করোনা আক্রান্তদের বিনামূল্যে অক্সিজেন দেয় রাজশাহীর শহীদ জামিল বিগ্রেড
রাজশাহীতে করোনা আক্রান্তদের জন্য বিনামূল্যে অক্সিজেন ও অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস চালু করেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন 'শহীদ জামিল বিগ্রেডের' সদস্যরা। শুরুর পর থেকে ইতিমধ্যে ৮৫টি পরিবারকে বিনামূল্যে অ্যাম্বুলেন্স সেবা ও অক্সিজেন সেবা দিয়েছেন তারা। পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডে গিয়ে মাস্ক বিতরণ ও সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করছেন। এছাড়া করোনা আক্রান্ত কেউ মারা গেলে পরিবারের সদস্যরা মৃত্যু পরবর্তী কার্যাদি সম্পন্ন করতে অনীহা পোষণ করলে তারা সেইসব মরদেহ দাফন বা দাহ করার দায়িত্বও পালন করছেন।
শুরুটা ৫ জুন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পর রাজশাহীতে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় করোনা আক্রান্তদের সেবার মহান ব্রত নিয়ে রাজশাহী কলেজ প্রাঙ্গণে শহীদ জামিল বিগ্রেড গঠন করা হয়। সমন্বয়ক করা হয় ওয়ার্কার্স পার্টির রাজশাহী মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ প্রামাণিক দেবুকে। প্রধান উপদেষ্টা রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য ও ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা।
দেবাশীষ প্রামাণিক বলেন, 'শহীদ জামিল আকতার রতন রাজশাহী মেডিকেল কলেজের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। যখন সারাদেশ ব্যাপী সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন চলছিলো, তখন ১৯৮৮ সালের ৩১ মে জামায়াত-শিবিরের সাম্প্রদায়িক শক্তি জামিল আকতার রতনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। জামিল আকতার রতন অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক। সেজন্য তার নামে 'শহীদ জামিল বিগ্রেড' করা হয়েছে। কারণ আমরাও এখন একটা যুদ্ধাবস্থায় রয়েছি'।
৫ জুন শহীদ জামিল বিগ্রেড গঠনের পর শুরুতেই মানুষের মাঝে মাস্ক ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ শুরু হয়।
করোনার তৃতীয় ঢেউয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পর যখন রাজশাহীতে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকে। হাসপাতালে অক্সিজেনের সংকট দেখা দেয় এবং হাসপাতালে দ্রুত আসার কোনো বাহন পাওয়া যাচ্ছিলো না, তখন গত ১৭ জুন করোনা আক্রান্তদের দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা অক্সিজেন সেবা ও অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস দেওয়া শুরু করে শহীদ জামিল বিগ্রেডের সদস্যরা। বর্তমানে সিটি কর্পোরেশন এলাকার ৩০টি ওয়ার্ডে দুইটি অ্যাম্বুলেন্স ও ২০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে সেবা দিচ্ছেন তারা। দিনরাত ২৪ ঘণ্টায় যেকোনো সময় তাদের হটলাইন নম্বরে ফোন করলেই ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স ও অক্সিজেন। হটলাইন নম্বরগুলো হলো-০১৭১২২৭৭৮৭১,০১৭২৩৯০৪৯০১,০১৭৪১৬৫১২২৯।
দেবাশীষ প্রামাণিক দেবু বলেন, 'প্রতিদিন আমাদের কাছে ২৫ থেকে ৩০টি কল আসছে। বিশেষ করে রাত্রে আসে অ্যাম্বুলেন্সের সুবিধা চেয়ে আর বিকেলের দিকে অক্সিজেনের চাহিদা বেশি আসে। কল করার ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যেই আমাদের টিম পৌঁছে যায়'।
দেবাশীষ প্রামাণিক দেবু বলেন, 'সিটি কর্পোরেশন, রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ, হার্ট ফাউন্ডেশন থেকেও বিনামূল্যে অক্সিজেন সিলিন্ডার দেওয়া হলেও আমাদের ওপরই চাপ বেশি। অথচ ওদের অক্সিজেন সিলিন্ডার বেশি। সিটি কর্পোরেশনে ফোন করে অক্সিজেন চাইলেও তারা শহীদ জামিল বিগ্রেডের ফোন নম্বর দিয়ে দেয়। আমাদের অক্সিজেন সিলিন্ডার কম। তারপরও প্রতিদিন আমাদের গড়ে ১০ থেকে ১৫টি অক্সিজেন সিলিন্ডার রিফিল করতে হয়। সিলিন্ডার কম থাকায় আমাদের কিছু কৌশল মেনে চলতে হয়। যেমন করোনা আক্রান্ত কোনো পরিবার থেকে অক্সিজেন চেয়ে কেউ ফোন দিলে শহীদ জামিল বিগ্রেডের সদস্যরা তৎক্ষণাৎ সেখানে পৌছে যায়। এরপর রোগীর অক্সিজেন লেভেল মেপে দেখে। অক্সিজেন লেভেল ৯০ এর নিচে নামলে তাকে অক্সিজেনের সুবিধা দেয়। আর ৯০ এর উপরে থাকলে তাদেরকে কাউন্সেলিং করা হয়। বলা হয়, কোনো সমস্যা হবে না। যদি ৯০ এর নিচে নামে ফোন দিলে সঙ্গে সঙ্গে অক্সিজেন পৌঁছে দেওয়া হবে। কারণ আমরা কাউকে অক্সিজেন রিজার্ভ করতে দিই না'। আরও ১০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার বাড়ানোর চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।
দেবাশীষ প্রামাণিক আরও বলেন, 'নগরীর সাহেব বাজার জিরোপয়েন্টে অবস্থিত আমাদের পার্টি অফিসে অ্যাম্বুলেন্সস, চালকসহ স্বেচ্ছাসেবী সদস্যরা ২৪ ঘণ্টায় থাকেন। ইতিমধ্যে আমরা ৮০ থেকে ৮৫টি পরিবারকে অ্যাম্বুলেন্স সহায়তা দিয়েছি। কারণ এই লকডাউনে গাড়ি পাওয়া অনেক কঠিন। আবার পেলেও রোগী বহন করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে যে ব্যয় হয় তা নির্বাহ করার অনেকের সার্মথ্য থাকে না'।
শহীদ জামিল বিগ্রেডের অক্সিজেন সার্ভিস পেয়েছেন নগরীর অক্ট্রয়ের মোড় এলাকার বাসিন্দা বাদশা হক। তিনি বলেন, 'গত সোমবার সকালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে আমার মাকে ছাড়পত্র দেয়। মা হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ছিলেন। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বলেছিলেন, অক্সিজেন লাগতে পারে বাসায় সংগ্রহ করে দিতে পারবেন কিনা। বিকেলে শহীদ জামিল বিগ্রডের হটলাইনে ফোন করার সাথে সাথে অক্সিজেন দিয়ে যায় তারা। দুইদিন ব্যবহার করে সিলিন্ডার ফেরত দিই'।
একই কথা জানালেন নগরীর উপশহর এলাকার ওয়াকার হাসান মাহমুদ। তিনি বললেন, 'আমার বড় ভাই কোভিড সাসপেক্টেড ছিলেন। অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। জামিল বিগ্রেডের হটলাইনে ফোন করার সাথে সাথে তারা অক্সিজেন দিয়ে যায়'।
শহীদ জামিল বিগ্রেড পুরো সিটি কর্পোরেশন এলাকায় তাদের সেবা পৌঁছে দিচ্ছে। এইজন্য তারা ৩০টি ওয়ার্ডে গঠন করেছে শহীদ জামিল বিগ্রেডের স্বেচ্ছাসেবক কমিটি। প্রতিটি ওয়ার্ডের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মাস্ক বিতরণ ও সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করছেন তারা।
এছাড়া গত ২২ জুন করোনা মোকাবেলায় ছয় দফা দাবিতে শহীদ জামিল বিগ্রেডের সদস্যরা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশও করেছেন।
স্মারকলিপিতে তারা দাবি করেন, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বর্তমানে চালু ২০টি আইসিইউ সুবিধার দ্বিগুণ অর্থাৎ ৪০টি আইসিইউ সুবিধার ব্যবস্থা করা, পর্যাপ্ত অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা, হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ব্যবহারে নার্স ও টেকনিশিয়ানদের প্রশিক্ষিত করা, রাজশাহী সদর হাসপাতালকে পূর্ণাঙ্গ কোভিড হাসপাতাল ঘোষণা, ১২ কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনা যাতে করে সাধারণ মানুষও টিকার আওতায় আসে।
দেবাশীষ প্রামাণিক দেবু বলেন, 'এই ছয় দফা দাবি সম্পর্কে আমরাও মানুষকে সচেতন করছি। পাশাপাশি প্রতিটি ওয়ার্ডের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মাস্ক বিতরণ ও সচেতন করা হচ্ছে'।