে আসার চেষ্টা করছি। এবং সেজন্য আমরা অভিভাবকদের সঙ্গে ফোনে এবং অনেক সময় সরাসরি যোগাযোগও করে যাচ্ছি।"
সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলায় অবস্থিত মাজিয়ারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ২৪ জন শিক্ষার্থীর মাঝে বুধবার ক্লাসে অংশ নেয় মাত্র ১০ জন শিক্ষার্থী।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক চন্ডীদাস হাজরা টিবিএস-কে বলেন, গত দু'দিনে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমেছে। তবে তারা উপস্থিতি বাড়ানোর চেষ্টা করছেন।
এই দু'টি উদাহরণ থেকে দেখা যায়, শহরের বাইরের স্কুলেগুলোয় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ৫০ শতাংশেরও নিচে। আর শহরের স্কুল এবং কলেজগুলোতে উপস্থিতি প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড টিম সারা দেশের ২০টি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করে এ তথ্য সংগ্রহ করেছে।
শিক্ষকেরা জানিয়েছেন, তারা পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, অনেক শিক্ষার্থী স্কুলে এসাইনমেন্ট জমা দিতে আসছে না, শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে না এবং ২০২১ সালের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার ফরমও পূরণ করছে না। ফলে, প্রচুর শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুনরায় খোলার কয়েকদিন পর শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল ৬০ শতাংশের উপরে। কিন্তু গত পাঁচ দিনে তা ৬০ শতাংশের নিচে নেমে গেছে।
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম টিবিএসকে বলেন, কোভিড-১৯ মহামারির আগে তার প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল গড়ে ৯০ শতাংশ। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনরায় চালু হওয়ার পর থেকে এখন গড়ে ৭০-৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্লাসে উপস্থিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, "আমরা অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে স্কুলের পড়াশোনা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির কাজ করে যাচ্ছি। আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরিয়ে নিয়ে আসার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব"।
এদিকে মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন উইং-এর পরিচালক অধ্যাপক মোঃ আমির হোসেন জানিয়েছেন, সারা দেশ থেকে তারা তথ্য সংগ্রহ করছেন।
অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ শিক্ষাবিদদের
দেশের শিক্ষাবিদরা স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়াতে এবং সম্ভাব্য ঝরে পড়ার হার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান টিবিএসকে বলেন, সরকারকে অবিলম্বে জরিপ শুরু করতে হবে এবং স্কুলে অনুপস্থিতদের ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
তিনি বলেন, "কোভিড-১৯ মহামারি আমাদের অর্থনীতি এবং দেশের অন্যান্য সেক্টরগুলোয়ও আঘাত হেনেছে। অনেক পরিবার অর্থনৈতিক সংকটে আছে; তারা তাদের সন্তানদের শিশুশ্রম এবং বাল্যবিবাহে বাধ্য করবে। সরকারকে এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে হবে"।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমেদ বলেন, "মহামারি আঘাত হানার পর থেকে শিক্ষাবিদরা সম্ভাব্য ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করার সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে এখনো কোন উদ্যোগ নেয়নি। এমনকি আমরা উপজেলা পর্যায়ের কমিটি গঠনের সুপারিশ করেছি এবং এমন শিক্ষার্থীদের তালিকা তৈরির পরামর্শ দিয়েছি যারা ঝরে পড়ার ঝুঁকিতে ছিল, কিন্তু কোন লাভ হয়নি"।
তিনি বলেন, "আমি বলেছি, শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে সরকারের উচিত শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুলে খাবারের ব্যবস্থা করা। কিন্তু এখন খাবার দেওয়া একেবারে বন্ধ রয়েছে। এমনকি আমরা প্রতিটি উপজেলার জন্য ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করতে বলেছি এবং দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পরিবারকে আর্থিকভাবেও সাহায্য প্রদান করতে বলেছি, যাতে তারা সন্তানদের স্কুলে পাঠানো বন্ধ না করেন"।
খাদ্য কর্মসূচী বন্ধ হওয়ায় বিদ্যালয়ে উপস্থিতি কম!
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে দুপুরের খাবারের জন্য তহবিল না দেওয়া পর্যন্ত বিদ্যালয়গুলোতে খাদ্য কর্মসূচী স্থগিত রাখা হয়েছে; ফলে সারা দেশের দরিদ্র এলাকাগুলোয় ৩১ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থীর মাঝে অপুষ্টি এবং ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
১৫ হাজারেরও বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা গত দুই মাস ধরে রান্না করা খাবার বা ভিটামিন-সমৃদ্ধ বিস্কুট কিছুই পাচ্ছে না, যা তারা এই কর্মসূচীর অধীনে আগে পেয়ে থাকত।
মহামারি চলাকালীন তহবিল শেষ না হওয়া পর্যন্ত, শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বাড়িতে বিস্কুট সরবরাহ করেছিলেন। তবে, চলতি বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পঞ্চমবারের মতো এই কর্মসূচী চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এখনো পর্যন্ত কোনো তহবিল পায়নি।
গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব গোলাম হাসিবুল আলম বলেন, তহবিলের অভাবে সময় বাড়ানোর পরও কার্যক্রম শুরু হয়নি। তিনি বলেন, "আশা করছি, আমরা শীঘ্রই স্কুলগুলোতে আবারও খাবার বিতরণ শুরু করব"।
কমেছে বই ছাপানোর সংখ্যা
বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের পর থেকে বইয়ের সংখ্যা বাড়ানো হলেও এ বছর বইয়ের সংখ্যা কমেছে।
গত বছর, সরকার প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ৩৫.৯৩ কোটি বই বিতরণ করেছিল। তবে এ বছর, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ৩৫.১৬ কোটি বই ছাপাতে যাচ্ছে। অর্থাৎ, স্কুলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমায় বইয়ের সংখ্যাও কমেছে ৭৭ লাখ।
বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোও খারাপ সময় পার করছে
সারা বাংলাদেশে প্রায় ১৫ হাজার বেসরকারি স্কুল এবং কিন্ডারগার্টেন, মহামারির প্রভাবে অর্থাভাবে ভেঙে পড়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ছিল কমপক্ষে ২৫ লাখ। ফলে ১২ সেপ্টেম্বর থেকে পুনরায় স্কুল কার্যক্রম চালু হওয়া, তাদের কাছে কোনো অর্থ বহন করছে না।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের সভাপতি ইকবাল বাহার চৌধুরী জানান, মহামারির আগে ৬০ হাজার কিন্ডারগার্টেন প্রায় ১ কোটি শিক্ষার্থী এবং ১০ লাখ শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়ে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল।
তিনি বলেন, এখন বাকি ৪৫ হাজার কিন্ডারগার্টেন আবারও খুলেছে, তবে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি ৬০ শতাংশের মতো, যা মহামারি পূর্ব সময়ের গড় হার ৯০-৯৫ শতাংশের তুলনায় অনেক কম।
তিনি বলেন, "আমাদের অনেক শিক্ষার্থী পরিবারের সঙ্গে তাদের পৈতৃক গ্রামে চলে গেছে, কিছু হয়েছে শিশু শ্রমিক এবং অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।"
প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুতরভাবে শিক্ষক সংকটেরও সম্মুখীন হচ্ছে; কারণ প্রায় অর্ধেক শিক্ষকই অন্য পেশায় চলে গেছেন।
তবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ গোলাম ফারুক বলেছেন, সারা দেশের স্কুল-কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়াতে তারা কাজ করছেন।
তিনি বলেন, "শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আবারও প্রাণবন্ত করে তুলতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্ভাব্য সব ধরনের উদ্যোগ নেবে"।