দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা নিম্ন আয়ের মানুষ
দুধ চা ৭ টাকা, রং চা ৬ টাকা- লেখা একটি প্ল্যাকার্ড ঝুলানো রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেন প্রতিবন্ধী স্কুলের বিপরীত পাশের একটি চা দোকানে। কেন চায়ের দাম বাড়িয়েছেন জিজ্ঞেস করতেই চা দোকানি জেসমিন আক্তার (৪০) চট করে উত্তরে বলেন, `চা পাতার দাম কেজিতে ৩৬০ থেকে বেড়ে ৪৩০ টাকা হয়ে গেছে, এছাড়াও চিনির ৬০থেকে বেড়ে ৮০ টাকা, বক্সের দুধ ৫২ থেকে এখন ৭৫ টাক ও সিলিন্ডারের দাম ১১০০ থেকে বেড়ে ১৩০০ টাকা হয়ে গেছে!
"তাহলে আমি চায়ের দাম না বাড়িয়ে উপায় কী? তাই বাধ্য হয়েই আজ চায়ের দামের প্লে-কার্ড টাঙ্গিয়েছি।"
শুধু চায়ের দাম-ই নয়, নিত্য প্রয়োজনীয় মুরগি, ডিম, পেঁয়াজ, চিনি, গ্যাস, ময়দা, দুধ ইত্যাদির দাম বাড়ায় হু হু করে দাম বেড়েই চলছে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কিছুর দামও। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির প্রভাবে দিশেহারা নিম্ন আয়ের মানুষ।
বাংলামোটর পাম্পের গলিতে বিসমিল্লাহ রেস্টুরেন্টে দুপুরে খেতে এসেছেন জামাল শেখ। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সব খাবারের জিনিসের-ই দাম বেড়ে গেছে, মুরগির মাংস ৪০ থেকে ৬০ টাকা হয়ে গেছে, গরুর মাংস ৮০ টাকার পরিবর্তে থেকে এখন ১০০ টাকায় খেতে হচ্ছে।"
তিনি আরও বলেন, "আজ সকালে ৫ টাকার পরোটা ৭ টাকায়, ১০ টাকার সবজি ১৫ টাকায় এবং ১৫ টাকার ডিম ভাজি ২০ টাকায় কিনে খেতে হয়েছে! এভাবে দাম বাড়তে থাকায় আমাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষের খুবই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।"
বিসমিল্লাহ রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার এমরান হোসেন টিবিএসকে বলেন, "সব কিছুই বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে, তাই আমরাও দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছি, সরকার জিনিসপত্রের দাম কমালে আমরা দাম কমাতে পারবো।"
ইস্কাটন গার্ডেন ভ্রাম্যমাণ খাবার দোকানি বাবুল মৃধা বলেন, "গত চার-পাঁচ দিন থেকে কাচাঁমাল কিনতে দৈনিক ২০০০ থেকে ৩০০০ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে। পাঁচদিন আগে যে ময়দার বস্তা ১৮ শ টাকা ছিল এখন ২৩০০ টাকায় কিনতে হয়েছে, ৪৫ টাকার পেঁয়াজ ৮০ টাকায় কিনতে হচ্ছে, তাই খাবারের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছি।"
ভ্র্যমমাণ অপর দোকনি দবির উদ্দিন বলেন, "খাবারের দাম বাড়িয়ে দেয়ায় আজ সকালে তিন-চার কাস্টমারের সাথে ঝগড়া হয়েছে আমার, কিন্ত আমরা কী করুম বলেন, জিনিসপত্র বেশি দামে কিনতে হচ্ছে, তাই আমরাও দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছি।"
নিউ ইস্কাটন বিআইএএম ফাউন্ডেশনের গলিতে কাঁচা বাজারে এসেছেন মুফাজ্জল হোসেন বিদ্যুত। তিনি ব্রয়লার মুরগি কিনেছেন।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, "প্রতিটি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসেরই দাম বেড়ে গেছে! ব্রয়লার ১২০ টাকা থেকে বেড়ে ১৯০ টাকা কেজি হয়ে গেছে, সয়াবিন তেল ১১০ টাকা থেকে ১৬০ টাকা, মোটা মসুরির ডাল ৬০ টাকা থেকে ১০০ টাকা এবং সব ধরনের সবজিতেই ৫-১০ টাকা বেড়ে গেছে!"
"১৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করে বাসা ভাড়া, খাওদা-দাওয়াসহ সব মিলিয়ে আমার হিমশিম খেতে হচ্ছে, এভাবে দাম বাড়তে থাকলে আমাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষের সামনের দিনে না খেয়ে থাকা ছাড়া উপায় দেখছি না,-বললেন মোফাজ্জল হোসেন।"
মুরগি ব্যবসায়ী নুরুল আমিন টিবিএসকে বলেন, "বাজারে মুরগির দাম দিন দিন বাড়ছেই, তাই আমাদেরও বাজারের রেট অনুযায়ী বিক্রি করতে হচ্ছে, ব্রয়লার ১৭৫ টাকা কেজি দরে আমাদেরই পাইকারি কিনে আনতে হচ্ছে, এছাড়াও মুরগির খাবারের ২৫কেজির বস্তা ৬৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৮৫০ টাকা হয়ে গেছে।"
দেশের ৬৪ জেলায় ২ হাজার ৬৭৫ জন নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে পরিচালিত বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের চালানো এক জরিপে দেখা যায়, চরম দারিদ্র্যের হার আগের তুলনায় বেড়ে গেছে ৬০ শতাংশ। ১৪ শতাংশ মানুষের ঘরে কোনো খাবার নেই। তাদের মধ্যে দিনমজুর, নির্মাণ শ্রমিক, রিকশাচালকেরও একটি বড় সংখ্যা রয়েছে।
এ বছরের ৩১ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিলের মধ্যে জরিপটি পরিচালিত হয়।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের 'অর্গানাইজিং দ্য ইনফরমাল ইকোনমি ওয়ার্কার্স: আ স্টাডি ইন রিকশা পুলারস ইন ঢাকা সিটি' শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা শহরে এখন আনুমানিক ১১ লাখ রিকশা রয়েছে। করোনায় আয় কমে যাওয়ায় এসব রিকশাচালকরা অর্থকষ্টে রয়েছেন।
তার উপর এখন দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার আরও বিপাকে এসব নিম্ন আয়ের মানুষ।
রিকশা চালক আনোয়ার হোসেন টিবিএসকে বলেন, "জিনিসপত্রের যেভাবে দাম বেড়েছে এভাবে আমাদের খুবই কষ্ট হচ্ছে। আজ সকালে ৭-৮ টাকায় পরোটা কিনে খেতে হয়েছে। অথচ আমাদের আয় তো বাড়েনি, আজ মগবাজার চার রাস্তার মোড় থেকে বাংলামোটর পযন্ত ২০ টাকার ভাড়া ২৫-৩০ টাকায় টানছি। তবে অনেকে দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় রিকশা থেকে নেমে গেছে।"