দেশের নদীতীরগুলোতে ১৫ হাজার মেগাওয়াট সৌরশক্তি উৎপাদন সম্ভব
- বর্তমানে বিদ্যমান জমি ও নতুন করে একীভূত করা জমি মিলিয়ে মোট ৩,২১৩ বর্গকিলোমিটার জমি পাওয়া যাবে।
- এর মধ্য থেকে ১৫০ বর্গকিলোমিটার ( ৫ শতাংশেরও কম) ব্যবহৃত হবে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে।
- গাইবান্ধা, জামালপুর ও সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর প্রতি তীরে ২০০০ মেগাওয়াট শক্তি উৎপাদন সম্ভব।
- মুন্সিগঞ্জ ও রাজবাড়িতে পদ্মা নদীর তীরে ৩০০০ মেগাওয়াট শক্তি উৎপাদন সম্ভব ।
- পাবনায় যমুনা ও পদ্মা তীরে ১০০০ মেগাওয়াট শক্তি উৎপাদন সম্ভব।
- ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মোট নবায়নযোগ্য শক্তির ১০ শতাংশ উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে।
জাতীয় সৌরবিদ্যুৎ পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১ জানিয়েছে, ২০৪১ সালের মধ্যে ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জমি আছে দেশের প্রধান নদীতীরগুলোতে।
২০২০ সালের আগস্টে চূড়ান্ত হওয়া এই পরিকল্পনায় বলা হয়, নদীতীরবর্তী চাষাবাদ ও বসবাসের অযোগ্য জমিগুলো সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন কাজে ব্যবহার করা সম্ভব।
এছাড়াও বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুতের অন্যান্য উৎসের সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা করা হয়।
বর্তমানে বিদ্যমান জমি ও নতুন করে একীভূত করা জমি মিলিয়ে ২০২১ থেকে ২০৪১ সালের মধ্যে মোট ৩,২১৩ বর্গকিলোমিটার জমি পাওয়া যাবে। এর মধ্য থেকে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে ১৫০ বর্গকিলোমিটার ( ৫ শতাংশেরও কম) ব্যবহৃত হবে ।
বিস্তীর্ণ জমির কিছু অংশ একটি গিগাওয়াট মাত্রার সোলার পার্ক বসানোর জন্যেও নেওয়া হতে পারে।
দেশের দক্ষিণে মেঘনা নদীর মোহনায় প্রাপ্ত জমিতে ৩০০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র করা যাবে। অন্যদিকে গাইবান্ধা, জামালপুর ও সিরাজগঞ্জ জেলায় যমুনা নদীর তীরগুলোর প্রতিটিতে ২০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা সম্ভব।
মুন্সিগঞ্জ ও রাজবাড়ি জেলায় প্রমত্তা পদ্মার তীরে অন্য একটি ৩০০০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এছাড়াও পাবনায় পদ্মা ও যমুনার তীরেও ১০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা সম্ভব হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
টেকসই ও নবায়নযোগ্য শক্তি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলাউদ্দিন বলেন, 'ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ অনুযায়ী, নদীতে ড্রেজিং করার ফলে নতুন জমি সহজলভ্য হবে। ডেল্টা প্ল্যানের সঙ্গে মিলিয়ে প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে কিনা তার ওপর জমি প্রাপ্তি নির্ভর করছে ।'
তিনি আরও বলেন, 'সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিকল্পনা অনুযায়ী বলা হচ্ছে, এই জমিগুলো সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য উপযোগী। সেইসঙ্গে সরকারও আমাদেরকে এসব জমি ব্যবহার করার এবং যথাযথ প্রকল্প প্রণয়নের অনুমতি দিয়েছে। এসব জমিতে ছাদের উপর সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসানোসহ অন্যান্য সুবিধা নেওয়ার উপায় রয়েছে।'
বর্তমানে ১৪৩ মেগাওয়াট অন-গ্রিড এবং ৩৪৭ মেগাওয়াট অফ-গ্রিডসহ মোট ৪৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসে সৌর বিদ্যুৎ শক্তি থেকে। যদি কোন বিশেষ ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তাহলে ২০৩১ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন ২,৬৬৫ মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালে তা ৮০০০ মেগাওয়াটে গিয়ে পৌঁছাবে। কিন্তু এই খাতে যদি আন্তর্জাতিক ও সরকারি উভয় দিক থেকে প্রচেষ্টা ও সহায়তা দেওয়া হয়, তাহলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ২০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করা সম্ভব।
অ্যাকশন প্ল্যান জানাউ, এ খাতে যদি প্রয়োজনীয় সরকারি উদ্যোগ নেয়া হয় এবং নির্ভরযোগ্য আন্তর্জাতিক অর্থায়ন করা সম্ভব হয়, তাহলে সৌর শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৩০ হাজার মেগাওয়াটে গিয়ে পৌঁছাতে সক্ষম যা ২০৪১ সালের মধ্যে এর মোট ধারণ ক্ষমতার ৪০ শতাংশ হবে।
আনুমানিক সৌর শক্তি প্রাপ্তির উৎস হিসেবে ধরা হয়েছে সোলার পাওয়ার হাব, ছাদ, সেচ পাম্প, রাস্তার ল্যাম্প, সোলার চার্জিং স্টেশন, সোলার টেলিকমিউনিকেশন টাওয়ার ও অন্যান্য সৌর শক্তি পরিচালিত প্রক্রিয়াকে। রিভাইজড পাওয়ার সেক্টর মাস্টারপ্ল্যান জানায়, বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে মোট নবায়নযোগ্য শক্তির ১০ শতাংশ উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে।
কিন্তু সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সময় দেশের নদীতীরে বন্যা প্লাবন সমস্যার ব্যাপারে আরও যথাযথ চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ বলে পরামর্শ দিয়েছে মাস্টারপ্ল্যান।
তবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার (ক্লাইমেট ফাইন্যান্স গভারন্যান্স) এম জাকির হোসেন বলেন, 'ডেল্টা প্ল্যান দুর্যোগের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করবে, তাই বন্যা এক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে না। তাছাড়া সৌর বিদ্যুৎ প্যানেলের উচ্চতা বাড়ানোও খুব সহজ কাজ।'
তিনি আরও বলেন, ' নদীতীরে বড় পরিসরে সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনেক বেশি সুবিধা রয়েছে যা আমাদের দুইভাবে উপকৃত করবে। প্রথমত, এটি আমাদের কৃষি জমিকে রক্ষা করবে এবং কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনবে। দ্বিতীয়ত, এটি নদী তীরকে অনধিকার দখলের হাত থেকে রক্ষা করবে।'
গ্রিন ফিউচার সূচকের প্রায় তলানিতে বাংলাদেশ
জানুয়ারিতে এমআইটি টেকনোলজি রিভিউ ৭৬ টি দেশের সমন্বয়ে একটি গ্রিন ফিউচার সূচক প্রকাশ করে, যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৯ তম।
এই সূচকে প্রতিটি দেশকে ৫ টি মূল ভিত্তির উপর নির্ভর করে নম্বর দেওয়া হয়। এই ৫ টি বিষয় হলো- কার্বন নিঃসরণ, শক্তি রূপান্তর, গ্রিন সোসাইটি বা সবুজ সমাজ, পরিচ্ছন্ন উদ্ভাবন এবং জলবায়ু নীতি।
পরিচ্ছন্ন উদ্ভাবন বিভাগে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭৩ তম এবং কার্বন নিঃসরণ বিভাগে নিঃসরণ বৃদ্ধির হার হ্রাসের হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭১ তম।
তবে শক্তি রূপান্তর ও সবুজ সমাজ স্থাপনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল। এই দুটি বিভাগে বাংলাদেশের অবস্থান যথাক্রমে ২৭ তম ও ২৫ তম। জলবায়ু নীতির দিক থেকে বাংলাদেশ ৫১ তম অবস্থান ছিল।
সূচকে বাংলাদেশের চাইতে দুই ধাপ এগিয়ে ৬৭ তম অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান, অন্যদিকে ভারতের অবস্থান ২১ তম। এছাড়াও সবুজ সমাজ বা গ্রিন সোসাইটি বাদে বাকি সব বিভাগেই বাংলাদেশের চাইতে এগিয়ে রয়েছে ভারত। এমনকি উগান্ডা ও নাইজেরিয়ার মত কিছু দরিদ্র আফ্রিকান দেশও সূচকে বাংলাদেশের চাইতে ভালো অবস্থানে রয়েছে ।
সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আলাউদ্দিন মন্তব্য করেন, 'আমি মনে করি না যে আমরা সূচকের তলানিতে রয়েছি। আমাদের কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ০.৪ শতাংশেরও কম; যা ভারত, চীন বা অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় কিছুই নয়। আমরা আমাদের পুনঃনবায়নযোগ্য শক্তি নীতি ২০০৮ কে পুনরায় পর্যালোচনা করছি এবং একে আরো আধুনিক ও উন্নত করে তোলার চেষ্টা করছি।'
জাকিরের ভাষ্যে, বাংলাদেশের উচিৎ সৌর শক্তির যন্ত্রপাতি আমদানির ওপর সকল শুল্ক বিধি-নিষেধ তুলে দেওয়া।
'বিভিন্ন শিল্প খাতে, বিশেষ করে গার্মেন্টস কারখানাগুলো সৌরশক্তির বদলে তাদের নিজস্ব এলএনজি ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করছে। উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ জাতীয় ফ্রিডে সরবরাহ করার এবং আশেপাশের ছোট কারখানাগুলোয় বণ্টনের সুযোগ কম থাকায় শিল্পপতিরা জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে', বললেন জাকির।