একুশে বইমেলায় এবার বই প্রকাশ হবে কম
এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলাতে বই কম প্রকাশ হলেও ভালো বিক্রি হবে বলে প্রত্যাশা করছেন প্রকাশক ও এই খাতের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টরা। এখন ছাপা-বাঁধাই ও প্রচ্ছদের ব্যস্ততা নিয়ে চলছে বইমেলার প্রস্তুতি।
প্রকাশক, প্রচ্ছদশিল্পী, লেখক, মুদ্রণ, বাঁধাই ও পরিবহন খাতে কাজ করা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অন্যান্যবারের তুলনায় এবারের মেলাতে ৪০-৫০ শতাংশ বই কম প্রকাশ হবে।
কারণ হিসেবে তারা বলছেন, অনেক লেখকই সন্দিহান ছিলেন- এবার বইমেলা হবে কি না। তাই পাণ্ডুলিপি তৈরি করেননি। আর যখন মেলার তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে, তখন সময় সংকটে পড়েছেন তারা।
অন্যদিকে, প্রকাশকরাও এবার বই প্রকাশ করছেন ভেবে-চিন্তে।
এদিকে প্রতি বছর ১ ফেব্রুয়ারি বইমেলার পর্দা উঠলেও এবার মহামারির কারণে পিছিয়ে গিয়ে ১৮ মার্চ উদ্বোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলা একাডেমি। মেলা চলবে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত।
অনন্যা প্রকাশনের কর্ণধার মনিরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, 'কোভিডের কারণে সব ব্যবসা খাতই কম-বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। আমাদের বেলাতেও তা-ই। গত মেলাতে ১৫০টির মতো বই প্রকাশ করেছি। এবার ৬০টির মতো করব। আসলে মূল সংকট অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে। ব্যবসা প্রায় বছরখানেক বন্ধ ছিল। এই পরিস্থিতিতে নতুন করে কোনো ঝুঁকি নেব না। তবে আশা করছি এবার পর্যাপ্ত বই বিক্রি হবে।'
বাতিঘর প্রকাশনীর সিইও জাফর আহমেদ রাশেদ টিবিএসকে জানান, গত বছর তারা ৬০টি বই প্রকাশ করেছেন। এবার ৪০টি করবেন। এরমধ্যে গতবারের বেশ কিছু বই রয়েছে, যা তারা সেবার প্রকাশ করতে পারেননি।
'বইপ্রেমিরা দীর্ঘদিন ধরে একুশে বইমেলার অপেক্ষা করছেন। এবার বই প্রকাশ কম হলেও আমরা বিক্রির যা প্রত্যাশা করছি, তার চেয়েও বেশি হবে বলে মনে করছি,' যোগ করেন রাশেদ।
এদিকে ভিন্ন চিত্রও রয়েছে। অন্যপ্রকাশ গত বছর ৭০টি বই প্রকাশ করলেও এবার তারা ১০০টি বই প্রকাশ করছে বলে টিবিএসকে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম।
অর্থ সংকটে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান
করোনার কারণে প্রায় ৯ মাসের মতো বন্ধ ছিল দেশের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো। খাতটি শিল্প না হওয়ায় সরকারের কাছ থেকে কোনো আর্থিক সহায়তা পায়নি। পরিস্থিতি যখন স্বাভাবিক হতে শুরু করে, তখন থেকে তারাও ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় রত। তবে তারা নগদ অর্থের সংকটে ভুগছে।
প্রিয় মুখ প্রকাশনের কর্ণধার আহমেদ ফারুক টিবিএসকে বলেন, 'প্রতি বছর কমপক্ষে ৩৫-৪০টি বই প্রকাশ করি। কিন্তু এ বছর তার অর্ধেক বই প্রকাশ করব। কারণ দীর্ঘদিন ব্যবসা বন্ধ ছিল। নগদ অর্থের সংকটে আছি। করোনার ধাক্কাটা সামাল দিতে আরও বছরখানেক সময় লাগবে।'
পুরান ঢাকার সূত্রাপুর, বাংলাবাজার, পল্টন, সেগুনবাগিচা, কাঁটাবন, নীলক্ষেত, মতিঝিল, আরামবাগ, ফকিরাপুল ও গোপীবাগের প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঘুরে দেখা গেছে, অন্যান্যবারের তুলনায় এবার প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যস্ততা বেশ কম। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের অলস সময় কাটাতে দেখা গেছে।
দেশের সবচেয়ে বড় বইয়ের বাজার- বাংলাবাজার। এখানে ছোট বড় মিলিয়ে প্রকাশকের সংখ্যা প্রায় চারশ। এছাড়া পাঠ্য বইয়েরও প্রকাশক রয়েছেন। সব মিলিয়ে এখানে দোকান আছে দুই হাজারের মতো।
প্রেসে নেই ধুন্ধুমার ব্যস্ততা
বাংলাবাজারের বেশ কয়েকটি ছাপাখানা ঘুরে দেখা যায়, এবার অন্যান্যবারের মতো নতুন বই ছাপানোর ধুন্ধুমার ব্যস্ততা নেই। প্রেস মালিকরা জানান, ছাপাখানাগুলোতে অন্যান্য বছর এই সময় উৎসবমুখর পরিবেশ থাকে। ছাপাখানা মেশিনের খটখট শব্দ মাতিয়ে রাখে চারিদিক। দুই শিফটে কাজ করতে হয়। কিন্তু এবার তা নেই।
প্যারিদাস রোডের জনতা প্রিন্টার্সের কর্ণধার অশোক রঞ্জন পাল চার দশক ধরে এই ব্যবসায় জড়িত। তিনি টিবিএসকে বলেন, 'গত বছর আমাদের বইমেলার অনেক কাজ ছিল। সে তুলনায় এ বছর কাজ নেই বললেই চলে। ২০ শতাংশ কাজ আছে মাত্র। আমাদের প্রেসে গতবার আমরা ৩০০টির মতো বই ছাপিয়েছি বিভিন্ন প্রকাশনীর। এ বছর এখন পর্যন্ত মাত্র ৭টি বই এসেছে। আমাদের পাঁচটি মেশিনের তিনটিই বন্ধ।'
প্যারিদাস রোডে গিয়ে দেখা গেছে, সারি সারি ভ্যানগাড়িতে প্রেসের সাদা কাগজ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আবার কয়েকটি ভ্যানগাড়িতে ছাপা হওয়া কাগজ বাঁধাইয়ের জন্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে অন্যান্য বছর বইমেলার আগে যতটা ব্যস্ততা থাকে, এবার ততটা নেই।
রাজধানীর ফকিরাপুল এলাকায় জিন্নাত প্রিন্টার্সের মালিক লিয়াকত হোসেন বলেন, 'ফকিরাপুল ও আরামবাগ এলাকার ছাপাখানা ব্যবসায় কয়েক বছর ধরেই মন্দা চলছে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়।'
এদিকে বাংলাবাজারে এক'শরও বেশি রয়েছে বাঁধাইঘর। সেসব জায়গায় এবার রাত জেগে বই বাঁধাই চলছে না। একজন প্রকাশক জানান, অন্যান্য বছর এই সময়টায় বাঁধাইকারিদের কাজের চাপ বেশ বেড়ে যায়। কিন্তু এবার তারা এখনো দিনের বড় একটা সময় অলস কাটাচ্ছেন।
প্রভাব প্রচ্ছদশিল্পেও
অন্যান্য বছর বইমেলার আগে প্রচ্ছদশিল্পীদের ব্যস্ততা থাকে তুঙ্গে। প্রতিষ্ঠিত জেষ্ঠ্য শিল্পীরা তো আছেনই, তরুণ শিল্পীরাও দিনরাত প্রচ্ছদ আঁকা ও অলংকরণের কাজ করেন। কিন্তু এবার ব্যস্ততা কম প্রচ্ছদশিল্পীদের।
এই সময়ে প্রচ্ছদশিল্পীদের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় সব্যসাচী হাজরা। তিনি টিবিএসকে বলেন, 'গতবার যে পরিমাণ বইয়ের প্রচ্ছদ ডিজাইন করেছি, সে তুলনায় এখন পর্যন্ত মাত্র ৬০ শতাংশ কাজ এসেছে।'
তিনি বলেন, 'গত প্রায় এক বছর দেশের মানুষ অন্য রকম একটা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন। তবে এখন ভ্যাকসিন নিচ্ছেন অনেকেই। পরিস্থিতিও বেশ ভালোর দিকে। মেলাটা জমবে বলে মনে হচ্ছে।'
'তবে বইমেলায় কম বই প্রকাশ হওয়াই ভালো। এতে প্রকাশকদের একটা শিক্ষা হবে! বই কেন শুধু মেলাকেন্দ্রিক প্রকাশ পাবে? বই আসলে সারা বছর ধরেই প্রকাশ করা উচিত', যোগ করেন সব্যসাচী।
দেশের প্রচ্ছদশিল্পীদের মধ্যে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন শিল্পী ধ্রুব এষ। তিনি টিবিএসকে বলেন, 'আমার ধারণা এবার মেলা খুব ভালো হবে। অনেকদিন ধরে আমরা একত্রিত হওয়ার সুযোগ পাই না।'
তিনি বলেন, 'আমার কাজের চাপ অনেক। তবে আমার কাজ দিয়ে পুরো প্রচ্ছদশিল্পের বাজারের জায়গাটা বিবেচনা করা যাবে না। আমি তো সারা বছর ধরেই কাজ করি। তবে সব মিলিয়ে প্রচ্ছদশিল্পের অবস্থা কিন্তু ভালো নয়।'
অর্ধেক ভাড়ায় স্টল
বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, করোনা মহামারি বিবেচনায় রেখে সরকার প্রকাশকদের এবার অর্ধেক ভাড়ায় স্টল বরাদ্দ দিয়েছে।
বাংলা একাডেমির সচিব এ. এইচ. এম. লোকমান টিবিএসকে জানান, 'এ বছর প্রায় ৩৪টি প্যাভিলিয়ন থাকছে। প্যাভিলিয়ন ছাড়াও ৫৫০টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অংশ নিচ্ছে মেলাতে।'
বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ টিবিএসকে বলেন, 'মেলার আগে টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত সড়কটি পরিচ্ছন্ন করে দেওয়ার জন্য মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে।'
পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির রাজধানী কমিটির সভাপতি মাজহারুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা এখন প্রস্তুতির শেষ পর্যায়ে রয়েছি। মেলার প্রথম সপ্তাহেই আমাদের বেশিরভাগ নতুন বই চলে আসবে। তবে এ বছর বইয়ের দাম বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।'