অনুমোদনহীন মশার কয়েলের কোটি টাকার বাজার
- ভৈরবে ১৯৮০ সালে প্রথম স্থাপন করা হয় কয়েল কারখানা
- প্রতিদিন ভৈরব থেকে গড়ে ১ কোটি টাকার কয়েল বাজারজাত হয়
- শতাধিক কারখানার মধ্যে অনুমোদন আছে ৮-১০টির
- ভৈরব থেকে অন্তত ১৫০টি ব্র্যান্ডের নামে কয়েল বাজারজাত হয়
ডন, রকেট, বুলেট, নাইটগার্ড, জিরো, জিরাপাতা- এমন আরও অনেক বাহারি নামে মশার কয়েলের উৎপাদন হয় কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলায়। গত চার দশকে এই উপজেলায় গড়ে উঠেছে শতাধিক কয়েল কারখানা। এসব কারখানাগুলোর মধ্যে প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র ও অনুমোদন আছে কেবল ৮-১০টির। বাকি সবগুলোই চলছে অনুমোদনহীনভাবে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে। তবে অনুমোদনহীন এসব কারখানা থেকে প্রতিদিন গড়ে ১ কোটি টাকার কয়েল বাজারজাত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। এছাড়াও কয়েল কারখানাগুলোতে কর্মসংস্থান হয়েছে কয়েক হাজার নারী-পুরুষের।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৮০ সালে ভৈরবে সর্বপ্রথম কয়েল কারখানা স্থাপন করেন ইয়াকুব নামে এক ব্যবসায়ী। তার প্রতিষ্ঠিত ইয়াকুব মাহবুব কেমিকেল ওয়ার্কস থেকে 'বোরাক' নামে কয়েল উৎপাদন ও বাজারজাত করা হতো। এরপর ধীরে ধীরে পুরো ভৈরব উপজেলায় বিস্তৃত হতে থাকে কয়েল কারখানা।
বর্তমানে শতাধিক কয়েল তৈরির কারখানা সচল রয়েছে ভৈরবে। কারখানাগুলোতে অন্তত ৩ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। ভৈরব উপজেলার তাঁতারকান্দি, লক্ষ্মীপুর, ভৈরবপুর, কালীপুর ও জগন্নাথপুরসহ আরও কয়েকটি এলাকায় কয়েল তৈরির কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কারখানা রয়েছে তাঁতারকান্দি এলাকায়। তবে কারখানাগুলোর বেশিরভাগের অবস্থান আবাসিক এলাকায়।
মূলত বিভিন্ন বাসা-বাড়ি ভাড়া নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে কয়েল কারখানা। কারখানাগুলো থেকে অন্তত দেড়শ ব্র্যান্ডের নামে কয়েল উৎপাদন ও বাজারজাত হয়। তবে এর মধ্যে বোরাক কয়েল, বস, আবেদীন, সিটি, সেন্টমার্টিন, ম্যাক্সো ও পাহাড়ি কয়েলসহ কয়েকটি কয়েল তৈরির কারখানার অনুমোদন রয়েছে। তবে অনুমোদিত কারখানাগুলোর মধ্যে দুই-একটি কারখানায় একাধিক ব্র্যান্ডের নামে কয়েল উৎপাদন করা হয় বলে জানা গেছে।
অনুমোদনহীন কারখানাগুলো চলছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের মদদে। শুধুমাত্র পৌরসভার ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই বছরের পর বছর অবৈধভাবে ব্যবসা করে যাচ্ছেন কারখানা মালিকরা। কয়েল কারখানার জন্য পৌরসভা, ফায়ার সার্ভিস, কৃষি বিভাগ, বিএসটিআই ও পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বেশ কয়েকটি দপ্তর থেকে অনুমোদন নিতে হয়। তবে অনুমোদন নিতে নানা ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়- এমন অজুহাতে কারখানা মালিকরা অনুমোদন নিতে চাননা।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ভৈরবের কারখানাগুলোতে ৫ এবং ১০ টাকা পিস মূল্যের (সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য) কয়েল উৎপাদিত হয়। প্রতিদিন একেকটি কারখানা থেকে গড়ে ৫০ কার্টন কয়েল উৎপাদন ও বাজারজাত হয়ে থাকে। ৫ টাকা পিসের কার্টনে ৬০ প্যাকেট এবং ১০ টাকা পিস দরের প্রতি কার্টনে ৩০ প্যাকেট কয়েল থাকে। প্রতি প্যাকেটে কয়েল থাকে ১০টি।
ডিলারদের কাছে ৫ টাকা পিস দামের কয়েল প্রতি কার্টন ৯৫০ থেকে ১০০০ টাকা এবং ১০ টাকা পিস দামের কয়েল প্রতি কার্টন ১৮০০ থেকে ১৮৫০ টাকা দামে বিক্রি হয়। ডিলারদের মাধ্যমে ভৈরবে উৎপাদিত কয়েল ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নরসিংদী ও কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করা হয়।
ভৈরবের কালীপুরের আবেদীন কেমিকেল ওয়ার্কসের পরিচালক মো. নবী হোসেন বলেন, 'গত ৪-৫ বছরে ভৈরবে কয়েল তৈরির কারখানার সংখ্যা বেড়েছে। তবে আমরা সকল দপ্তরের অনুমোদন নিয়ে ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আবেদীন কয়েল উৎপাদন ও বাজারজাত করছি। আমাদের কারখানায় ৪০-৫০ জন শ্রমিক কাজ করেন। আমাদের উৎপাদিত কয়েল কুমিল্লা, নরসিংদী এবং গাজীপুরে বাজারজাত করা হয়'।
৩০ বছরেরও বেশি সময় কয়েল কারখানায় চাকরির পর এখন নিজেই ভৈরব উপজেলার ভৈরবপুরে কারখানা করেছেন কয়েল ব্যবসায়ী ফজলুর রহমান। তার মালিকানাধীন আরাফাত কেমিকেল ওয়ার্কস থেকে 'বস' নামে কয়েল উৎপাদন ও বাজারজাত করা হয়।
তিনি বলেন, 'প্রতিদিন ভৈরব থেকে গড়ে ১ কোটি টাকার কয়েল বাজারজাত হয়। ডিলারদের মাধ্যমে আমাদের কয়েল দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করা হয়। কয়েল ব্যবসার মৌসুম মূলত ৫ মাস। শীতকাল শুরু হওয়ার আগের তিন মাস এবং শীতকাল শেষ হওয়ার পর দুই মাস। বাকি সময়টা গড় মৌসুম ধরা হয়। আর গড় মৌসুমে ব্যবসা অর্ধেকে নেমে আসে'।
হাতে গোনা কয়েকটি কারখানার সকল কাগজপত্র আছে। মূলত কয়েল কারখানার অনুমোদন প্রক্রিয়া কিছুটা জটিল হওয়ায় ব্যবসায়ীরা অনুমোদন নিতে চাননা। এর ফলে সকল দপ্তরের অনুমোদন নিয়ে যারা ব্যবসা করছেন, তাদেরকে বিপাকে পড়তে হচ্ছে- যোগ করেন ফজলুর রহমান।
ভৈরবে যেভাবে তৈরি হচ্ছে মশার কয়েল
কয়েল তৈরির মূল উপাদান হিসেবে বিভিন্ন কেমিকেল ব্যবহৃত হয়। ওইসব কেমিকেলের সঙ্গে রং, তেঁতুলের বিচি, নারকেলের আরচি, কাঠের ভূষি ও বিশেষ একটি গাছের বাকল গুঁড়া করে মেশানো হয়। এরপর বসানো হয় কয়েলের ফ্রেমে। পরবর্তীতে ফ্রেম অনুযায়ী কেটে আগুনের তাপে শুকানো হয়। সর্বশেষ শুকানোর পর প্যাকেটজাত করে বাজারজাত করা হয়।
তবে কোনো কারখানাতেই ল্যাব-কেমিস্ট নেই। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক এবং মাত্রাতিরিক্ত কেমিকেল ব্যহৃত হয় কয়েল তৈরিতে। মান নিয়ন্ত্রণেরও কোনো বালাই নেই কারখানাগুলোতে। মাঝেমধ্যে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জরিমানা আদায় করা হয়।
ভৈরব উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিমাদ্রী খিসা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'হাতে গোনা কয়েকটি কারখানা ছাড়া সবগুলোই অনুমোদনহীন। আমরা মাঝেমধ্যে কারখানাগুলোতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করি। ওইসব অভিযানে মোটা অংকের অর্থ জরিমানা করা হয়। সম্প্রতি দুইটি কারখানা সিলগালাও করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে রাতের আঁধারে আবারও সেগুলো চালু করেন মালিকরা।
কারখানাগুলোতে মান নিয়ন্ত্রণের কোনো বালাই নেই। মাত্রাতিরিক্ত কেমিকেল দিয়ে তৈরি হওয়া নিম্নমানের এসব কয়েলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। অধিকাংশ কারখানার উৎপাদিত মানহীন কয়েল বিভিন্ন নামী ব্র্যান্ডের নামে বাজারজাত করা হয়', বলেন হিমাদ্রী খিসা।