জাতিসংঘের ‘রিয়েল লাইফ হিরো’ আঁখির চোখে মানব কল্যাণের স্বপ্ন
আঁখি সুলতানা। রূপসাচরের ১৭ বছরের কিশোরী। বাবা মাসুদ মোল্লা অসুস্থ। আর মা আনোয়ারা বেগম শ্রমিকের কাজ করেন একটি মাছ কোম্পানিতে। তিন ভাই-বোনের মধ্যে আঁখি দ্বিতীয়। খুলনা রূপসা উপজেলার বাগমারা গ্রামের এই কিশোরী আঁখির বড় স্বীকৃতি মিলেছে বিশ্ব দরবারে। জাতিসংঘের 'রিয়েল লাইফ হিরো' বা বাস্তব জীবনের নায়ক- খেতাব পেয়েছে সে।
এর আগে বিশ্ব মানবিক দিবস উপলক্ষ্যে গত ১৯ আগস্ট জাতিসংঘ আঁখিসহ বাংলাদেশের চারজনকে 'রিয়েল লাইফ হিরো' হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। মূলত চলমান করোনা মহামারির শুরুতে মাস্ক তৈরি করে স্বল্প মূল্যে প্রান্তিক মানুষের কাছে বিক্রি এবং অতি-দরিদ্রদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণের স্বীকৃতি হিসেবেই এ খেতাব মিলেছে তার।
কিশোরী আঁখির এতো বড়ো স্বীকৃতি পাওয়ায় খুশির আমেজ বিরাজ করছে তার দরিদ্র পরিবারে। বিবিসি থেকে শুরু করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছে। তাকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। তাদের দেওয়া স্বপ্ন পূরণের আশ্বাসে আঁখিকে নিয়ে গর্বিত তার বাবা-মা।
আঁখির চোখে-মুখে এখন মানুষের কল্যাণে কাজ করার স্বপ্ন। ভালো সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে ভবিষ্যতে সে একটি গার্মেণ্টস কারখানা ও স্কুল থেকে ঝরেপড়া দরিদ্র শিশুদের জন্য সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি করতে চায়।
খুলনা রূপসা ঘাটপার হয়ে ডান দিকে গেলেই মেলে (পূর্ব রূপসা) বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন সড়ক। এ সড়ক দিয়ে এক কিলোমিটার পর আব্দুর রব মোড়। সেখান থেকে বাঁদিকে মাত্র একশ' গজ গিয়ে আবার বাঁয়ে একশ' গজ গেলেই ইটের রাস্তা। এবার ডানে দিকে কয়েক গজ যেতেই দেখা যাবে ছোট্ট একটা দোকানে মাস্ক, বিভিন্ন হস্তশিল্পের জিনিসপত্র রয়েছে। রয়েছে ছোটদের খাবার।
এ দোকানে বসে বেঁচাকেনা করেন আঁখির বাবা-মাসুদ মোল্লা। শারীরিকভাবে অক্ষম তিনি। এক সময় চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় কাজ করতেন। তার স্ত্রী আনোয়ারা বেগম এখনো ওই কোম্পানিতে কাজ করেন। বাবা-মা ও ভাই-বোনের সঙ্গে আঁখির পরিবার তার খালার জমিতে মাথা গোজার ঠাঁই তৈরি করে বসবাস করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আঁখি স্থানীয় বামগারা দক্ষিণপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু অভাবের তাড়নায় ৪-৫ বছর আগে বড় বোনের সঙ্গে মাছ কোম্পানিতে কাজ নিতে সেও বাধ্য হয়। পরে 'ওয়াল্ড ভিশন বাংলাদেশ' এর 'জীবনের জন্য প্রকল্প' থেকে দর্জি প্রশিক্ষণ নিয়ে সেলাই কাজ করে সংসারে রোজগার বাড়াতে থাকে আঁখি।
আঁখি জানান, যখন করোনাভাইরাস ছড়াতে শুরু করেছিল, বাজারে মাস্ক পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেক খুঁজে পাওয়া গেলেও দাম ছিল অনেক। আমাদের এলাকার দরিদ্র লোকেরা তা কিনতে পারতো না। তখন আমি নিজেই মাস্ক তৈরি করে কম দামে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিই। যাতে এলাকার গরিব মানুষসহ সবাই মাস্ক পরতে পারে। আবার যারা কিনতে পারে না- তাদের মধ্যে বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণ করি। ওয়াল্ড ভিশন থেকে পাওয়া দর্জি কাজের প্রশিক্ষণ ও সেলাই মেশিন দিয়েই আমি এ কাজ করতে সক্ষম হই।
আঁখি তার ভবিষ্যৎ স্বপ্নের বিষয়ে বলেন, ভালো সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে ভবিষ্যতে তিনি একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি গড়ে তুলতে চান। একই সঙ্গে তার মতো ঝরেপড়া দরিদ্র শিশুদের জন্য সেলাই প্রশিক্ষণ সেন্টার প্রতিষ্ঠা এবং দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াতে চান।
তার ইচ্ছা পূরণের জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য- সাবেক ফুটবলার ও শিল্পপতি আব্দুস সালাম মূর্শেদী প্রতিনিধি পাঠিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, বলেও জানান আঁখি।
কিশোরী আখিঁর বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতিতে অনুভুতি ব্যক্ত করতে গিয়ে মা আনোয়ারা বেগম বলেন, বস্তি ঘরে থেকে আমার মেয়ে এমন সুনাম আনবে আমি ভাবতেও পারিনি। ওর বাবা অনেক অসুস্থ। তেমন একটা হাঁটতে-চলতে পারে না। আমিও মাছ কোম্পানিতে কাজ করি। আঁখি যেন ভবিষ্যতে দরিদ্র মানুষের জন্য কিছু করতে পারে- এ আশা ব্যক্ত করেন তিনি।
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ সাউদার্ন রিজিওনের রিজিওনাল কম্যিউনিকেশন্স কো-অর্ডিনেটর সুবর্ণ চিসিম জানান, ২০১৮ সালে রূপসার একটা চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় আঁখির সন্ধান মেলে। তাকে আমরা স্কুলে ভর্তি করার উদ্যোগ নেই। কিন্তু, বয়স বেশি হওয়ায় তাকে ভর্তি করা যায়নি। তবে তার আগ্রহ দেখে 'জীবনের জন্য প্রকল্প'র মাধ্যমে সেলাই প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করি। প্রশিক্ষণ শেষে আঁখিকে একটি সেলাই মেশিন ও কিছু থান কাপড় দেওয়া হয়। সে এই করোনা মহামারিকালে মাস্ক তৈরি করে কম দামে গরিব লোকদের কাছে বিক্রি করেছে। অনেককে বিনামূল্যে মাস্ক দিয়েছে। জাতিসংঘ তার এই মহৎ কাজের স্বীকৃতি দেয়ায় আমরা অত্যন্ত আনন্দিত।
এ বিষয়ে রূপসা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাসরিন আক্তার বলেন, রূপসা চরের আঁখি এখন রূপসা তথা খুলনাবাসীর গর্ব। এ কারণে তাকে আজ বুধবার (২৬ আগস্ট) উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়া হবে। এছাড়া, তার ইচ্ছা পূরণের জন্য উপজেলা প্রশাসনের সাধ্যের মধ্যে সবকিছু করা হবে।
প্রসঙ্গত, জাতিসংঘ কর্তৃক 'রিয়েল লাইফ হিরো' হিসাবে স্বীকৃতি প্রাপ্ত বাংলাদেশের অন্য তিন যুবক হলেন, প্রাক্তন ডাকসু সদস্য তানবীর হাসান সৈকত, ব্র্যাকের প্রকৌশলী রিজভী হাসান এবং অনুবাদক সিফাত নূর।