কোভিড-১৯ এর জন্য দেশে এখনও পৃথক বীমা পলিসি তৈরি হয়নি
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের বছর পেরিয়ে গেলেও স্বাস্থ্য সুরক্ষা পেতে এর জন্য আলাদা কোনো বীমা পলিসি চালু করেনি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলো। এতে করোনায় সংক্রমিত হওয়ার আগেই ভাবতে হচ্ছে ব্যয়বহুল চিকিৎসা নিয়ে।
বেসরকারি হাসপাতাল থেকে যেসব করোনা রোগী বেঁচে ফিরছেন, তাদের বহন করতে হচ্ছে মোটা অংকের টাকা। আর মুমূর্ষু কোভিড রোগীদের জন্য আইসিইউর ব্যবস্থা করতে হলে হাসপাতালভেদে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে কয়েকগুণ।
কারণ বেসরকারি হাসপাতালগুলোর একদিনের আইসিইউ ব্যয় ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত। এর বাইরে ওষুধ বা ইনজেকশন ক্রয় করতে আলাদা অর্থ ব্যয় করতে হয় যা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর জন্য বর্তমানে সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কোম্পানিগুলো বলছে, স্বাস্থ্য বীমার আওতায় তারা কোভিড রোগীরও হেলথ কাভারেজ দিচ্ছেন। এমনিতে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য বীমা গ্রহীতার হার অনেক কম। সেখানে করোনা নিয়ে পলিসি আনার চিন্তা থাকলেও বাস্তবে কোন পদক্ষেপ গৃহীত হয় নি।
গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড 'কোভিড ইন্স্যুরেন্স' নামে একটি পাইলট পলিসি চালু করেছে।
এছাড়া অন্যান্য বাংলাদেশি বীমা কোম্পানিগুলো এখনও কোভিড চিকিৎসায় পলিসিহোল্ডারদের জন্য আলাদাভাবে কোনো সেবা চালু করেনি।
তবে স্বাস্থ্য খাতে বীমার আওতায় কোনো পলিসিহোল্ডার কোভিডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করলে তিনি হেলথ কাভারেজ পাবেন।
গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের ডিজিটাল বিজনেসের প্রধান মোঃ মনিরুজ্জামান খান বলেন, 'ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য ব্যয় হ্রাস করে সর্বোত্তম চিকিৎসা সুবিধাগুলো নিশ্চিত করতে সাশ্রয়ী স্বাস্থ্য বীমা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে'।
'আমরা কোভিড-১৯ বীমা প্রদান করছি, যেখানে বীমা গ্রহণকারীর প্রত্যেকে সার্স কোভিড রোগের পাশাপাশি ব্যক্তিগত কোন দুর্ঘটনায়ও সহায়তা পাবেন'।
দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু ও সংক্রামক রোগে মৃত্যু, দুর্ঘটনাজনিত জরুরি চিকিৎসা ব্যয় এবং হাসপাতালের নগদ ভাতা এই বীমা পলিসির আওতাভুক্ত।
জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম নুরুজ্জামান বলেন, 'করোনার জন্য আলাদা করে পলিসি চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। আমরা এ বিষয়ে একচুয়ারির মতামত চেয়েছি। একচুয়ারির মতামতের পর কোম্পানির বোর্ড পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিবেন'।
'এখন আমরা হেলথ ইন্স্যুরেন্সের আওতায় কোভিডের জন্য হেলথ কাভারেজ দিচ্ছি'।
গার্ডিয়ান লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের যোগাযোগ বিভাগের প্রধান রুবাইয়াত সালেহীন বলেন, 'করোনার মধ্যে এ খাতে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য বীমা বেড়ে গেছে। মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য বীমা নিয়ে সচেতনতা আগের তুলনায় বাড়ছে। অনেকে স্বাস্থ্য বীমা পলিসি গ্রহণ করছেন। তবে কোভিডের জন্য আলাদা কোনো পলিসি আমরা চালু করিনি'।
তিনি বলেন, 'আমরা কোভিডকে গুরুত্ব দিয়ে পলিসিহোল্ডারদের প্রিমিয়াম অনুসারে স্বাস্থ্য সহায়তা দিচ্ছি। করোনার মধ্যে স্বাস্থ্য বীমা পলিসির হার বেড়ে গেছে। আগে মোট পলিসির ৫ থেকে ১০ শতাংশ ছিল স্থাস্থ্য বীমা, এখন তা ২০ শতাংশের ওপরে চলে গেছে'।
কোভিডকেন্দ্রিক নতুন নতুন সেবা চালু করতে বীমা কোম্পানিগুলোকে উৎসাহিত করছে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) এবং বিমা কোম্পানির মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ)।
আইডিআরএ'র চেয়ারম্যান এম মোশাররফ হোসেন বলেন, 'বিদ্যমান হেলথ ইন্স্যুরেন্স কাভারেজের আওতায় কোভিড আক্রান্তরা বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিলে তার বীমা সুবিধা পাবেন। তবে কোভিড-১৯ কে মাথায় রেখে আলাদা হেলথ ইন্স্যুরেন্স হওয়া উচিত। শুধু করোনাক্রান্তদের চিকিৎসা কিংবা মৃত্যুই নয়, কোভিড আক্রান্ত হওয়ার পর অনেকের কিডনি, হৃদপিণ্ড ও স্নায়বিক সমস্যা হচ্ছে। এজন্য কোভিডকেন্দ্রিক ইন্স্যুরেন্স প্রোডাক্ট চালু করতে কোম্পানিগুলোকে উৎসাহিত করছি আমরা'।
সার্বজনীন স্বাস্থ্য বীমা চালুর বিষয়ে তিনি বলেন, 'এ বিষয়ে এখনও কোন অগ্রগতি নেই। এমনকি সরকারি চাকরিজীবী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সরকারিভাবে স্বাস্থ্যবীমা করার একটি উদ্যোগ ছিল। এ বিষয়ে কয়েকটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হলেও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত না হওয়ায় তা আটকে আছে'।
বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ কবির বলেন, 'আমরাও বীমা কোম্পানিগুলোকে কোভিড সংশ্লিষ্ট নতুন প্রোডাক্ট চালুর ব্যাপারে পরামর্শ দিচ্ছি। এখন যাদের স্বাস্থ্যবীমা করা আছে, তারা কোভিড আক্রান্ত হয়ে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিলে বীমা কাভারেজ পাবেন'।
কোভিড আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে তিনি বীমা সুবিধা পাবেন কি-না, জানতে চাইলে জীবন বীমা করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জহুরুল হক টিবিএসকে বলেন, 'আমরা এ বিষয়ে একচুয়ারির মতামত চেয়েছি। দেশে একচুয়ারির সংকট থাকায় আমরা অস্ট্রেলিয়ার একজন একচুয়ারির মতামত নিয়ে থাকি, তিনিই আমাদের গাইডলাইন প্রণয়ন করে দেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন মতামত পাইনি। তার মতামত ছাড়া এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হবে না'।
২০২০ সালের জুনে ভারতের বীমা নিয়ন্ত্রক ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ দেশটির বিমা কোম্পানিগুলোকে স্বল্প মেয়াদী স্বাস্থ্য বীমা চালু করতে নির্দেশনা প্রদান করে।
এরই আওতায় ভারতের রিলায়েন্স জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড কোভিড-১৯ ইন্স্যুরেন্স স্কিম চালু করে। ৩ মাস বয়সের শিশু থেকে শুরু করে ৬০ বছর বয়সী যে কেউ এই বীমা গ্রহণ করতে পারবেন।
এর আগে 'স্টার নভেল করোনা ভাইরাস ইন্স্যুরেন্স পলিসি' নামে বীমা চালু করে ভারতের স্টার হেলথ অ্যান্ড অ্যালাইড ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী যে কেউ এই বীমা সুবিধা নিতে পারবেন।
পশ্চিমবঙ্গের আইসিআইসিআই লম্বার্ড জেনারেল ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড চালু করে 'কোভিড-১৯ প্রোটেকশন কভার' পলিসি।
এছাড়া সাংবাদিকদের জন্য বিনামূল্যে করোনা বীমা কাভারেজ দিচ্ছে নেপালের আইএমই জেনারেল ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড। এর মাধ্যমে করোনায় আক্রান্ত প্রত্যেক সংবাদকর্মী এক লাখ নেপালি রুপি অর্থ পাবেন।
পাকিস্তানে, ইএফইউ লাইফ কোভিড-১৯ তাহাফফুজ প্রদান করছে; এই স্কিমের আওতায় কোভিড-১৯ শনাক্তের পরীক্ষা থেকে শুরু করে হাসপাতালের ব্যয় নির্বাহ পর্যন্ত সম্পূর্ণ খরচ বহনের সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৭৮টি বিমা কোম্পানি কাজ করছে, যার মধ্যে লাইফ কোম্পানি ৩২টি এবং সাধারণ বিমা (নন-লাইফ) কোম্পানি ৪৬টি। এর মধ্যে ৫০টি কোম্পানি স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকাভুক্ত।