অরক্ষিত খাগড়াছড়ির ৮৮,১৮১ একর সংরক্ষিত বনাঞ্চল
দেশের বৃহত্তম বনাঞ্চল রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে। পার্বত্য তিন জেলায় শ্রেণীভুক্ত এবং অশ্রেণীভুক্ত রাষ্ট্রীয় বনাঞ্চলের পরিমাণ প্রায় ৪,৪০০ বর্গমাইল। এরমধ্যে উত্তরে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার ভৌগলিক অংশে রয়েছে ৮৮ হাজার ১৮১ একর সংরক্ষিত বনাঞ্চল। তবে এসব বনের খবর জানেন না দায়িত্বপ্রাপ্ত বন কর্মকর্তারা। নানা সীমাবদ্ধতা, বনের সীমানা চিহ্নিত করে না দেয়া এবং নিরাপত্তাহীনতাকেই এর কারণ বলছেন তারা। এর ফলে তদারকি না থাকায় প্রাচীন কাচালং মাইনি হেড ওয়াটার বনাঞ্চলসহ খাগড়াছড়ির বনাঞ্চলগুলো দিন দিন বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়ছে।
চোরাকারবারীরা অবাধে ধ্বংস করছে খাগড়াছড়ির সবুজ বনাঞ্চল। কাঠ ব্যবসায়ী এবং বন কর্মকর্তাদেরসহ একটি অসাধুচক্র গড়ে উঠেছে এখানে। বন উজাড় করতে কিছু ক্ষেত্রে জোত পারমিটের ভুয়া দাখিলাও ব্যবহার করা হচ্ছে।
৮৮ হাজার একরে এ বনাঞ্চলের কাঠ রক্ষায় বনবিভাগের চেক স্টেশন রয়েছে মাত্র ৩টি। দীঘিনালা উপজেলা থেকে খাগড়াছড়ি আসার পথে জামতলী বন ও শুল্ক পরীক্ষণ ফাঁড়ি রয়েছে। এরপর খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম রুটে মানিকছড়ি গাড়ীটানা বিট কাম চেক স্টেশন এবং খাগড়াছড়ি-বারৈয়ারহাট রুটে রামগড় বিট কাম চেক স্টেশনে। কিন্তু এসব চেক স্টেশনের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা নির্দিষ্ট অংকের মাসোয়ারা দিয়ে চোরাই কাঠ পাচারে সহায়তা করছে- এমন অভিযোগ রয়েছে বনবিভাগের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
খাগড়াছড়ি জেলা সদরসহ আট উপজেলায় গড়ে উঠেছে অন্তত ৩৬টি ইটের ভাটা। যার একটিরও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। পরিসংখ্যান মতে, প্রতিটি ইটভাটায় বছরে গড়ে দেড় লাখ মণ জ্বালানি কাঠ পোড়ানো হয়। সে হিসাবে ৩৬টি ইটভাটায় বছর জুড়ে পুড়ছে দুই লাখ ১৬ হাজার মেট্রিকটন বনের কাঠ।
এছাড়া পুরো জেলার আনাচে-কানাচে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে অন্তত দেড় শতাধিক করাতকল। যার বেশীরভাগই অবৈধ। রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক দলের প্রভাবশালী নেতাদের পাশাপাশি এসব অবৈধ করাতকলের মালিকানায় রয়েছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাম।
বন আইন অনুযায়ী, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে করাতকল স্থাপনের কোনো সুযোগ বা নিয়ম নেই। তবে এসবের তোয়াক্কা করেন না বনখেকোরা। সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘিরেই অবৈধভাবে করাতকল স্থাপন করে দিনে-রাতে কাটা হচ্ছে সংরক্ষিত বনের কাঠ। করাতকল মিস্ত্রিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রতিটি করাতকলে দৈনিক অন্তত ১০০ থেকে ১৫০ ঘনফুট পর্যন্ত কাঠ চিরানো সম্ভব হয়। সেই হিসেবে খাগড়াছড়ি জেলার করাতকলগুলোতে প্রাত্যহিক গড়ে অন্তত সাড়ে ২২ হাজার ঘনফুট কাঠ চেরা হয়। বছর শেষে যার পরিমাণ ৮০ লাখ ঘনফুট ছাড়িয়ে যায়।
মূলত প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এভাবে অবাধে বন ধ্বংসের তাণ্ডব চলছে, নির্বিকার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার ভৌগলিক অংশে চারটি বনবিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে। এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বনবিভাগের আওতায় ৫৪১১২ একর, ঝুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগের আওতায় ১৮২৪৯.৬২ একর, অশ্রেণীভুক্ত বনাঞ্চল বনীকরণ বিভাগের আওতায় ৯৬১৯.৫০ একর এবং খাগড়াছড়ি বন বিভাগের আওতায় রয়েছে ৬২০০ একর সংরক্ষিত বনাঞ্চল। এই চার বন বিভাগ মিলিয়ে খাগড়াছড়ি জেলার ভৌগলিক অংশে মোট সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পরিমাণ ৮৮ হাজার ১'শ ৮১.১২ একর। তবে খাগড়াছড়ি বন বিভাগের আওতাধীনে এ সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং অশ্রেণীভুক্ত বনাঞ্চল বনীকরণ বিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কিছু অংশ ছাড়া এখনও হাজার হাজার একর বনাঞ্চল অরক্ষিত অবস্থায় আছে।
খাগড়াছড়ি জেলার সবচেয়ে বড় সংরক্ষিত বনাঞ্চলটি রয়েছে দীঘিনালা উপজেলার নাড়াইছড়িতে। নাড়াইছড়ি রেঞ্জটি পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের অধিভুক্ত। নাড়াইছড়ি রেঞ্জের মাইনি হেড ওয়াটার সংরক্ষিত বন গঠিত হয়েছিলো ১৮৭৫ সালে। এই সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পরিমাণ ৫৪ হাজার ১১২ একর। তবে এর পুরোটাই অরক্ষিত। এই বনাঞ্চলে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের অনিবন্ধিত পাহাড়ি আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর আধিপত্য রয়েছে ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা ছাড়া এই সংরক্ষিত বনাঞ্চলে যাতায়াত করতে পারেন না বন কর্মকর্তারা।
নাড়াইছড়ি রেঞ্জের ফরেস্টার আবদুল জলিল বলেন, 'এই রেঞ্জের সংরক্ষিত বনটি একেবারেই দুর্গম এবং ভারতের সীমান্ত ঘেঁষা। এছাড়া ওই এলাকায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র পাহাড়ি আঞ্চলিক সংগঠন ইউপিডিএফ ও জেএসএস এর আধিপত্য রয়েছে। এসব সংগঠনের প্রভাবে আমরা অনেকটা অসহায় এখানে।'
পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা অজিত কুমার রুদ্র বলেন, 'জেলা প্রশাসন থেকে বনভূমির অবস্থান ও সীমানা চিহ্নিত করে বুঝিয়ে দেয়া হয়নি বন বিভাগকে। এই সমস্যাটা দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশী সময়ের। তবে সেনাবাহিনীর সহায়তা নিয়ে আমি ওই বনাঞ্চল পরিদর্শনে যাবার পরিকল্পনা করছি।'
১৯৬০-৬১ সালে ঝুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগের সৃষ্টি করা হয়। মূলত ভূমিহীন জুমিয়া পরিবারের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন, জুম চাষ নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থানের সৃষ্টি, দারিদ্র বিমোচন, ভূমির ক্ষয়রোধ, নাব্যতা বৃদ্ধি, ভূমির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং বনজ সম্পদের উন্নতির লক্ষ্যে এই বিভাগ গঠন করা হয়েছিল। এই বন বিভাগের আওতায় পড়েছে খাগড়াছড়ির হাজাছড়ি রেঞ্জ ও মেরুং রেঞ্জ।
হাজাছড়ি রেঞ্জে সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে ১২৩৫০ একর। এর মধ্যে ২৮ নং রেংকার্য্যা মৌজায় ৪৬০০ একর, ২৯ নং ছোট মেরুং মৌজায় ১৭৫০ একর এবং ৫৬ নং বড় হাজাছড়ি মৌজায় রয়েছে ৬০০০ একর। এই দুই রেঞ্জের কোনোটিতেই বনবিভাগের নিয়ন্ত্রণ নেই।
হাজাছড়ি রেঞ্জের ফরেস্টার মো. সোলায়মান বলেন, 'এই রেঞ্জের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে আমাদের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। এখন পর্যন্ত রেঞ্জের সীমানাও চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। সীমানা নির্ধারণ করতে গেলে পাহাড়ি আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর বাঁধার সম্মুখীন হতে হয় আমাদের।'
মেরুং রেঞ্জে ৫৮৯৯.৬২ একর সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে। তবে এই সংরক্ষিত বনটিতেও বনবিভাগের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এই বনাঞ্চল কোথায়, কোনদিকে অবস্থান দায়িত্বপ্রাপ্ত বন কর্মকর্তাদের জানা নেই।
মেরুং রেঞ্জের ফরেস্টার মো. মতিউর রহমান বলেন, 'সংরক্ষিত বনাঞ্চলটিকে কেবল কাগজে কলমেই চিনি। বাস্তবে আমি জানি না এটির অবস্থান কোনদিকে?
আমি এই রেঞ্জের ফরেস্টার হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছি প্রায় দু'বছর হতে চললো। জেলা প্রশাসন সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সীমানা ও অবস্থান চিহ্নিত করে কিছুই বুঝিয়ে দেয়নি'।
অন্যদিকে ঝুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জি.এম মোহাম্মদ কবীর বলেন, 'আমার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংরক্ষিত বনাঞ্চলগুলো অনেক দুর্গম এলাকায়। চাইলেই আমরা সেখানে যখন-তখন যাওয়া-আসা করতে পারি না। সংরক্ষিত বনাঞ্চলে যাতায়াতের জন্য সেনাবাহিনীর সহায়তা নিতে হয়।'
খাগড়াছড়ি জেলার ভৌগলিক অংশে সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে ৯৬১৯.৫০ একর। এগুলো অশ্রেণীভুক্ত বনাঞ্চল বনীকরণ পরিকল্পনায় ১৯৯৩ ও ৯৪ সালে সৃষ্টি করা হয়। এর মধ্যে মহালছড়ি রেঞ্জে রয়েছে ৪৪৯০ একর, লক্ষ্মীছড়ি রেঞ্জে ১৬৫ একর এবং বীজিতলা রেঞ্জের আওতায় ৪৯৬৪.৫০ একর। মহালছড়ি রেঞ্জের ৪৪৯০ একর সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ নেই। এই রেঞ্জের ফরেস্টার হিসেবে তিন মাস আগে দায়িত্ব নিয়েছেন নিজাম উদ্দিন আহমেদ। তবে তিনি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সীমানা এবং অবস্থান জানেন না।
লক্ষ্মীছড়ি রেঞ্জের সংরক্ষিত বনাঞ্চলটিও একেবারেই অরক্ষিত রয়েছে। তবে এটা অস্বীকার করে দায়িত্বরত কর্মকর্তা ফরেস্টার আবদুল গফুর খান চৌধুরী বলেন, '১৬৫ একর সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পুরোটাই বন বিভাগের দখলে আছে। নিয়মিত টহল দেয়া হয় সেখানে।'
বীজিতলা রেঞ্জের বনাঞ্চল দুটিও বন বিভাগের দখলে রয়েছে বলে দাবি ফরেস্টার মোহাম্মদ আখতারুজ্জামানের। কিন্তু তিনি বনের সীমানা কতোটুকু জানেন না।
খাগড়াছড়ি'র বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. সারওয়ার আলম জোর দিয়ে বলেন, 'বন বিভাগের আওতায় যেসব সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে সবটুকুই আমাদের দখলে আছে। আমরা নিয়মিত ওই বনাঞ্চলে টহল পরিচালনা করছি এবং বনাঞ্চল রক্ষায় তৎপর আছি।'
কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, কেবল খাগড়াছড়ি জেলা শহরের আশপাশের সামান্য কিছু সংরক্ষিত বনাঞ্চল বাদে বাকি অংশে কোন নিয়ন্ত্রণ নেই বন বিভাগের। কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণ হিসেবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে বনভূমির সীমানা এবং অবস্থান চিহ্নিত করে বুঝিয়ে বিষয়টিকেই মূল বলছেন বন কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের বক্তব্য ভিন্ন। জেলা পরিবেশ ও বন উন্নয়ন কমিটির সভাপতি, খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, 'বনাঞ্চলের অবস্থান ও সীমানা বুঝিয়ে না দেয়ার যে অজুহাত বন কর্মকর্তারা দিচ্ছেন এটি নিতান্তই হাস্যকার। সীমানা এবং অবস্থান না জানলে বিষয়টি জেলা প্রশাসনকে অবহিত করা জরুরী ছিল। অথচ কখনোই বন কর্মকর্তারা বিষয়টি জেলা প্রশাসনকে অবগত করেননি।'
পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলন খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সভাপতি প্রদীপ চৌধুরী বলেন, 'এ সংকট নতুন নয়। দীর্ঘ বছর ধরে অবাধে বন ধ্বংসের ফলে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু হয়েছে। বনের সীমানা চিহ্নিত করণের পাশাপাশি, বনকে মানুষ মুক্ত করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে কাঠ কর্তনের ওপর একটি দীর্ঘ সময়ের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা না গেলে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসবে।'
খাগড়াছড়ি জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন মজুমদার বলেন, 'সংরক্ষিত বনাঞ্চলগুলো কেবল কাগজে-কলমেই সরকারি দখলে। তবে বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর না হওয়ার ফলে দিন দিন এ জেলা থেকে কাঠ পাচার বেড়েই চলেছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে পরিবেশ ও জলবায়ুর ওপর। জেলার সবকটি রুটে নিরাপত্তা চেকপোস্ট স্থাপন করে কাঠ পাচার রোধ করা ভীষণ জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে।'